বিশ শতকের গোড়ায় সিগমন্ড ফ্রয়েড এবং কার্ল ইয়ূঙ মানুষের মনের ওপর চমকপ্রদ গবেষণা চালিয়ে ব্যক্তিত্বের বৈপ্লবিক সংজ্ঞা নিরূপণ করেছিলেন। মানুষের মনস্তত্ব নিয়ে ক্রমবর্ধমান আগ্রহের ফলে ‘মনের ক্ষমতা’ ও ‘অবচেতনের ক্ষমতা’ – ইত্যাদি শব্দবন্ধ এখন ঘরে ঘরে ব্যবহৃত। আগ্রহের এই বিস্তার আমেরিকার এক আশ্চর্য ব্যক্তিকে স্মরণ করিয়ে দেয়। তাঁর নাম এডগার কেইসি। অনেকেই দাবি করেন, তিনি মনের ক্ষমতা প্রয়োগ করে হাজার হাজার মনোরোগীকে সারিয়ে তুলেছেন। শুধু তাই নয়, এতাবৎ পাশ্চাত্যে অজ্ঞাত মানুষের অস্তিত্বের গভীর আধ্যাত্মিক ও দার্শনিক সত্যকে নিজের অবচেতন স্তর থেকে উন্মোচিত করেছেন।
এডগার কেইসিকে (১৮৭৭-১৯৪৫) বলা হয় ‘ঈশ্বরের ঘুমন্ত প্রবক্তা’, ‘সামগ্রিক দাওয়াইয়ের জনক’। কেনটাকি প্রদেশের হপকিন্সভিলে জন্ম তাঁর। কেইসির মনস্তাত্বিক ক্ষমতার পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর শৈশবেই। লোকশ্রুতি রয়েছে, তিনি নাকি তাঁর পরলোকগত ঠাকুর্দাকে দেখতে ও তাঁর আত্মার সঙ্গে কথা বলতে পারতেন। পারতেন একটি বইয়ের ওপর শুয়ে থেকে সেই বইটির পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা স্মৃতিতে দিব্যি ধারণ করতে। দাবি করা হয় পরবর্তী জীবনে কেইসি একটি সোফার ওপর চোখ বুজে, পেটের ওপর হাত দুটি রেখে শুধু শুয়ে থাকলেই ঘুমের অনুভূতি বোধ করতে পারতেন। বিশ্রাম ও ধ্যানের এই ভঙ্গিতে তিনি নিজের মনকে সর্বব্যাপী স্থান ও কালের, যাকে সর্বজনীন চেতনা, অতিচেতন বা তূরীয় অবস্থাও বলা হয়, তার সংস্পর্শে নিয়ে যেতে সক্ষম হন। সেই অবস্থায় থেকেই তিনি ‘বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের রহস্য কী?’ এবং ‘আমার জীবনের উদ্দেশ্য কী?’ এই জাতীয় বৃহত্তর প্রশ্ন থেকে শুরু করে ‘আমার আর্থারাইটিস্ কীভাবে আরোগ্য হবে?’ এই ধরণের ব্যক্তিগত প্রশ্নেরও উত্তর দিতে পারতেন। তাঁর এই জাতীয় উত্তরগুলিকে বলা হয় ‘রিডিংস্’। বলা হয়, এই পদ্ধতিতে তিনি হাজার হাজার রোগীকে বেমালুম সারিয়ে তুলেছেন প্রায় ধ্যানস্থ অবস্থায় সঠিক ওষুধের নিদান দিয়ে। কেইসির রোগ নির্ধারণের ক্ষমতা এবং আরোগ্যের কার্যকরী ব্যবস্থাপত্র তাঁকে জনপ্রিয় করে তোলে। সারা পৃথিবী থেকে রোগীরা তাঁর সঙ্গে চিঠিপত্রের মাধ্যমে যোগাযোগ করে পরামর্শ নিতে শুরু করে।
কিন্তু কেইসি অর্থ উপার্জনের জন্য তাঁর ক্ষমতাকে কদাচ ব্যবহার করেননি। তিনি বিশ্বাস করতেন, মানুষের শরীর ও মনের আরোগ্য সাধনের জন্য তাঁর প্রাপ্ত ক্ষমতা ঈশ্বর-প্রদত্ত। এর বিনিময়ে অর্থ গ্রহণ অন্যায়। কেইসির ভাবনাচিন্তার ভিত ছিল পুনর্জন্ম, কর্ম, আত্মার যাত্রা ও উদ্দেশ্য, দিব্যবিভা, আধ্যাত্মিক উন্নতি, ধ্যান ইত্যাদি, যার বেশিরভাগই খ্রিস্টধর্মে ইতিপূর্বে পাওয়া যায়নি। শিক্ষার সামান্য পুঁজি ও নিজের দেশের বাইরে দর্শনের কিছুই না-জানা মানুষটির দার্শনিকচিন্তার যে স্ফূরণ তাঁর অবচেতন থেকে ঘটতো, তার সঙ্গে বৈদিক দর্শনের আশ্চর্য সাযুজ্য রয়েছে। শুধুই সাধারণ মানুষেরা তাদের ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়ে তাঁর কাছে ছুটে যেত এমন নয়। কেইসির কাছে চিকিৎসিত হওয়া বিখ্যাত ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন, আবিস্কারক টমাস এডিসন, গীতিকার আর্ভিং বার্লিন, এবং বিখ্যাত পিয়ানো বাদক জর্জ গার্সউইনের মতো জাঁদরেল ব্যক্তিত্বেরাও।
কেইসির চিকিৎসায় সেরে ওঠা মর্টন ব্লুমেন্থাল নামে এক বিত্তশালী ব্যক্তির অর্থানুকূল্যে ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে ভারজিনিয়া বীচে ‘কেইসি হাসপাতাল’ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৩১-এ কেইসির নিজের গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠান ‘ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার অব দি অ্যাসোসিয়েশান ফর রিসার্চ অ্যাণ্ড এনলাইটেনমেন্ট’ (I.A.R.E) এবং ‘এডগার কেইসি কানাডা’ নামে একটি অসরকারি সংস্থা এখনও শিক্ষা ও আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য কাজ করে চলেছে। কেইসির চিন্তা মানবিক উন্নয়নের জন্য সর্বজনীন সচেতনতার লক্ষ্যে প্রয়োগ করার চেষ্টা চলছে যাতে এই গ্রহের মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সামাজিক সংযোগ সদর্থক সম্পর্কের বিস্তার ঘটানো সম্ভব হয়।