ফয়তাপুরের নায়েব কাছারির সামনের ময়দানে তাঁবু পড়েছে। শ্যাওলা রঙের পুরু ত্রিপলের গণ্ডা চারেক শক্ত-পোক্ত তাঁবু। খুঁটি পুতে কাঁটাতার দিয়ে ঘিরে নেওয়া হয়েছে অনেকটা জায়গা। বেড়াল-কুকুরও যাতে সেখানে ঢুকতে না পারে। দশজন মিলিটারির ক্যাম্প হয়েছে এখানে। সামনের গেটে বন্দুকধারী আমেরিকান নিগ্রো সেপাই পাহারা দিচ্ছে। তার জলপাই রঙের উর্দির ওপর ঝাঁ-চকচকে রোদ ছলকাচ্ছে, কিন্তু মুখটা যেন কেমন অন্ধকার। হয়তো এখন তার মায়ের কথা মনে পড়ছে, কিংবা বোনের, কিংবা প্রেমিকার। কিংবা হয়তো তার চামড়ার রং কালো বলেই এমনটা মনে হচ্ছে। ওর মাপা মাপা পায়ে পায়চারি আর নাদুসনধর শরীর দেখতে, স্কুলে যাওয়ার পথে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ুয়া ছেলেরা কেমন যেন সন্ত্রস্ত আর কৌতূহলী হয়ে তাকিয়ে আছে। কাঁটাতারের বেড়ার ভেতর থেকে অন্য দু’চারজন নিগ্রো সোলজার, স্যাণ্ডো গেঞ্জি আর ট্রাউজার্স পরে, হাতে করে এঁটো পাউরুটি ও কড ফিশের খালি কৌটো ছুড়ে ফেলছে বেড়ার বাইরে ভ্যাটের ওপর। ভ্যাট উপচে সেগুলো ছিটিয়ে পড়েছে চতুর্দিকে। মাছি ভনভন করছে, গোটা দশেক কুকুর আর এক ঝাঁক কাক-শালিকের মহোৎসব লেগেছে সেখানে। একজন ভীত রাখাল-কিশোরকে হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকছে এক সেপাই। কমুনিকেট করতে চেষ্টা করছে। কাম কাম, টেক ব্রেড, ইউ গুড, টুমি বালো। তার সঙ্গীরা হেসে গড়িয়ে পড়ছে। একটা বালিশের সাইজ এঁটো রুটির না খাওয়া অর্ধেকটা উড়ে এসে পড়েছে রাখালের পায়ের কাছে। চকিতে সেটা তুলে নিয়ে বুভুক্ষু রাখাল ছুটে যাচ্ছে মাঠের ওপারে। দেশে আকাল চলছে। পঞ্চাশের আকাল। এই পাউরুটিটা তার কাছে এই মুহূর্তে জীবনের আশ্বাস। পেছনে সোলজারদের ঠা-ঠা হাসি তাকে আরও দ্রুত ঠেলে দিচ্ছে তার আম্মির দিকে। কতোদিন যে তার আম্মির পেটভরে খাওয়া জোটেনি।

ক্ষুৎপীড়িত গ্রামে লঙ্গরখানা চালানোর দায়িত্ব পেয়েছেন এরফান সাহেব। জনাব এ মহকুমার এক নম্বর মিলিটারি কনট্রাকটার। পোড়াবাড়ি হাটখোলার ঘাটে নোঙ্গর করা আছে তাঁর হাজার-মনি, দেড়হাজার-মনি তিনচারখানা নৌকা। তাদের কোনওটায় চাল, কোনওটায় গম, কোনওটায় চিনি, আটা, ময়দা, সুজি, লবণ, সরষের তেলের টিন, এইসব। এখন সেগুলো খালি। শুধু নদী আর বাজারের মধ্যবর্তী ফাঁকা মাঠে, যেখানে ছেলেরা ফুটবল খেলত, সেখানে চটের বস্তায় স্তূপাকৃতি সাজানো রয়েছে প্রায় হাজার মন চাল। নীচের বস্তাগুলো ধুলোমাটি শ্যাওলায় জীর্ণ হয়ে গেছে। ফেঁসেও গেছে দু’একটা। তার ভেতর থেকে নোংরা নীল তুতের দানার মতো কিছু কিছু বিষাক্ত চাল ছড়িয়ে পড়েছে। সেগুলো ইদুর-বাঁদরেও খায় না। একজন চৌকিদার আর দুইজন দফাদার বেটন হাতে এইসব চালের খবরদারি করে।

এরফান সাহেব অতি বদান্য ব্যক্তি। ফুটবল খেলা থেকে বঞ্চিত ছেলেদের বর্ষার শেষেই তিনি কিনে দেন ব্যাডমিন্টন খেলার সরঞ্জাম। নিজের গদির সামনের চটান উঠোনে নিজেই দড়ি ধরে কোর্ট কাটতে লেগে পড়েন ছেলেদের সাথে। তাঁর। গোমস্তা নরু গলদঘর্ম হয়ে চুন ছিটিয়ে লাইন ঠিক করে। পাশের কাঁঠাল গাছে বেঁধে রাখা এরফান সাহেবের দেখনশোভা সাদা ঘোড়াটি লাগাম চিবোবার ফাঁকে ফাঁকে চিহি করে ডেকে মাটিতে ক্ষুর ঠোকে। বোধহয় এই সব বালখিল্য তঞ্চকতায় তার অপার হাসি পায়।

গ্রামের পশ্চিমপ্রান্ত দিয়ে যে দিগন্তবিস্তারী নদী বাজারের পাশে কিঞ্চিত দক্ষিণ-পূর্বমুখী হয়ে এলাসিন গ্রামের দিকে এগিয়ে গেছে, তার নাম যমুনা। বাহাদুরাবাদের কাছে ব্রহ্মপুত্র থেকে বের হয়ে দক্ষিণমুখী হয়ে পূর্বে জগন্নাথগঞ্জ, পশ্চিমে সিরাজগঞ্জ, আবার পূর্বে চারাবাড়ি পোড়াবাড়ি ছাড়িয়ে এলাসিন হয়ে ধলেশ্বরী পদ্মায় একাত্ম হয়েছে। এর পূর্বপারে ময়মনসিংহ এবং পশ্চিমে পাবনা জেলা, আর নদীর বুকে ছোটবড় বেশ কয়েকটি চরে নতুন নতুন বসত, নতুন নতুন সংসার। বিস্তীর্ণ যমুনায় চলাচল করে শত শত যাত্রী আর মালবাহী নৌকা। চলাচল করে সুবিখ্যাত দোতলা। স্টিমার সার্ভিস কালিগঞ্জ মেল। বরিশাল, বাখরগঞ্জ থেকে উজিয়ে আসে নারকেল, চাল-ডাল আর মুদিখানার নৌকো। আসাম আর উত্তরবঙ্গ থেকে ভেসে আসে বাঁশ ও কাঠের বিশালাকার ভেলা। তাছাড়া যাত্রিবাহী পানসী, গয়নার নৌকা, হাটুরে নৌকা, সাপের ঝাপি ভর্তি বেদের নৌকা, ধান কেটে আনার খোলা নৌকা, ইলিশ ধরার জেলে নৌকা, ছিমছাম কোষা আর ডিঙি, হাজার-মনি, দেড়হাজার-মনি ধান-চালের নৌকা আর বাহারি বজরা। নৌকার কি শেষ আছে? বিশ বাইশ বইঠার ছিমছাম ছিপ নৌকাগুলো কী করে? ভাদ্র সংক্রান্তিতে নৌকা বাইচের প্রতিযোগিতায় প্রথম, দ্বিতীয় হয়ে পিতলের ঘড়া-কলসি জিতে তুলকালাম নাচে। আর অন্য দিনগুলোতে? ডাকাতি? হ্যা, তা-ও করে বৈকি। এই আকালের টালমাটাল সময়ে কোইচ্যা দ্যাওয়ানের নেতৃত্বে বেশ কয়েকটি ছিপ নৌকা যমুনায় ডাকাতির কাজে নিযুক্ত। এখন যমুনা নদী ডাকাতের সর্দার কোইচ্যার রাজত্ব। রাজধানী তার কাতুলির চর।

কোইচ্যার অবশ্য কোনও লক্ষ্য নেই বাজার-মাঠে পড়ে থাকা এরফান সাহেবের চালের দিকে। তাঁর রাজত্ব নদীতে, সেখানে সে মাছের মত সাবলীল। ঢালানের স্টিমারঘাট থেকে এলাসিন, পুরো নদীপথে চলাচলকারী মালবাহী নৌকাগুলো তার লক্ষ্য। চাল-ডাল, আটা-ময়দা, তেল-নুন, চিনি-কেরোসিন ভর্তি সরকারি বা বেসরকারি নৌকাকে মাঝ দরিয়ায় চকিতে আক্রমণ করে মালপত্র লুটে নেওয়াই তার আসল কাজ। তারপর প্রতি ছিপে বিশ-বাইশ জোড়া হাতের তাকতে সে মালপত্র পৌছয় কাতুলির চরে। চরবাসীরা সকালে জড়ো হয়ে কোইচ্যার উঠানে তামুক খায়, বিড়ি টানে, কোইচ্যার কেরানি ফলাও করা রং-বাহারি কাহিনি শুনে বুক ফোলায় আর তারপর কোইচ্যার ব্যবস্থা অনুযায়ী চার আনা সের দরে চাল, চোদ্দ পয়সা সের চিনি, চার পয়সা বোতল কেরোসিন কিনে এই দুঃসহ আকালের দিনেও তিনবেলা পেট ভরে ভাত খায়। আকালের আঁচ তাদের ছুঁতেও পারে না। আর রাতে? রাতের আরাম হারাম তাদের কাছে। সক্ষম পুরুষেরা জোট বেঁধে চার পাঁচটা ছিপ নৌকায় প্রয়োজনমত দাঁড় টানে, লুটপাট করে মালপত্র তোলে নামায়, লাঠি-সড়কি-তির-গুলতি এমনকী প্রয়োজনে বন্দুক চালায়, অন্ধকারেও তাদের চোখ বাঘের মত জ্বলে। বয়স্ক পুরুষেরা নদীর ধারে ঘোরে ফেরে, চোখের উপর হাত রেখে দূর দরিয়ায় অন্ধকারে দৃষ্টি বাড়ায়, কোথাও কোনও আলোর ফুটকি কিংবা কালো ছায়া দেখলে বুঝে নিতে চেষ্টা করে দোস্ত না দুশমন, তারপর দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রয়োজনে সতর্ক করে গ্রামবাসীদের।

টাঙ্গাইল থানার দারোগা আমিনুর হোসেন সাহেব সৎ এবং সাহসী পুরুষ হিসাবে পরিচিত। একদা জনাব খুব দক্ষতার সঙ্গে পোড়াবাড়ি হাটে স্বদেশীদের সভা ছত্রখান করে দিয়েছিলেন। স্বহস্তে বেটন হাঁকিয়ে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিলেন সভাপতি অন্নদা বক্সীর। সাদা খদ্দরের ওপর তাজা রক্তের ছাপ নিয়ে অন্নদা যখন জেলা বোর্ডের রাস্তা দিয়ে মাথা উঁচু করে ‘মার দিয়ে কি মা ভোলাবি, আমি কি মা’র সেই ছেলে? দেখে রক্তারক্তি বাড়বে শক্তি, কে পালাবে মা ফেলে’ গাইতে গাইতে সদলবলে আলিসাকান্দার দিকে যাচ্ছিলেন, তখন পথের দু’ধারের বাড়িগুলো থেকে কৌতূহলী মহিলারা উঁকি মেরে এই দৃশ্য দেখে কেমন ভীত আর উদাস হয়ে গিয়েছিলেন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের জরুরি নির্দেশে উদ্দীপিত আমিনুর, কোইচ্যাকে কায়দা করার জন্য বারকয়েক গভীর রাতে কাতুলির চরে অভিযান চালিয়েছিলেন। জনাব অবহিত ছিলেন, কোইচ্যাকে ধরতে পারলে তাঁর পদোন্নতি অবধারিত। কিন্তু কোনও অভিযানেই পুলিশের দল কাতুলি থেকে কিছু খাসি, পাঠা আর মোরগ ছাড়া অন্য কোনও কিসিমের পুরুষ প্রাণীকে বেঁধে আনতে পারেনি। অবশ্য দস্যু ডাকাতের চাইতে এগুলো অনেক নিরাপদ এবং সুস্বাদু প্রতিপন্ন হওয়াতে পরবর্তী অভিযানগুলোতে অংশ নেওয়ার জন্য কনস্টেবলদের মধ্যে একটা গোপন প্রতিযোগিতাও দেখা গিয়েছিল। শোনা যায়, এরা কেউ কেউ পুলিশের নৌকাতেই দু’একবার দু’চারটে দুগ্ধবতী গাভীও নাকি …কিন্তু সেটা গুজব হলেও হতে পারে।

সর্বেশ্বর ডাক্তার তাঁর দু’ছেলের বিয়ে দিচ্ছেন একসঙ্গে। দু’টোই যমুনার পশ্চিম পারে। বর, বরযাত্রী, বরকর্তা সবাই একসঙ্গে দু’তিনটে পানসীতে যাবেন। সাত দিনের প্রোগ্রাম। তার মধ্যে নদীর ওপরেই কাটবে তিন দিন। ফিরে এসে আবার পাকস্পর্শ। শ’পাঁচেক লাোক খাবে। তার ওপর অনাহুত-রবাহুত তো আছেই। চালটা অন্তত কিনে। রাখা দরকার। যা হু-হু করে দাম বাড়ছে! সম্বৎসর তো নিজেদের ক্ষেতের চালই খাওয়া হয়। কিন্তু নেমন্তন্ন বাড়িতে তো সে চাল চলবে না। ভাল বাসমতির দাম উঠেছে আট টাকা মন। ফিরে এসে হয়তো দেখবেন দশ-এগারো টাকা হয়ে গেছে। তাই নগদ আশি টাকা দিয়ে দশ মন চাল কিনেছেন ডাক্তার কর্তা। ইতিমধ্যে কিশোরী খুড়া বললেন,—যাইতে-আইসতে দেড় দিন কইরা নদীর বুকে থাইকতে অইবো। প্রশান্তরে কইব্যা বন্দুক নিতে, আর টোটা যানি বেশি কইরা নেয়। প্রশান্ত রায় ডাক্তারকর্তার শ্যালক। দুঃসাহসী শিকারী। গত পাঁচ বছরে শ’দুয়েক বুনো শুয়োর আর একজোড়া গুলবাঘা মেরে তিনি গ্রামীণ মানুষের চলার পথের আতঙ্ক দুর করে ‘হিরো’ হয়েছেন। কিশোরী খুড়ার কথায় ডাক্তারকর্তা হাসলেন। বললেন, ‘চিন্তা কোইরবেন না খুড়া। কাতুলির চরের ডাকাইতরা আমারে ছুইবো না।

অলংকরণ দীপঙ্কর ঘোষ।

— ‘হ! ছুইবো আবার না! ডাকাইতের আবার কোনো ধম্ম আচে নাকি? কবে তুমি কার চিকিচ্ছে কোইরচ আর ওমনি অরা তোমারে ছাইড়া দিবো?”

ডাক্তারকর্তা মৃদু হাসলেন। কিশোরী খুড়া তাঁর সমবয়সী। বছরে দু’তিনবার তাঁরা দুজনে একসঙ্গে জেলা কোর্টে জুরি হয়ে যান। যাতায়াত, থাকা-খাওয়া, মামলা সংক্রান্ত বুদ্ধিপরামর্শ— সব একসঙ্গে। পরস্পরকে তাঁরা খুব ভাল করেই চেনেন এবং ভালও বাসেন। খুড়ার দুশ্চিন্তার কারণটা উপলব্ধি করে ডাক্তারকর্তা বললেন,—“ঠিক আচে। আমি প্রশান্তরে কোইয়্যা রাখুমনি খুড়া। চিন্তা নাই।

কাতুলির চরের অধিবাসীদের প্রকাশ্য জীবিকা দুধ বিক্রি। পোড়াবাড়ির বাজারে দৈনিক যে দুধ আমদানি হয় তার অনেকটাই আসে কাতুলি থেকে। কোনওদিন সে দুধ ভেজাল বলতে পারেনি কেউ। পোড়াবাড়ির বিখ্যাত চমচম তৈরির ওস্তাদ কারিগর কোকন ময়রা প্রধানত এই দুধের ছানা দিয়েই চমচম বানায়। পোড়াবাড়ি গ্রামের সঙ্গে সম্পর্কিত হাজার হাজার আত্মীয়-অনাত্মীয় ব্যক্তি এই চমচমের স্বাদে মুগ্ধ। কিন্তু তাঁরা কেউ তেমন ভাবে চেনেন না কাতুলির লোকেদের, যেমন চেনেন ডাক্তার কর্তা। কোইচ্যা দ্যাওয়ান যদি কাতুলির বাদশা, ডাক্তারকর্তা তবে কাতুলির শাহেনশা। যদিও বাদশা কিংবা শাহেনশা বলে সেখানে কেউ তাদের ডাকে না। কলকাতা থেকে ডাক্তারি পাশ করে গ্রামের মানুষের চিকিৎসায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন সর্বেশ্বর। আত্মসুখ বিসর্জন দিয়ে, পারিবারিক অনটন উপেক্ষা করে, তিনি গরিব মানুষের চিকিৎসায় সর্বদা তাঁদের সঙ্গে থেকেছেন। এই প্রত্যন্ত গ্রামে কোথায় ঔষধ, কোথায় চিকিৎসার সরঞ্জাম, কোথায় উপযুক্ত পথ্য! তবু সপ্তরথী-বেষ্টিত অভিমন্যুর মতই সর্বেশ্বর সর্বশক্তি দিয়ে লড়াই করছিলেন ম্যালেরিয়া, কালাজ্বর, বসন্ত, কলেরা, টাইফয়েড আর অন্যান্য অজস্র রোগব্যাধির সঙ্গে। প্রথমে তিনি হেঁটে রোগী দেখতে যেতেন, তারপর ঘোড়ায়, অতঃপর ইদানীং সাইকেলে। ক্রমেই দূর-দূরান্ত থেকে তাঁর ডাক আসতে শুরু করেছে। এমনি ভাবেই এক গভীর রাতে কাতুলি থেকে বাইশ বৈঠার এক ছিপ নৌকা নীরবে এসে ভিড়েছিল বকুলতলার ঘাটে। জনা-ছয়েক বলিষ্ঠ পুরুষ সড়কি আর পাঁচ ব্যাটারির টর্চ হাতে নিয়ে লাফিয়ে নেমেছিল নৌকা থেকে। সতর্ক ভাবে তারা চলে এসেছিল ডাক্তারকর্তার বাড়িতে। বৈঠকখানায় তখন ঘুমে অচেতন জনা দশেক কিশোর ছাত্র। আগন্তুকদের মধ্য থেকে দু’জন এগিয়ে গিয়েছিল ডাক্তারকর্তার শোবার ঘরের দিকে। দরজায় টোকা দিয়ে ফিসফিস করে ডেকেছিল—“ডাক্তার সাব, ডাক্তারসাব।

সর্বেশ্বর সাহসী-পুরুষ। ব্যায়াম করা পেটা শরীর। সাড়া দিয়ে বলেছিলেন, —কে রে? —“আমরা কর্তা, কাতুলির চর থিক্যা আইচি।’’

—‘কাতুলির চর?’ সর্বেশ্বর থমকেছিলেন। শুনেছেন, ওখানকার লোকেরা নাকি ইদানীং ডাকাতি-ফাকাতি করছে। হ্যারিকেনের পলতেটা উসকে দিয়ে, দরজার পাশ থেকে তেলপাকা লাঠিটা হাতে তুলে নিতে নিতে বললেন—“কি চাই?’

—“কর্তা, আমাগো বড়ো বেপদ। ওলাউঠায় ধইরচে তিন চাইর জনেরে। আপনে আমাগো সাথে চলেন কর্তা। অগো বাঁচান।’’ লাঠিটা আবার দরজার পাশে রাখতে রাখতে সর্বেশ্বর বললেন— ‘‘যা, বাইরবাড়ি থিক্যা অনাদিরে ডাইক্যা আন।’’ হাঁকডাকে শুধু অনাদি নয়, উঠে পড়েছিল পুরো পড়ুয়ার দল। তারপর হ্যারিকেন আর টর্চের আলোয় খোঁজাখুঁজি টানাটানি করে বের করে আনা হলো ডি ওয়াল্ডি কোম্পানির দশ গ্যালন মাপের দুটো চিনামাটির জার। ওতে সর্বদাই বৃষ্টির বিশুদ্ধ জলে লবণ মিশিয়ে স্যালাইন ওয়াটার তৈরি করে রাখেন সর্বেশ্বর। কাতুলির জওয়ানেরা সে দুটো কাঁধে করে তুলে নিয়ে গিয়েছিল নৌকায়। আর অন্যান্য সরঞ্জাম ভর্তি বাক্সটা নিয়েছিল অন্য একজন। ডাক্তারকর্তা শার্টের ওপরে শক্ত করে মালকেঁচা দিয়ে কাপড় পরে, চাদরটা, পাগড়ির মত করে মাথায় জড়িয়ে, স্টেথো আর কুকুরলাঠিটা হাতে তুলতে

তুলতে স্ত্রীকে বলেছিলেন,—“আমার হয়তো ওখানে দুই চাইর দিন থাইকতে অইবো। চিন্তা কোইরো না। দরকার হোইলে ধীরুকে খবর দিও।

কলেরার চিকিৎসায় ডাক্তারকর্তার খুব সুনাম। তিনদিন কাতুলির চরে থেকে মোট চারজন কলেরা রোগীকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে ফিরিয়ে আনলেন তিনি। তাদের মধ্যে একজন স্বয়ং কোইচ্যা দ্যাওয়ানের মা। তখনো কোইচ্যা দলের সর্দার হয়নি। ডাক্তারকর্তা কাতুলি থেকে ফিরে এলেন প্রচুর শ্রদ্ধা, কৃতজ্ঞতা আর মর্যাদা নিয়ে। কাতুলির লোকেরা তাঁর ঘরে পৌঁছে দিয়ে গেল দুধ, মাছ আর টাটকা শাকসবজি। তারপর থেকে প্রতিবছরই ডাক্তারকর্তাকে কাতুলির চরে যেতে হয় কলেরা রোগীর চিকিৎসার জন্য। প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে কলেরা ভ্যাকসিন দেবার কোনও ব্যবস্থাই করা সম্ভব ছিল না সেই সময়ে। সুতরাং এই কালব্যাধি মানুষের অজ্ঞতাকে বাহন করে অনেক সময়েই ডাক্তারকর্তাকে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে চ্যালেঞ্জ জানাত।

বাজারে দুধ বেচতে এসেছিল মাসুদ। ডাক্তারকর্তার ছেলেদের বিয়ের সংবাদ সে-ই পৌছে দিয়েছিল কোইচ্যাকে। কোইচ্যা বলে দিয়েছিল, ডাক্তারবাবুর পানসীগুলোর ওপরে যেন সাদা নিশান তোলা থাকে আর রাতে যেন হ্যাজাক জ্বেলে রাখা হয়। তিন দিনের নদীপথে কোইচ্যার নির্দেশ মানা হয়েছিল যথাযথ, কিন্তু কোথাও কোইচ্যার ছিপ চোখে পড়েনি।।

ভাদ্রের ভরা দরিয়ায় এরফান সাহেবের দুখানি হাজারমনি নৌকা পর পর লুঠ হয়ে গেল ঢালানঘাটের ভাটিতে। এরফান সাহেব আমিনুর দারোগাকে এজাহার লিখিয়ে খুব ঠান্ডা গলায় বললেন—এ ব্যাপারে মিঞাভাইয়ের এন্তেজামের যে কোনরকম গাফিলতি নাই হেডা তো আমারে কোইতে অইবো না। তবে হেদিন কেডা জানি কোইতে আচিলো—আশকারা পাইয়া থানার কনস্টেবলেরা নাকি অ্যাহোন দারোগারও মাথায় উইঠপ্যার চায়। এডা ভালো কতা না। আপনের কোন তকলিপু অইলে কন, আমি মিলিটারি আনামু। তো, এরফান মিঞার তদ্বিরের জোরেই শেষ পর্যন্ত মিলিটারি ক্যাম্প বসল ফয়তাপুরের কাছারি বাড়ির মাঠে। মেহেরবান সরকার বাহাদুরের নেকনজর খিদমতগার বান্দার ওপরে সততই বিরাজমান।

যারা এতদিন ফ্যান, পান্তাভাতের জল, সাদা আলু সেদ্ধ, গেড়ি-গুগলি আর শাপলা-শামুক খেয়ে খেয়ে হাড় আর চামড়ার মধ্যবর্তী মাংসপেশীগুলোকে নিঃশেষ করে ফেলছিল, রবাহুত অসংখ্য তারা এবার কালো পিঁপড়ের মত কোথা থেকে যেন সার বেঁধে বেরিয়ে এলো বাজারের পিছনের মাঠে, ত্রিপলে ঢাকা চালের বস্তাগুলোর পাশে, লঙ্গরের লপসি খাবার লোভে। গ্রামের মুরুব্বিদের অনুমতি আগেই নিয়েছিলেন এরফান সাহেব, সহযোগিতা আর তদারকের কাজেও এগিয়ে এসেছিলেন বেশ কয়েকজন সম্পন্ন ব্যক্তি। সুতরাং কোমরে গামছা বেঁধে কাজে নামল ক্লাবের কিশোর কর্মীরা। রান্না থেকে শুরু করে পংক্তিভোজন করানো, আর যাঁরা প্রকাশ্য পংক্তিতে বসে খাওয়ার সংকোচ থেকে মুক্ত হতে পারেননি, বালতিতে করে তাঁদের ঘরে ঘরে লপসি পৌছানো, তারপর ধোয়ামোছা, গোছগাছ, সে এক মহাযজ্ঞ। এই মহাযজ্ঞে ধর্মভেদ, জাতিভেদ এক ফুয়ে উধাও। ব্রজ চক্রবর্তী আর লালমিঞা দেখা গেল পরিবেশনে সমান ওস্তাদ। জীবন, ক্ষুধা আর মৃত্যু যেন ব্রহ্মা, বিষ্ণু আর মহেশ্বর। এখানে এখন তারা যেন একই মঞ্চে এসে দাঁড়িয়েছেন। অনাহারজনিত কারণে ইতিমধ্যে যে ক’জনের মৃত্যু হয়েছিল, তাকে এবার বহুগুণে ছাড়িয়ে গেল রোগগ্রস্ত হয়ে মৃত্যুর পরিমাণ। রক্তআমাশয়, উদরাময়, কলেরা, ডুপসি, টাইফয়েড, কালাজ্বর, ম্যালেরিয়া—ডাক্তারকর্তার বিশ্রাম নেই, ঘুম নেই। সঞ্চিত স্যালাইন ওয়াটার শেষ হয়ে গেলে, বড়ো বড়ো হাঁড়িতে জল ফুটিয়ে, তিনপরত ব্লটিং কাগজে ছেকে, নুন মিশিয়ে আবার জারগুলো ভরে নেন তিনি। বুধা কম্পাউণ্ডার ছাড়াও এবার তাঁকে সাহায্য করতে এগিয়ে এল গ্রামের কয়েকজন স্বেচ্ছাব্রতী তরুণ। পোস্ট অফিস থেকে যতটা সম্ভব কুইনাইন আর মেফাক্রিন ট্যাবলেট সংগ্রহ করা হল। টাঙ্গাইলের রায় ফার্মেসি থেকে পাওয়া গেল কিছু শিবাজল, এন্টারোকুইনল, সালফাগুয়াডিন ট্যাবলেট, কিছু ব্লিচিং পাউডার আর পটাশিয়াম পারমাঙ্গানেট, ব্যস! এইটুকু মাত্র সম্বল করেই ডাক্তারকর্তা, ডন কুইকজোটের উইণ্ডমিলের সঙ্গে ডুয়েট লড়ার মত, লড়াইয়ের ময়দানে অকুতোভয়।।

ইতিমধ্যে মিলিটারি লঞ্চ তোলপাড় করছে যমুনার জল। জগন্নাথগঞ্জ ঘাট থেকে এলাসিন— এই দীর্ঘ জলাঞ্চল জুড়ে চলছে নিগ্রো সেনাদের উচ্ছ্বসিত জলবিহার। উদ্দেশ্য, ডাকাতদলকে খুঁজে বের করে নিকেশ করা। প্রকৃতপক্ষে দিনের বেলায় তারা মালবাহী নৌকাগুলোকে খানিকটা এসকর্ট করলেও, গভীর রাতে ডাকাতদের পশ্চাদ্ধাবন করার দুঃসাহস দেখায়নি। সুতরাং কোইচ্যা দ্যাওয়ান যথা পূর্বং তথা পরং।

একদিন কিশারী খুড়া বললেন, ‘‘সর্বেশ্বর, প্রসন্নর কাছ থিক্যা গত মাসে বিশ টাকা কোইরা যে কয় বস্তা রেশনের চাইল কিন্যা রাকচিলাম, অ্যাহোন ব্ল্যাকে আশি টাকা মন দাম দিব্যার চায়। বেচুম?’’ ডাক্তারকর্তা কিছুক্ষণ স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন খুড়ার মুখের দিকে। তারপর হেসে ফেললেন। বললেন, “আপনে আর কোনোদিন জুরিতে যাইয়েন না খুড়া। আপনেরে আসামীর কাঠগড়ায় খাড়া করাইলে আমি তো আপনেরে ফাঁসির হুকুম দিমু। গম্ভীর হয়ে কিশোরী বললেন,—তাইতো দিব্যা। আর এরফান মিঞা যে শাঁখের করাত দিয়্যা বটগাছগুলারে কাইট্যা নামাইতেছে। তারে ক্যারা কি কয়? বিরস মুখে ডাক্তারকর্তা বললেন,—“আপনে জুরি’ না অইলে আপনেরেও কিছু কওনের আচিলো না।

বিকেলে কিশোরী এলেন এরফানের গদিতে। এরফান লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,—“আদাব চাচা, আদাব। আপনে নিজে ক্যা কষ্ট কোইরা আইলেন আমার গদিতে? বান্দারে এত্তেলা দিলেই অইতো। আরে নরু, চাচারে তামুক দে।’’ নরু রূপাবাঁধানো হুঁকোটা নামিয়ে ভালো করে ধুয়ে, জল পাল্টে তামাক সেজে এনে দিলে, কিশোরী চোখ বুজে আমেজ করে তাতে দুটো টান দিয়ে বললেন,—“তাইলে, চাইল সব পাচার কোইরা দ্যাওনের কামে কোনো অসুবিদ্যা তো অয় নাই?’’ এরফান দু’হাতে দুই কানের লতি ছুঁয়ে জিব কেটে বললেন,—“তওবা তওবা। এডা কি কোইলেন চাচা? আমি সরকারি ঠিকাদার। মিলিটারিরে চাইল ডাইল নুন ত্যাল….।’’ ডান হাতে হুঁকো থাকাতে বাঁ হাতখানাই কিশোরী বরাভয় মুদ্রায় তুলে ধরলেন এরফানের নাকের সামনে। হুঁকো থেকে মুখ তুলে বললেন, ‘‘হঃ! ইডা তো হক কতাই। তুমি সরকারেরে মাল দ্যাও, আন্দারে ব্যাচো, আবার ছারপোকা খাওয়াইয়া বেহস্তে যাওনের পাকা ব্যবস্তাও কইরা রাখো। ঠিকই তো। ঠিক কামই কোইরতাচো।’’ স্পষ্টতই বিচলিত এরফান কৈফিয়ত দেবার ভঙ্গিতে বললেন,—“আমাগো তো চাচা আমদানি-রপ্তানি। মাল আইতাচে, মাল যাইতাচে। কতো মাল আসে, কতো মাল যায়, সরকারের ঘরে তো তার হিসাব থাকে। তাছাড়া, পোলাপানের খ্যালার মাঠটা অনেকদিন আটকা আচিলো, অগো দিকটাও তো দ্যাহোন লাগে। তাই দিলাম খালি কোইরা।

—ভালো কোরচ, খুবই ভালো কোরচ। তা তোমার ওই লঙ্গরখানার জন্য। কত খরচ অইতাচে?

—না, লঙ্গরে আর আমার খরচ কি? আল্লার দোয়ায় আমার কতো চাইল নষ্টো অইয়্যা যায়! কতো ইন্দুরে বান্দোরে খায়। দুইখান হাজারমনি নৌকা তো ডাকাইতে লুইট্যা নেলো। তাতে আর কি অইচে? রোজ আধমন কোইরা চাইল আমি দিতাচি লঙ্গরে। যতীন চাচা দুই বস্তা খেসারির ডাইল দিচে। প্রসন্নো চাচা তিন বস্তা চাইল দিচে, রিদয় কর্তা, ডাক্তারকর্তা আর আপনেও তো রোজ কিছু না কিছু দিতেই আচেন। কতায় আচে না – দশে মিল্যা করি কাজ! তা ভালো কতা। আপনেও তো হুইনচি কিচু রাখি কোরছিলেন, আচে, না ছাইড়া দিচেন?’’

—নাঃ। কিশোরী খুড়া হুঁকোটা নরুর দিকে এগিয়ে দিলেন। নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন,—“ছাইড়ব্যার যাইয়্যাও ছাইড়বার পাইরলাম না। রাইমোহন আশি টাকা মন দাম দিচিলো। তো, সর্বেশ্বর কইলো, ও যদি জজ অইতো, তাইলে নাকি আমারে ফাঁসিতে লটকাইতো। একথা হুইন্যা তোমার চাচি কোইলো, ও পাপের চাইল তুমি পুণ্যের কামে লাগাও। সব চাইল লঙ্গরখানায় দিয়্যা দ্যাও। তা দিমুনে পাঠাইয়্যা।

এরপর দু’জনেই চুপ-চাপ। চেতনার গভীরে ডুব দিয়ে দু’জনে মনই এখন সুমতি-কুমতির সওয়াল জবাবে জেরবার।

দুপুরে দুধের বাজারে একটা চাপা উত্তেজনা দেখে বাউল দত্ত তার বেনেতি দোকান থেকে বেরিয়ে মাসুদকে সামনে পেয়ে বলল, “কিরে মাসুদ! অরা কি ফিসুর ফুসুর কোইরতাচে?’’ মাসুদ দ্রুত চারধারে চোখ বুলিয়ে নিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘‘কাউরে কোইয়ো না চাচা, হুইনতে আচি কোইচ্যা নাকি মিলিটারির হাত কাইট্যা নিচে। দোকান বন্দ কোইরা বাড়িৎ যাও। হুজ্জোৎ হোইব্যার পারে।’’ পলকে সারা বাজারে রটে গেল কথাটা। দোকানপাট দ্রুত বন্ধ হতে থাকল। ইতিমধ্যে থানা থেকে ৮/১০ জন লাল পাগড়ি পুলিশ পৌঁছলো হাটখোলায়। থানার দারোগা আমিনুর হোসেন সাইকেলে চেপে এরফান মিঞার গদির সামনে এসে নামলেন। এরফান হাঁক দিলেন— ‘‘নরু, নরু কোতায় গেলিরে? দারোগা সায়েবেরে তামুক সাইজা দে তাড়াতাড়ি।’’ আমিনুর বারান্দা থেকে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন,  “আচ্চালাম আলাইকুম। এরফান বললেন, “আলাইকুম উত্সালাম। আহেন, আহেন, ওই চেয়ারডায় বহেন। তামুক খান। জিরান এটটু। ওরে নরু….।’’ নরু হুঁকোর মাথায় কল্কে বসিয়ে তাতে ফুঁ দিতে দিতে এগিয়ে এসে আমিনুরের হাতে হুঁকো তুলে দিলে, এরফান সামনে রাখা কাঠের ক্যাশ বাক্সটার ডালা তুলে একটা পঞ্চম জর্জ মার্কা রুপোর আধুলি বের করে। নরুর হাতে দিয়ে বললেন,—“কোকনের দোকান থিক্যা চাইরহান চমচম নিয়্যা আয়।’’ নরু চলে গেলে আমিনুর হুঁকোয় একটা সুখটান দিয়ে বললেন,—“মিঞাবাই, ইবারে আপনের কারদানিটা একটু দ্যাহানের সময় অইচে। এরফান বললেন-‘খোলসা কোইর্যা কন। আমিনুর বললেন, “আপনে তো বেহুদা এজাহার ল্যাখাইছিলেন, আপনের-দুইহান হাজারমনি নাও কোইচ্যা দ্যাওয়ান লুট কোইরা নিচে। তাই আপনে ডি.এম-এর কাচে মিলিটারি প্রোটেকশন চাইছিলেন। আপনের আর্জিমাফিক ফয়তাপুরের নায়েব কাছারির মাঠে মিলিটারির ক্যাম্প হইচে। পরশু রাইতে কোইচ্যার সাথে মিলিটারির এনকাউন্টারের সময় দুই-চারজন ডাকাইত গুলিতে জখম অইচে। এদিগে ডাকাইতের গুলিতে এক মিলিটারিও বেজায় জখম অইচে। তার রাইফেল জলে পইরা তলাইয়্যা গ্যাচে। এই ব্যাপারে এসডিও সায়েব আমারে তলব কোইরছিলেন। তাঁর হুকুম হইলো, যেমুন কোইরা পারো কোইচ্যারে ধরো। আমি সাত দিন দেহুম। তারপরে পুলিশের উপর অ্যাকশন নিমু। তাই আপনের কাচে আইলাম। কথাডা য্যান গোপন থাকে। আইজ রাইতেই কাতুলির চরে আর আশপাশে, পুলিশ আর মিলিটারির জয়েন্ট অ্যাকশন শুরু অইবো। আপনে মেহেরবানি কোইরা আমার ৮/১০ জন পুলিশেরে আপনের গদিতে একটু লুকাইয়্যা রাখার ব্যবস্থা কোইরা দিবেন। নরুরে কোইবেন অগো যানি একটু তদবির তদারকি করে। গভীর রাইতে ওরা নৌকায় উইঠ্যা কাতুলি যাইবো।’’ এরফান বললেন,—“জনাবের যদি তাতে সুবিধ্যা হয়, তাইলে আইচ্ছা।’’

কোকন ময়রার চমচমের তুলনা নেই। শুকনো ক্ষীরের গুঁড়োয় জড়ানো যেন এক এক টুকরো মৌচাক চাপ দিয়ে ভাঙলে দেখা যাবে ভেতরে মৌচাকের মত সমঞ্জস ছিদ্রগুলো টসটসে মধুর মত ঘন মিষ্টি রসে টই-টম্বুর। মুখে রেখে চাপ দাও। সমস্ত মুখগহ্বর আর খাদ্যনালী জুড়ে অমৃত! অমৃত! আমিনুর অর্ধেক চমচম মুখে পুড়ে চোখ বুজলেন। তাঁর বাঁ হাতের আঙুলের ডগায় ধরা মাটির মালসাটাতে আরো সাড়ে তিনখানা জ্যান্ত চমচম। নরু কুজো থেকে কাচের গ্লাসে জল ভরে এনে হাতে ধরে… দারোগা সায়েবের রসিয়ে রসিয়ে চমচম খাওয়াটা খুব মনোযোগ দিয়ে দেখল। তার মনে হল, জল সুদ্ধ গেলাসটা দারোগার মাথায় ছুঁড়ে মারলে কেমন হয়? কিন্তু পর মুহূর্তেই সে নিজেকে সামলে নিল। মনে মনে ‘তওবা তওবা’ বলে নিজের কুমতিকেই বোধ হয় গালি দিল ‘শালা ইবলিসের বাচ্চা’।

সারারাত ঘামাসান লড়াইয়ের পর সংযুক্ত বাহিনী কাতুলি আর তার আশপাশের এলাকা থেকে যে কয়েকজন পুরুষকে ধরে এনে পুলিশের হেফাজতে দিয়েছে, তাদের মধ্যে প্রতিটি বলিষ্ঠ লোককেই কোইচ্যা বলে সন্দেহ হলেও, আসল কোইচ্যার দিকে তাদের আদৌ নজর পড়েনি বরং মনে হয়েছে এ ছোকরা বড়জোর কোইচ্যার একজন খিদমতগার হলেও হতে পারে। ফয়তাপুরের নায়েব কাছারির উঠানে সবগুলো ডাকাতকে একটা মোটা বড় দড়ি দিয়ে কোমর বেঁধে সারিবদ্ধ ভাবে বসিয়ে রেখে, আমিনুর দারোগা একটা পাসিং শো সিগারেট ধরিয়ে বাঁকা-বিহারীটি হয়ে দাঁড়িয়ে, বঙ্কিম দৃষ্টিতে ওদের নিরীক্ষণ করতে লাগলেন। সকালের সূর্য তখন দিগন্তের একলগি ওপরে উঠেছে। রাস্তার ধারের গাছপালাদের ছায়াগুলো লম্বা হয়ে মাঠের ওপর শুয়ে শুয়ে খুব আস্তে আস্তে ছোট হয়ে যাচ্ছে। আমিনুর পোড়া সিগারেটটায় একটা সুখটান দিয়ে টুকরোটা ছুঁড়ে ফেলে, আট কদম এগিয়ে এসে, সবচেয়ে বলিষ্ঠ লোকটার চুলের মুঠিতে একটা হ্যাচকা টান দিয়ে বললেন, “তগো মধ্যে কোইচ্যা ক্যাডা? তুই?’’ হঠাৎ আক্রমণেও নির্বিকার লোকটা মাছের মত ঠান্ডা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,—“জী।’’ আমিনুর চুলের গোছা ধরে তাকে টেনে তুলে বুটসুদ্ধ পা দিয়ে তার পাছায় কষে একটা লাথি হাঁকিয়ে বললেন,—“হুম্ ! তুইই তাইলে আসল মাল?’।

—‘‘না। ও কোইচ্যা না। আমি কোইচ্যা। কোইচ্যা দ্যাওয়ান।’’ আমিনুর দারোগা চোখ কুঁচকে দেখলেন সেই রোগা পটকা লোকটা উত্তেজিত হয়ে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করছে। কত হবে ওর বয়স ? চব্বিশ, ছাব্বিশ, আটাশ? কালো হিলহিলে চেহারা।

কালচে শ্যাওলার মত হালকা গোঁফ-দাড়িতে মুখটা আরো কালো দেখাচ্ছে। চোখ দুটো উজ্জ্বল, ঝকঝকে দাঁত— এইটুকুই যা দেখবার। আমিনুর সাহেব চোখ কুঁচকে রেখেই তিন চার হাত এগিয়ে এসে লোকটির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললেন— ‘‘তুই? কোইচ্যা ? তুই?’’ লোকটা বলল,—“জী হুজুর, আমিই কোইচ্যা, বাজানের নাম চেরাগ আলি দ্যাওয়ান, হাল সাকিন….।’’—‘‘হুম!’ আওয়াজ করে আমিনুর দারোগা আচম্বিতে একটা আধমনি ঘুসি হাঁকালেন কোইচ্যার নাক বরাবর। চকিতে কোইচ্যা নিচু হতেই আমিনুর হুড়মুড় করে পড়লেন তার কাঁধের ওপরে। কোইচ্যা অধিকতর পতনের হাত থেকে আমিনুরকে বাঁচিয়ে, ঠেলে দাঁড় করিয়ে দিতেই পুলিশ এবং ডাকাতদের সম্মিলিত হাসির একটা চাপা তরঙ্গ আমিনুরের কানে যেন তরল আগুন হয়ে ঢুকল। তবু তিনি নিজেকে সংযত করে হাবিলদার শিবু সরকারকে বললেন,—“আসামিগো ওঠাও। থানায় নিয়্যা চলো।’’ শিবু তার বেটন দুলিয়ে ডাকাতদলকে দাঁড় করাল। তাদের সামনে, পেছনে এবং দুই পাশে দশজন কনস্টেবল পজিশন নিল। আমিনুর বললেন,—“চলো।’’ দড়িতে টান পড়ল। সবাই চলতে উদ্যত। কিন্তু রুখে দাঁড়াল কোইচ্যা। —‘‘আমি যামু না। কিছুতেই যামু না’’— সে চেঁচিয়ে উঠল। আমিনুর নিজেকে অতি কষ্টে সংযত করলেন। ইতিমধ্যে রবাহুত লোকজন এবং পড়ুয়া কিশোরদের ভিড় জমেছে ডাকাত দেখার জন্য। গ্রামের চার-ছয় জন মোড়ল মুরুব্বিও এসেছেন। নায়েব সেরেস্তা থেকে দু’চারজন গোমস্তা খানসামাও এসেছে। এদের সামনে মাথা গরম করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না, এটা বুঝেই শান্তকণ্ঠে তিনি বললেন, ‘‘যাবিন্যা মানে? ডাকাইতের সর্দার অইচস, পুলিশের হাতে ধরা পইরা কস থানায় যাবিন্যা? মামাবাড়ির আব্দার! নে, চল।’’ কোইচ্যা তেমনি জেদি ঘোড়ার মত ঘাড় বেঁকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আমিনুর ঠান্ডা গলায় বললেন,—“ভালো চাস তো ওঠ কচিমুদ্দি। থানায় চল।’’ কোইচ্যা বলল, “আমারে থানায় নিতে অইলে জুতা কিন্যা দিতে অইবো। আপনের নাগাল বুটজুতা। আপনের মান আছে, আমার মান নাই?’’ চারদিক থেকে হাসির রোল উঠল। হাসবেন না কাঁদবেন আমিনুর? দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,—“এহানে অ্যাহোন তুই জুতা পাবি কনে? থানায় চল। টাঙ্গাইলের দোকান থিক্যা কিন্যা দিমু।’’ কিন্তু কোইচ্যা তাতে রাজি নয়। সে তার দলবল নিয়ে আবার মাটিতে বসে পড়ে। অনেকটাই যেন অসহযোগের ভঙ্গিতে। শিবু সরকার বেটন তুলে তাদের দিকে ধেয়ে গেলে কোইচ্যা বলে,—“আমাগো মাইরা ফেলাইলেও এহান থিক্যা উঠাইতে পাইরবেন না দারোগা সায়েব।” ডাকাতের দল গুটিশুটি মেরে মাটি আঁকড়ে শুয়ে পড়ে। এবারে আমিনুর কোইচ্যার চুলের গোছা ধরে হ্যাঁচকা টান দেন। এমন সময় কৌতূহলী জনতার মধ্য থেকে ফয়তাপুর মসজিদের ইমাম কুদ্দুস সাহেব এগিয়ে এসে বলেন,—“থামেন দেহি দারোগা সায়েক। মাইর ধোইর কোইরা যদি কিছু অইতো, তাইলে গান্ধী আর গান্ধীজি অইতো না। আপনের মারনের কাম কি? তার থিক্যা এক জোড়া জুতা আনাইয়্যা দিয়া আসামিগো থানায় নিয়্যা যাওন যায় না? নায়েব মশয় আসুক, আমি কোইলে জুতার দাম নায়েব মশয়ই দিয়া দিবো।’’ আমিনুর দীর্ঘক্ষণ তীব্র দৃষ্টিতে কুদ্দুস সায়েবের দিকে তাকিয়ে থেকে নিজেকে দমন করে বললেন, ‘‘ঠিকাছে, আপনের যখন খায়েশ অইচে জুতার দাম নায়েব মশয়ের দিতে অইবো না। আসামির সব খরচ সরকার বাহাদুরই দিবো।”

ফয়তাপুর থেকে টাঙ্গাইল— জেলা বোর্ডের রাস্তায় তিন মাইল পথ। আমিনুরের কাছ থেকে টাকা আর নায়েব সেরেস্তা থেকে একটা সাইকেল নিয়ে কনস্টেবল নূর আলম এক ঘণ্টার মধ্যেই এক জোড়া ঝাঁ-চকচকে বুট জুতা কিনে আনলে, ঠেসে ঠুসে সে দু’টোর ভেতরে পা ঢোকাল কোইচ্যা। ফিতে না-বাঁধা অবস্থাতেই একটু টাইট হলো পায়ে। তরুণ ডাকাত সর্দার তাতেই বেজায় খুশি। জুতা পায়ে সোজা দাঁড়িয়ে এবার সে আমিনুর দারোগাকেই হুকুম করল— ‘‘চলেন দেহি দারোগা সাব। জোর কদমে হাঁটা লাগান।’’

কাবিলাপাড়া আর সন্তোষ স্কুলের ছাত্ররা তখন স্কুলের দিকে হাঁটছে। হাইলচা গাঁথা ডাকাতের দল আর প্রহরী পুলিশদের দেখে, তাদের আর পথচারীদের উত্তেজনার অন্ত নেই। তারা বিশৃঙ্খল ভাবে হেঁটে ওদের অনুসরণ করছে। রাস্তার ধারের বাড়িগুলো থেকেও ছুটে আসছে অগণিত মানুষ। অনুসরণকারীদের দল ক্রমেই বড় হচ্ছে। এখন গাছের ছায়া আর প্রলম্বিত নয়। রোদ উঠেছে। এত লোকের চলাচলে পথে ধুলো উড়ছে।

পুরু ক্রোম চামড়ার বুট জুতায় কোইচার পায়ে ফোস্কা পড়েছে। সে বেশ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে। প্রথমে ফোস্কা ভেঙে রস এবং তার পরে ক্ষতবিক্ষত পা থেকে রক্ত চুইয়ে পথের ধুলোর সাথে মিশে পা আর জুতার মধ্যে চটচটে আঠার মত লেপটে থাকছে। তবু কোইচ্যা নির্বিকার। হাঁটতে খুব কষ্ট হচ্ছে কিন্তু সে তা গ্রাহ্যই করছে না। তার চোখেমুখে এক গর্বিত আত্মশ্লাঘা খেলে বেড়াচ্ছে। এত কষ্টের মধ্যেও তার দিলচসপি একটাই। বাগে পেলে সে এখন বুটজুতা পরা পা দিয়ে আমিনুর দারোগার পাছায়ও একটি লাথি মেরে দিতে পারবে। যেমন করে আমিনুর লাথি হেঁকেছিল বসিরের পাছায়।

কল্পনায় দৃশ্যটি দেখে কোইচ্যার ঠোঁটের কোণে হাসি উপচে ওঠে। জুতার ভেতরে ক্ষতবিক্ষত পায়ের কথা তার আর একদম মনে থাকে না।