শুভঙ্কর চট্টোপাধ্যায়

 

খুট!

হঠাৎ করে ঘুমটা ভেঙে গেল। হ্যাঁ, ওই তো! ওই তো শব্দটা! বিশ্রী একটা গন্ধ ভেসে আসছে। ঘরের কোথাও ইঁদুর মরেছে বোধহয়। জানালাটা একটু খুলে দিলে হত। গা গুলাচ্ছে। একবার বাথরুমে যাওয়া দরকার। কিন্তু উঠতে ইচ্ছা করছে না। এইসব রাতের গায়ে কালি লেগে থাকে। ঘন, কালো আঠার মত এক কালি… বিষাক্ত, নির্জন, বহু আগে মুছে যাওয়া নরম স্পর্শের রঙের। বাইরে হাওয়া দিচ্ছে। ডালপালাগুলো দুলছে। ছায়া এসে পড়ছে কাঁচে। জানালার দিকে চোখ চলে গেল। চুঁইয়ে আসা স্ট্রিটলাইটের হালকা আলোয় বিষণ্ন লাগছে ঘরটাকে। দমবন্ধ, তটস্থ একটা নগ্ন, আদিম বিষণ্নতা নেমে আসার সময় এসেছে। অকারণেই মনখারাপ করছে খুব। আজকাল বড্ড মনখারাপ করে অনির।

পাশের রাস্তাটা যেখানে মোড়ের মাথায় মিশেছে, সেদিক থেকে একটা আওয়াজ ভেসে আসছে। দুম দুম দুম দুম! নিস্তব্ধতা ছিঁড়ে যাচ্ছে সেই আওয়াজে টুকরো টুকরো হয়ে। দরজা ধাক্কানোর আওয়াজ? কাদের বাড়িতে লোক এলো এত রাতে? এতজোরে ধাক্কা দিচ্ছে কেন? একরোখা একঘেঁয়ে খাপছাড়া কতগুলো দুম দুম শব্দ। অবশ্য অনেকসময় হাওয়া উঠলে গাছের ডালপালা অনেক রকম উদ্ভট শব্দ তৈরি করে এখানে সেখানে ধাক্কা খেয়ে। ঝড়ের কোনওরকম পূর্বাভাস তো ছিল না সেরকম। আবার! আচ্ছা, শব্দটা হাওয়ায় ভাসছে বলে মনে হচ্ছে না? কাছে চলে আসছে একেবারে, আবার দূরে সরে যাচ্ছে অনেকটা। কিন্তু থামছে না। ওই তো! বিদ্যুৎ চমকালো। বৃষ্টি নামবে বোধহয়। তাহলে গাছের ডালের আওয়াজই হবে। অবশ্য পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। নাকি দরজাতেই ধাক্কা দিচ্ছে কেউ? এতো জোরে ধাক্কালে দরজা তো ভেঙে পড়ার কথা। কে এলো? এখনও সাড়া দিচ্ছে না কেন লোকজন? বাড়ির সবাই ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়েছে, নাকি অভিমান করেছে আগন্তুকের উপর? কে জানে! যত রাজ্যের ঝুটঝামেলা! আর একটু দেখা যাক, নাহলে উঠতে হবে। বৃষ্টি আসার আগে জানালা খুলে একবার দেখতে হবে ব্যাপারটা কি।

নাঃ! ঘুম আসবে না আর। আজকাল ঘুম একবার ভেঙে গেলে আর সহজে আসে না। অনেকক্ষণ একা একা অন্ধকারে দেওয়ালগুলোর দিকে তাকিয়ে জেগে থাকতে হয়। ফ্যানটা একটু কমিয়ে দিলে হত। ব্লেডের থেকে একটা ঝুল ঝুলে আছে। লম্বা হয়ে গোলগোল ঘুরে চলেছে অনবরত। কাল শনিবার, ঝাড়া যাবে না। দুম দুম দুম! আওয়াজটা এখন অনির খাটের পাশের জানালার গায়ে! বড্ড বড় হয়েছে গাছের দু একটা ডাল। গ্রিলের ফাঁকের মধ্যে দিয়ে ঘরে ঢুকে আসবে কদিন পরেই। হাওয়ার ধাক্কায় দুলছে ডালগুলো। ঘষাকাঁচের এপার থেকে দেখে মনে হচ্ছে যেন কেউ আঁকশি দিয়ে ধরে ঝাঁকাচ্ছে ওদের। লেবুগাছটায় ফল আসেনি এবারেও। কত শখ করে বসানো হয়েছিল গাছটাকে। ধুর! বিরক্তিকর এই রাতে ঘুম ভেঙে যাওয়া। মাথার মধ্যে আবোলতাবোল চিন্তা ঘুরপাক খায় শুধু। অন্ধকারে উদ্দেশ্যহীন ভাবে একটানা তাকিয়েও থাকা যায় না আবার শুধু শুধু চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকতেও ভালো লাগে না! ছোটবেলায় খাওয়ার পরে মেজকার পায়ের আওয়াজ পেলেই দুই ভাইবোন চট করে বিছানায় উঠে শুয়ে পড়ত আর চোখ বুজে ঘুমের ভান করত। চোখ বুজে থাকতে থাকতে কখন যে ঘুম এসে যেত! এখন আর অত সহজে ঘুম আসেনা। কি ভয় পেত ওরা মেজকাকে! কেন অত ভয় পেত ওরা মেজকাকে?

মনে হয় খাটের তলার থেকেই আসছে গন্ধটা। কিছু মরেছে নিশ্চয়ই। কালকে বুলাইয়ের মাকে বলতে হবে ভালো করে ঝাঁট দেওয়ার জন্য। এবার একবার না উঠলেই নয়। বাথরুমে যেতে হবে। আস্তে আস্তে চোখ খুললো অনি আর সাথে সাথে জমাট অন্ধকারটা জাঁকিয়ে বসল আরও। ফ্যান চললে রাতের দিকে বেশ ঠান্ডাঠান্ডা লাগে বছরের এই সময়টায়। তার উপরে বাইরে দমকা হাওয়া দিচ্ছে। এই হাওয়ার একটা খামখেয়ালি ছন্দ আছে। মাঝে মাঝে বাড়ে আবার একটু পরেই কমে যায়। চাদর গায়ের থেকে সরে গেছে। পায়ে ঠান্ডা লাগছে। রাত গভীর হয়েছে নিশ্চয়ই। আবার সেই আওয়াজ! বাইরের দরজায় ধাক্কালো কেউ? তবে এবার আর চমকে গেল না অনি। অনেক সয়ে এসেছে ব্যাপারটা। মনে হচ্ছে শব্দটার মধ্যে একটা বেশ কেমন অস্বাভাবিকতা আছে। দরজা সাধারণত ধাক্কালে যেরকম আওয়াজ হয়, এই শব্দটা ঠিক সেরকম না। বড্ড হালকা, যেন অনেক দূরের..আবার ভীষণ কাছের। হচ্ছেটা কি? আওয়াজটা কানে আসলেই মনে হচ্ছে যেন চরাচরে কেউ কোথাও নেই। সব ডুবে গেছে, নিভে গেছে, থেমে গেছে। অনুরণনে শুধু শূণ্যতা জাগিয়ে হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে এক এক করে আলোড়ন তুলছে, তারপর ডুবে যাচ্ছে কতগুলো শব্দ, কাছে থেকে দূরে। আর কি ওরা ফিরবে বৃষ্টি নামবে যখন? পুড়ে ছাই হয়ে গেছে পৃথিবী আর যেন ওই ছাইয়ের গাদার উপরে এলোমেলো দমকা হাওয়ার মাঝখানে দাঁড়িয়ে বাঁজা একটা লেবুগাছের ডালপালার সাথে মুছে যাওয়া অলৌকিক শব্দের হিসাবনিকেশ নিয়ে উত্তাল টানাহ্যাঁচড়া করছে অন্ধকারে নিজেই হারিয়ে যাওয়া একলা একটা মানুষ! আশ্চর্য!

একলা থাকার অভ্যাস হয়ে গিয়েছে অনির এত দিনে। প্রথম প্রথম ভীষণ ভয় করত। অফিস থেকে বেড়িয়ে কি করবে বুঝতে পারত না। পালিয়ে পালিয়ে চলতো নিজের থেকে। নানান অজুহাতে বাড়ি ঢুকতে অনেক দেরি করত। কিন্তু সাথে কেউ না থাকলে একা ঘুরে বেড়াতেও ভালো লাগে না বেশিক্ষণ। সময় কাটতে চাইতো না। এদিকে গোটা বাড়িতে কেউ নেই! শ্রুতি চলে গেছে। এত যে ওর কিসের রাগ! সেদিনের পরে আর ফিরে আসেনি ও। না আর কোন ফোন, না একটা মেসেজ। রাতে ঘুম না আসলে তখন অনি কোলবালিশে মুখ গুঁজে পড়ে থাকতো। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে বাথরুমে যেতেও ভয় লাগতো কেমন। শুরুর দিকে সপ্তাহখানেক ঘুমাতে পারেনি একা এই বড় খাটে শুয়ে। আসলে পুরোপুরি একা থাকার অভ্যাস ওর কোনোদিনই তো ছিল না। ছোট থেকে যৌথ পরিবারে মানুষ, তারপর হোস্টেল, তারপর..! গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। একঢোক জল খেলে হত। বেডসাইড টেবিলে রাখা জলের বোতলটা হাতে নিয়েই অনি বুঝতে পারলো তলায় মাত্র একটুখানি জল পড়ে রয়েছে। গলাও ভিজবে না ওতে। শোয়ার আগে বোতলটা ভরে নেওয়া উচিত ছিল। আজকাল এসব খুঁটিনাটি জিনিস মাথায় থাকছে না ওর। যাক, কি আর করা যাবে।

ঝড় উঠেছে বাইরে রীতিমত। কটা বাজে এখন? চশমা হাতের কাছে নিয়েই শোয় ও বরাবর। সেটা চোখে গলিয়ে দেওয়ালে টাঙানো ঘড়ির দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখল, দুটো সাঁইত্রিশ। একটা সময়ের পরে অন্ধকারে দেখতে আর অসুবিধা হয় না। আস্তেআস্তে মানুষের সব কিছুই সয়ে যায়। রাত অনেক হল। ঘুম আসছে না আর। ঘুম না আসলেই আজকাল যত রাজ্যের উদ্ভট চিন্তা মাথায় এসে ভিড় করে। এই এক নতুন ঝামেলা হয়েছে। যত বেশি করে ঘুমানোর চেষ্টা করবে, তত ঘুম আসতে দেরি হবে এবার। ভালো লাগছে না। আওয়াজটা থেমে গেল বোধহয়। দূরে কি কেউ চিৎকার করছে? না, না! হাওয়ার আওয়াজ। মোবাইল চেক করলে হত। সময় কেটে যেত বেশ। রিলস দেখতে ভালোই লাগে। শোওয়ার সময় অনেকক্ষণ ফোন ঘাঁটে অনি। ফেসবুক স্ক্রল করতে করতে কখন ঘুম চলে আসে। তারপর ডেটা অফ করে চার্জে বসিয়ে মোবাইলটা মাথার কাছে রাখে। আবার অনেকদিন আলগোছে ঘুম এসে যায়। ফোন হাত ফসকে ওর নাকেমুখে এসে পড়ে। ওভাবেই ঘুমিয়ে থাকে। সকালে হলে দেখে ফোনে চার্জ নেই আর। আজকে চার্জে বসিয়ে ছিল? প্রশ্নটা মাথায় আসতেই, হাতড়ে হাতড়ে মোবাইলটা খুঁজতে গেল অনি আর ঠিক তখনই হঠাৎ মৃত্যুর মত কনকনে ঠান্ডা কিছুর স্পর্শ পেল ওর হাত। বিদ্যুতের বেগে নিজের আঙুলগুলো সরিয়ে নিল ও। কি ওখানে? বালিশ আর খাটের হেডবোর্ডের মাঝখানে রাখা মোবাইলটার উপরে পড়ে আছে ঠান্ডা..ভীষণ ঠান্ডা আর নরম, কতগুলো মেয়েলি আঙুল! ওইরকম আঙুলের ছোঁয়া অচেনা নয় ওর। লাশকাটা ঘরের মত অবশ, বিশ্বাসঘাতকতার মত নিস্তব্ধ, অবিশ্বাসের মত শীতল কতগুলো আঙুল মুঠোয় আটকে রেখেছে ওর মোবাইল ফোনটাকে!

ধাক্কার আওয়াজটা ফিরে এসেছে ভীষণ প্রতিহিংসা নিয়ে। কান ফেটে যাবে মনে হচ্ছে অনির। কে ওখানে? ওটা কার হাত? কে শুয়ে আছে ওর বিছানায়? ওরকম ভাবে ওঁৎ পেতে আছে কেন? ঝড়ের রাতের অন্ধকারে, আড়াল থেকে কেউ যেন ওর অস্তিত্ব যাচাই করে নিতে এসেছে, একরাশ নিস্তব্ধ অবহেলার ছলে ছুঁয়ে দেখবে বলে চুপ করে অপেক্ষা করছে সময় হাতে নিয়ে। শ্বাপদ রক্তের জন্য অপেক্ষা করে থাকে ঠিক এইভাবে। আকাশ চিড়ে প্রচন্ড গর্জনে বাজ পড়লো খুব কাছেই! সজোরে দুচোখ বন্ধ করে কানে হাত চাপা দিল অনি। তারপর মুহূর্তের মধ্যে ওপাশ ফিরে শুয়ে পায়ের দিকে পড়ে থাকা চাদর ধরে একটান দিলো। চাদরঢাকা দিয়ে কোলবালিশে মুখ গুঁজে রাখলে ভয় অনেক কমে যায়। কিন্তু চাদরটা আসছে না। মনে হচ্ছে একটা ভারী কিছুর তলায় চাপা পড়েছে ওটা। কোনোমতেই চাদরটাকে আয়ত্তে আনা যাচ্ছে না। বেশ বুঝতে পারছে অনি ওর খাটে কেউ চুপিসাড়ে উঠে এসেছে। শুয়ে আছে পাশে। শুয়ে আছে চাদরের একটা কোণা টেনে নিয়ে। ছায়ার মত নিঃশব্দ কেউ! শোকের মত নিস্তব্ধ! গলাটা শুকিয়ে গেছে পুরো। ভয়ে সারাটা শরীর কাঁপছে। নিজের হৃদপিণ্ডের আওয়াজে কান পাতা যাচ্ছে না। আলো জ্বালবে? কিন্তু বেডস্যুইচটাও তো খাটের ওইদিকে। কি করবে? মাথা কাজ করছে না। চিৎকার করতে চাইলেও আওয়াজ বেরোচ্ছে না খটখটে শুকনো গলা দিয়ে। তার জায়গায় উঠে আসছে অন্ধকার মেশানো অবুঝ আতঙ্ক আর অবশ একটা অসহায়তা, দলা পাকিয়ে।

দুম! দুম! দুম! ভীষন ভয় লাগছে। কাকে ডাকবে ও? কেউ শোনার নেই। কি করবে এখন?

কে একটা বলেছিল ভয় লাগলে মনে মনে একশো থেকে উল্টোদিকে গুণতে হয়। উনচল্লিশ.. আটত্রিশ.. সাঁইত্রিশ..কাজ হচ্ছে না তো! নাকি হচ্ছে? একবার দেখবে ওদিকে ঘুরে? হতেও তো পারে আচমকা ঘুম থেকে উঠে মোবাইল ধরতে গিয়ে অন্য কিছুতে হাত লেগে গেছে! রাত্রিবেলা খাটে টিকটিকি বা আরশোলা উঠে আসা অসম্ভব নয়। অনেকসময় একতলার ঘরে বন্যা হলে নানারকম পোকামাকড় উঠে আসে। এসব গল্প হামেশাই শোনা যায়। একবার দেখবে সাহস করে উঠে? কেমন হবে যদি দেখা যায় আসলে একটা টিকটিকিকে অনি ভয় পেয়েছে? অফিসের বাথরুমে লীনাদি একবার আরশোলা দেখে প্রায় অজ্ঞান হয়ে গেছিল। কথাটা মাথায় আসতেই এরকম একটা অদ্ভুত সময়েও হাসি পেয়ে গেল অনির। ম্যানেজারবাবু পর্যন্ত ভুঁড়ি নিয়ে ছুটে এসেছিলেন সেবার হাঁফাতে হাঁফাতে। নাঃ! কাজ করছে মনে হয় টোটকাটা। কত অব্দি গোনা হয়েছিল যেন? সাঁইত্রিশ? এবার দেখাই যাক একবার হাতটা বাড়িয়ে। আচ্ছা, পা দিয়ে দেখলে কেমন হয়? অনি নিজেকে একদম গুটিয়ে নিয়ে পাশ ফিরে শুয়েছিল এতক্ষণ। এখন ধীরে ধীরে সোজা হওয়ার চেষ্টা করল আর সঙ্গেসঙ্গে বুঝতে পারল ভয় পেয়ে তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে শোওয়াটা বেকায়দায় হয়ে গিয়েছে। পায়ে ঝিঁঝি ধরে গেছে খুব। হাতে পায়ে ঝিঁঝি ধরে গেলে সামান্য একটু নাড়া পড়লেই কেমন একটা মারাত্মক রকম ঝিনঝিন করে। সহ্য করা যায় না একদম। ঠিক তাই হয়েছে। পা নাড়ানো যাচ্ছে না একটুও। কতক্ষণ শুয়ে আছে ও এদিকে ফিরে? ভয়ে চোখ বুজে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়েছিল কি? নাহলে এত তাড়াতাড়ি তো ঝিঁঝিঁ ধরার কথা না। কোনোরকম শব্দ না করে, ঘাড়টা যতটা সম্ভব আস্তেআস্তে উঠিয়ে আরেকবার দেওয়ালঘড়ির দিকে তাকালো অনি। আর অবাক হয়ে থমকে গেল ওইভাবেই। দুটো সাঁইত্রিশ?? এখনও? কেন? ঘড়ির ব্যাটারি শেষ হয়ে গেছে নাকি?

হঠাৎ ভীষণ ঠান্ডা লাগছে। কাঁপুনি থামছে না কিছুতেই। আর পা বাড়াতে হবে না। বেশ বুঝতে পারছে অনি পাশে কেউ চুপ করে শুয়ে আছে ওর। মানুষের কিছু কিছু অনুভূতি আছে যা বিশেষ বিশেষ সময়েই আছে বলে বোঝা যায়। গত সপ্তাহেই হল তো এরকম! বুধবার? না না..সোমবার বোধহয়। সন্ধ্যাবেলা বাসে ভিড়ের সুযোগ নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে অচেনা এক ভদ্রলোক কন্ডাক্টরের হাতের ফাঁক দিয়ে সরাসরি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। এমনিতে লোকটাকে দেখেওনি অনি কিন্তু অস্বস্তি লাগছিল কেমন একটা। মনে হচ্ছিল ওর দিকে কেউ যেন তাকিয়ে আছে। ঘাড় ঘুরিয়ে ডানদিকে তাকাতেই চোখাচোখি হয়ে গেল চশমা পড়া বেঁটে লোকটার সাথে। মানুষটা কেমন যেন অপ্রস্তুত হয়ে চোখ নামিয়ে নিয়েছিল। আর ফিরে তাকায়নি। আগে কতবার এমন হয়েছে যে, শ্রুতি ওকে ভয় দেখানোর জন্য চুপিচুপি পিছনে এসেছে পা টিপেটিপে। দাঁড়িয়েছে একদম গা ঘেঁষে। অনি প্রত্যেকবার বুঝে যেত আগে থাকতেই। ওই আচমকা চিৎকার করে উল্টে ভয় পাইয়ে দিত পাগলিটাকে। ঠিক তেমনই লাগছে এখন। না তাকিয়েও পরিষ্কার বুঝতে পারছে অনি, কেউ শুয়ে আছে ওর পাশে, ওর খাটে। একদম গা ঘেঁষে শুয়ে আছে ওর। হয়তো পাশ ফিরে সোজা হয়ে শুলে মেয়েটার গায়ে হাত পর্যন্ত লেগে যাবে ওর। খুলে রাখা চুলের শ্যাম্পুর গন্ধটাও ভীষণ চেনা! এরকম তো ভুতের গল্পে হয়! এদিকে বৃষ্টিটাও নেমেছে জোরে। ঘষাকাঁচের গায়ে জলের ছিটে এসে জমছে একটু একটু করে, অন্ধকারের মত। এক, দুই, তিন..

দুম দুম শব্দটা আবার ওর ঘোর ভাঙিয়ে দিল। ভাসতে ভাসতে অনেক দূরে চলে গিয়েছে আওয়াজটা। বৃষ্টিতে ঠিক করে শোনাই যাচ্ছে না। তবে এবার শুনে মনে হল দরজাই ধাক্কাচ্ছে কোনো মানুষ। আহা, কি ভালো হত লোকটাকে এখন যদি একবার দেখা যেত নিজের চোখে। ভীষণ ভয়ের সময় কাউকে দেখতে পেলে অনেকটা সাহস পাওয়া যায়। আচ্ছা, আদৌ কেউ কি আছে শুয়ে ওর পাশে, নাকি দুঃস্বপ্ন দেখছে অনি? ভয়ের স্বপ্ন দেখলে অনেকসময় এরকম হয়। স্লিপ প্যারালাইসিস বলে একটা কন্ডিশনের কথা দেখেছিল একবার ইউটিউবে। ঘুমের মধ্যে কোনোভাবে বেশি ভয় পেয়ে গেলে মানুষের ঘুম ভেঙে যায় অথচ নড়াচড়ার ক্ষমতা থাকে না। সারারাত এরকম একটা না ঘুমানো না জেগে ওঠার মাঝখানে আটকে থাকতে হয়। যারা আগে এরকম অভিজ্ঞতার শিকার হয়েছিল, তারা ওই ডকুতে বলছিল, এরকম হলে নাকি সময় কাটতে চায় না। এক একটা মুহূর্তকে এক এক ঘন্টার মত লম্বা মনে হয় তখন। এই নিয়ে এখনও গবেষণা চলছে। পুরোটা ঠিক করে জানা যায়নি। মানুষের মন অনেক গভীর! কত অজানা রহস্য লুকিয়ে আছে ওখানে অতলে। অনিও তো নড়াচড়া করতে পারছে না। নাকি নড়াচড়া করতে চাইছে না? চোখ খুলে দেখবে একবার? নিজের চোখে কাউকে তো দেখেনি এখনও! কেউ নাও তো থাকতে পারে। হয়তো খালিখালি বোকার মত ভয় পাচ্ছে। এরকম তো হতেই পারে যে আসলে কিছুই নেই। সবই ওর মনের ভুল। উঠে একছুটে দরজা খুলে পালাবে বাইরের ঘরে? কিন্তু সাহস হচ্ছে না যে! অনি এত ভীতু?

আচ্ছা, ডিপ্রেশনের মেডিসিন বন্ধ করলে কি এইসব ভুলভাল সিমটম দেখা দেয়? ডক্টর সান্যাল কম কথার মানুষ। শুধু বলেছিলেন “ওটা আপাতত চলবে”। ওষুধটা শেষ হয়ে গেছে। কিনছি কিনবো করে কেনা হয়ে ওঠেনি। ওষুধটা না খেলে ঘুম আসছিল না ইদানিং রাতে। শেষ হওয়ার আগে কিনে রাখলেই হত। বাইরে থেকে ভাসা ভাসা কোলাহলের আওয়াজ আসছে একটা। অনেকে মিলে নিজেদের মধ্যে কথা বললে যেমন আওয়াজ হয়, ব্যাপারটা কিছুটা সেরকম। কি নিয়ে আলোচনা করছে ওরা? বোঝা যাচ্ছে না ঠিক করে। পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে না কিছুই। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে কারা বেরিয়েছে এত রাত্রে? অনেকক্ষণ হয়ে গেল, কেউ দরজা কেউ খুলছে না দেখে এবার পাড়ার লোকজন ভিড় করছে বোধহয়। পুলিশে খবর দেওয়া উচিত ওদের। উঠবে একবার?

বোতলে যেটুকু জল ছিল একঢোকে গলায় ঢেলে দিল অনি। তারপর সাহস করে উঠে বসল খাটে। শুয়ে থাকলে চলবে না। তবে ওইদিকে তাকাবে না এখনই। কেন জানি মনে হচ্ছে ওর পাশে যে শুয়ে ছিল এবার সেও ওর সাথে উঠে বসেছে কোনো আওয়াজ না করে। ওর দিকেই তাকিয়ে আছে একদৃষ্টিতে। সবুজ দুটো চোখ জ্বলছে যেন নিভে আসা আগুনের আঁচে। একটু একটু করে নরম, ঠান্ডা মেয়েলি আঙুলগুলো নড়ে চড়ে এগিয়ে আসছে চাদরের উপর দিয়ে। এগিয়ে আসছে একটুও আওয়াজ না করে। আর একটু! আর একটু! এবার তর্জনি তুললেই অনিকে ছোঁয়া যাবে। একবার ওই স্পর্শের পর কি হবে অনি জানেনা। ওই আঙুলগুলোও কি জানে? কি চায় ও? দমবন্ধ এই অপেক্ষা বরদাস্ত করা যাচ্ছে না আর কোনোমতে। গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। কিছু একটা করতে হবে। এভাবে চলে না। মাথা না ঘুরিয়ে আড়চোখে যতদূর দেখা যায়, একবার চেষ্টা করবে দেখার? না না, থাক! ভয় লাগছে। তার থেকে বরং কোনোভাবে উঠে জানালাটা খোলার চেষ্টা করা যাক। গন্ধটাও দূর হবে তাহলে। নিশ্চয়ই ইঁদুর পচেছে খাটের তলায়।
সেই ভালো! যেই অনি একটা পা বাড়িয়ে মাটিতে রাখতে গেছিল, ঠিক সেইসময়ে প্রচন্ড নারকীয় আওয়াজে, অনিকে পুরো চমকে দিয়ে বেজে উঠল ওর মোবাইল ফোন। ঘরের অন্ধকারকে তছনছ করে দিল স্ক্রিনে ফুটে ওঠা আলো। আঁতকে উঠে, চেয়ে হোক কিংবা না চেয়েই হোক, হয়তো অভ্যাসের জন্যই হবে, মুহূর্তের জন্য চোখ আর হাত দুটোই চলে গেল মোবাইলের দিকে। ওইদিকে। পরক্ষণেই যদিও আগুনে পুড়ে যাওয়া কাগজের মত নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিল অনি কিন্তু যা দেখার ছিল না, এইটুকু সময়ের মধ্যে ঠিক সেটাই খুঁজে নিয়েছে ওর চোখ।

ভুল ভেবেছে অনি। কেউ বসে নেই ওর পিছনে ছায়ার মত। কেউ তাকিয়ে নেই ওর দিকে চোখে সবুজ আগুন জ্বেলে। চাদর বেয়ে ওর দিকে এগিয়ে আসছে না একটাও শীতল সরীসৃপের মত মেয়েলি আঙুল। কিন্তু.. চাদরের একটা দিক মুখের উপরে দিয়ে, মুখ ঢেকে শুয়ে আছে কেউ। শুয়ে আছে চিৎ হয়ে। ভীষণ ফ্যাকাশে দুটো হাত চাদর থেকে বেরিয়ে বালিশের উপরে পড়ে আছে। ডান হাতটা আছে অনির মোবাইলের উপরে। বাঁ পাটা খাটের বাইরে বেরিয়ে আছে। দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। জীবনের কোন চিহ্ন নেই ওই শরীরে। অনির শিরদাঁড়া বেয়ে, ভৌতিক গল্পের লেখকদের ভাষায়, একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। আতঙ্কে, উত্তেজনায় ও খেয়ালই করেনি কখন বিছানা ছেড়ে উঠে পড়েছে। এক ধাক্কায় ছিটকে এসে দাঁড়িয়েছে জানালায় পিঠ ঠেকিয়ে। চোখ ফেরানো যাচ্ছে না। কি দেখছে ও এইভাবে? মোবাইলের আলোটা?..নাকি ফ্যাকাশে ওই হাতের মেয়েলি আঙুলগুলোকে? পোকারা বোধহয় পুড়ে মরে যাওয়ার আগে আগুনের দিকে ঠিক এই মোহ নিয়েই তাকিয়ে থাকে। ফোনটা থামছে না। রিংটোন বাজছে..একবার, দুবার, তিনবার। অশুচি রাতকে বিকৃতভাবে ফালাফালা করে দিচ্ছে বেমানান রিংটোন। কে ফোন করছে ওকে এত রাতে? কিভাবে ফোনটা ধরবে ও? কে ফোন করছে? শ্রুতি? নাকি অবিন? এত রাতে কেন কেউ ফোন করবে ওকে?

পর্দা সরিয়ে দিয়েছে অনি কিন্তু জানালা খোলা যাচ্ছে না। জং ধরে গেছে পুরোনো ছিটকিনির গায়ে। একটু কায়দা করে খুলতে হয়। আজ আর কিছুতেই খোলা যাচ্ছে না। কি করা যায় এখন? এই অবস্থায় খাটে গিয়ে আর শোওয়া চলে না। আবার এদিকে বন্ধ জানালার দিকে তাকিয়েই বা কাঁহাতক দাঁড়িয়ে থাকবে? রাত বোধহয় আর বেশি বাকি নেই। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। সাহস করে একবার বাথরুম গেলে হত। যে মেয়েটা শুয়ে আছে, সেতো কোনোভাবে বিরক্ত করছে না ওকে। তাও ওর পা দুটো শুনতে চাইছে না কোনো কথা। আচ্ছা ঝামেলায় পড়া গেল! ওদিকে বাইরে কোলাহলটা একটু বেড়েছে যেন। বেড়েছে দরজা ধাক্কানোর আওয়াজটাও। আরও ঘন ঘন বাড়ি পড়ছে কাঠে। পাড়ায় অঘটন হয়ে গেল নাকি কিছু? একবার বাইরে গেলে সবথেকে ভালো হত। রাস্তার উল্টোদিকে সেন কাকিমার বয়স হয়েছে অনেকটা। বুলু নিউটাউনের ফ্ল্যাটে উঠে যাওয়ার পরে কাকিমা একা হয়ে গেছেন। শরীর ভালো যাচ্ছে না। অনেক টাকার ওষুধ খেতে হয় নিয়মিত। আয়ারা কামাই করে মাঝেমধ্যে। সেদিনই কথা হচ্ছিল। শ্রুতির কথা জিজ্ঞাসা করছিলেন। কি বলতো অনি? কিছু কি আর বলার আছে?

দু একজন লোকের গলার আওয়াজ ভালোমতোই শোনা যাচ্ছে এবার। বৃষ্টিটা থেমে এসেছে একটু। থেকেথেকে দমকা হাওয়ায় ভেসে যাচ্ছে কথাগুলো। বেশি খোলামেলা জায়গায় ঝড় উঠলে ঠিক এরকম হয়। অনিরা একবার এরকম আবহাওয়ায় খুব ফেঁসেছিল। তখন ওরা কলেজে ঢুকেছে সবে। ভিক্টোরিয়ায় ঘুরতে গেছিল একসাথে অনেকে মিলে। হঠাৎ কথা নেই বার্তা নেই আকাশ পুরো কালো করে ঝড় এল। তখন কতই বা আর বয়েস! মানুষের ওই বয়সটা ভীষণ সুন্দর। সুযোগ পেলে অনি এক্ষুনি সেই সন্ধ্যাবেলায় ফিরে যেতে রাজি আছে। শ্রুতি একটা গোলাপী রঙের টপ পড়েছিল সেদিন। দুজনে কোনোরকমে একটা বটগাছের তলায় একছুট্টে গিয়ে মাথা বাঁচিয়েছিল। ওই প্রথম মেয়েটাকে অতটা কাছে পেয়েছিল অনি। কি ভীষণ নরম শ্রুতির হাতগুলো! কি ছোট্ট! বাকিরা কে কোথায় ছিটকে গেছে ততক্ষণে। ঝড়ে কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না আর। ধুলোয় ঢেকে গেছে চারপাশ। তারপর বৃষ্টি নামলো। এলোমেলো হাওয়ায় ছাতা উড়ে গেছে ওর হাত ছাড়িয়ে। নীতিশের গলা ভেসে আসছিল দূর থেকে, “অনি! শ্রুতি! তোরা কোথায়? শুনতে পাচ্ছিস? অনি?” কেউ সাড়া দেয়নি ওকে। কিছু কিছু সময় তৃতীয় কাউকে সাড়া দিতে মন চায় না। সময় দাঁড়িয়ে গেছিল সেদিন ওই বটগাছের তলায়। ওরা দুজনে আনমনে পুরো ভিজে গিয়েছে ততক্ষণে।
“অনি! এই অনি!”
ঘোর ভেঙে গেল হঠাৎ। কেউ ডাকছে ওকে? না, না, শোনার ভুল। কে ডাকবে ওকে? কেনই বা ডাকবে? ভুল শুনেছে নিশ্চয়ই। রাত আর বেশি বাকি নেই। ভাবতে ভাবতেই ঘড়ির দিকে চোখ চলে গেল। ঘড়িটা এখন আরও কাছে। অরপ্যাট লেখাটাও দিব্যি পড়া যাচ্ছে ডায়ালের মাঝখানে। এখান থেকে সব পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। ভুল করার আর কোনো সুযোগ নেই। ঘড়িটা খারাপ হয়নি। সেকেন্ডের কাঁটা ঘুরছে টিক টিক টিক টিক। ঘড়িতে দুটো সাঁইত্রিশ বাজে! এখনও! কেন? অনি কি পাগল হয়ে যাচ্ছে? না! না! না! না! দরজায় ধাক্কার আওয়াজটা বেড়ে চলেছে ক্রমাগত। আওয়াজটা কি ওরই দরজায় হচ্ছে? কেন? ঘড়ির আওয়াজ আর দরজায় ধাক্কা মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে কিভাবে? বীভৎস বিকৃত একটা আওয়াজ। কে ডাকছে ওকে এত চিৎকার করে?
“অনি! এই অনি!অনি?!”

হঠাৎ করে মানুষগুলোর কথা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে পুরো। বৃষ্টি থেমে গেছে বাইরে। ডালপালাগুলো দুলছে জোরে। বুলাইয়ের মায়ের আওয়াজ না? এত চিৎকার করছে কেন বুলাইয়ের মা?

“কালও সাড়া দেয়নি গো। অনেক ডাকাডাকি করেছি। তারপর ভাবলাম দেরি করে শুয়েছে বোধহয়, থাক, ঘুমাক। কিন্তু আজও এত বেলা হয়ে গেল, তাও দরজা খুলছে না! কিছু একটা হয়েছে মনে হচ্ছে গো! তাই আমি ওই ওনাকে ডাকলাম ফোন করে। তোমরা একটু দেখো না দাদা।”

“দরজা তো ভিতর থেকে বন্ধ। পুলিশকে ফোন করেছি। অফিসটাইম চলছে। গাড়ি নিশ্চয়ই জ্যামে আটকে আছে কোথাও।”

অফিসটাইম? বলে কি লোকটা?? এখন তো রাত দুটো সাঁইত্রিশ। তাহলে?

বাইরে থেকে ভীষণ চেনা একজনের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে এবার,

“ওকে আমিও ফোন করছি সকাল থেকে, তুলছে না! অনি! এই অনিন্দিতা! অনিন্দিতা!! দরজা খোল!”

শ্রুতি? শ্রুতি এসেছে? শ্রুতি ডাকছে ওকে? কিন্তু শ্রুতির গলাটা কেমন একটা শোনাচ্ছে যেন। নাক চেপে কথা বললে যেমন শোনায়..

অন্য কেউ এগিয়ে এসেছে এবার,
“আপনি একটু সরে দাঁড়ান। দরজা মনে হচ্ছে ভাঙতে হবে।”

অনির সব হঠাৎ কেমন গুলিয়ে গেল। আস্তে আস্তে জানালার দিক থেকে ঘুরে দাঁড়ালো ও। পচা গন্ধটায় গা গুলিয়ে উঠছে। শ্রুতি কি এইজন্যই নাকে রুমাল চাপা দিয়ে আছে? শরীর খারাপ লাগছে। পৃথিবী টলমল করছে পায়ের নীচে। মাথা ঘুরছে নাকি? জানালার গায়ে মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়ালো অনি। ছিটকিনি খুলে পাল্লাটা একটু ফাঁক করতে পারলে ভালো হতো। দমবন্ধ লাগছে।

“অনিন্দিতা! এই অনি!!”

শ্রুতিই তবে ফোন করছিল। কাঁদছে ও? অনি ধীরপায়ে খাটের দিকে এগোচ্ছে। খাটে চাদরের আড়ালে শুয়ে থাকা ফ্যাকাশে হাতের মেয়েলি শরীরটা টানছে ওকে অদৃশ্য ভাবে। কেন এরকম হচ্ছে? বাঁধা দেওয়ার কোনো শক্তি নেই অনির। ইচ্ছাও করছে না বাঁধা দিতে। আর ভয় লাগছে না। দরজাটা শেষমেশ বোধহয় ভেঙেই ফেলছে ওরা। ভীষণ শব্দ আসছে..কাঠ ভেঙে পড়ার শব্দ। দুম! দুম!

আস্তে আস্তে অনি মন্ত্রমুগ্ধের মত খাটের পাশে এসে দাঁড়ালো। মুখ ঢেকে শুয়ে আছে মেয়েটা! অনির মায়া হল। আলতো স্পর্শে চাদর ধরে টানতে আরম্ভ করতেই হাত কেঁপে উঠলো ওর। তবু থামলো না অনি। চাদর মেয়েটার হাত থেকে নেমে আসছে ধীরে ধীরে। শ্বেত পাথরের মত সাদা একটা হাত! কি সুন্দর আঙুলগুলো! বাইরে বোধহয় একটা গাড়ি এলো। অ্যাম্বুলেন্স নিশ্চয়ই! সাইরেনের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে পরিষ্কার। কাঁচের শার্সি দিয়ে ঢুকে লাল নীল আলো খেলা করছে অনির ঘরে। বুকে মুখে সারাগায়ে খেলা করছে লাল নীল আলো। বাইরে কতগুলো ভারী বুটের ছুটে আসার শব্দ!

“দরজা খুলুন, নাহলে আমরা দরজা ভেঙে ভিতরে আসছি!”

“অনি! দরজা খোল! অনি..!?”

চাদর সরে যাচ্ছে মেয়েটার মুখের ওপর থেকে। অনেক মায়া নিয়ে অনি তাকিয়ে আছে। ওর চুলগুলো ঘেঁটে যাচ্ছে চাদরের টানে। মুখের উপর এসে পড়ছে এলোমেলো হয়ে। ওই চোখ, ওই গাল, ঠোঁটের বাঁ পাশের ওই ছোট্টতিলটা, সব.. সব..সব ওর অনেকদিনের চেনা! একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করছে অনির। যেন আয়না দেখছে ও! চশমার কোল থেকে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে নামছে গালে। ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে সবকিছু। খুব আদর ভরে আলতো করে মেয়েটার মুখের উপর থেকে চুলগুলোকে সরিয়ে দিল ও। চশমাটা খুলে রাখবে? সুন্দর লাগছে মেয়েটাকে এখন। কপালে ভালোবেসে একবার হাত বুলিয়ে দিলো। ঠান্ডা, কি ভীষণ ঠান্ডা!

দরজাটা ভেঙে ফেলেছে ওরা! অনেকগুলো গলার আওয়াজ! কত লোক! সবাই ঢুকে আসছে। একসাথে ঢুকে আসছে আলো, কোলাহল, গাড়ির হর্ন…ওই ভাঙা দরজার ফাঁক দিয়ে। শ্রুতিও এসেছে কি? শেষমেশ এলো তাহলে!

এই ঘরে এখনও রাত। ঘড়িতে দুটো সাঁইত্রিশ। দূরে মেঘ ডাকছে। বৃষ্টি আসবে আবার। ঘুম আসছে অনির। এবার ঘুমিয়ে পড়তে হবে…

অলংকরণ-রাতুল চন্দরায়

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here