সুখেন্দু হীরা

(আইপিএস সুখেন্দু হীরা বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল (নিরাপত্তা)। প্রতারণার নানা কাহিনি ধারাবাহিক ভাবে তিনি তুলে ধরছেন বালিহাঁস-এর পাতায়।)

পরপর কয়েকটি পর্বে ব্যবসায়ীদের প্রতারণার কথা বলাতে আমার ব্যবসায়ী বন্ধুরা একটু ক্ষুদ্ধ হয়েছেন। আমার ছেলেবেলার বন্ধু, স্কুলের বন্ধু বা পরবর্তীকালে চাকরিসূত্রে পরিচিত বন্ধুরা অনেকে ব্যবসা করেন। স্বনিযুক্তি প্রকল্পে যুক্ত অনেকে। তাঁরা সকলেই প্রায় নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। তাঁদের মনে আঘাত করার জন্য তো এই লেখা নয়। সার্বিক ভাবে সাধারণ মানুষজন যাতে প্রতারণার বিষয়গুলি জানতে পারেন, যাতে সচেতন হতে পারেন, সর্বোপরি জীবনের ছোট ছোট সত্যগুলো থেকে আমোদ নিতে পারেন, সেই জন্যই এই কলম।

অনেক ব্যবসায়ী বন্ধু আমাকে অনুযোগ করে বলেছেন, আমি শুধু ব্যবসায়ীদের ঠকানো দেখলাম, খরিদ্দার বা গ্রাহকদের প্রতারণা চোখ এড়িয়ে গেল।

এটা ঠিক অনেক গ্রাহক বা খরিদ্দার দোকান থেকে, বাজার থেকে, মেলা থেকে জিনিসপত্র চুরি করে আনে। এটাকে ঠিক প্রতারণা বলা যাবে না। এগুলো সরাসরি চুরি। অনেকে ওই দ্রব্য হস্তগত করার জন্য ছলের আশ্রয় নেয়। সেটা একপ্রকার প্রতারণা বলতে পারি।

একটা হিন্দি সিনেমা দেখেছিলাম “জিন্নি অউর জনি”। ১৯৭৬ সালে নির্মিত কৌতুক অভিনেতা মেহমুদ পরিচালিত ছবি। সেখানে মেহমুদ (চরিত্রের নাম জনি) একটি ছোট মেয়ে জিন্নিকে নিয়ে বড় দোকানে যায়। সেখানে জনি বড় নোট ভাঙিয়ে ছোট জিনিস কেনে। ছোট মেয়েটি ছোট নোট দিয়ে ছোট জিনিস কেনে। জিন্নি দাবি করে, সে বড় নোট দিয়েছে। নোট চিহ্নিতকরণের একটি চিহ্নও সে বলে। দোকানদার বলেন, “না তুমি ছোট নোট দিয়েছো।” সেখানে উপস্থিত লোকজন বলেন, একটা ছোট মেয়ে কেন মিথ্যা বলবে? ক্যাশবাক্স খুঁজে দেখা যায়, নোটটি সেখানে রয়েছে। আসলে সেই নোটটা জনি আগে দিয়ে মাল কিনেছিল। দোকানদার অতিরিক্ত টাকা ফেরত দিতে বাধ্য হয়।

এটা অবশ্য সিনেমা, বাস্তবে কোথাও এরকম ঘটেছিল কিনা জানা নেই। সংবাদপত্রে একটি ঘটনা পড়েছিলাম। এক ব্যক্তি বিমানে টিকিট কিনে এয়ারপোর্টে প্রবেশ করতেন। টিকিটের বিনিময়ে সেখানে কমপ্লিমেন্টারি লাঞ্চ পাওয়া যেত। তিনি দুপুরের আহার সেরে, টিকিট ক্যানসেল করে, পরের দিনের টিকিট কেটে নিয়ে আসতেন। এ ভাবে চলছিল অনেক দিন। অবশেষে ধরা পড়ে তাঁর চালাকি। এটা অবশ্য বিদেশের ঘটনা।

আমাদের দেশে অবশ্য জনসাধারণ সরাসরি ট্রেনের ভাড়া, বাসের ভাড়া ফাঁকি দিতে অভ্যস্ত। আমাদের ছেলেবেলার পাড়ায় ট্রেনের টিকিট, বাসের টিকিট ফাঁকি দেওয়াটা একটা বাহাদুরির কাজ হিসেবে ধরা হতো। কে কীভাবে ট্রেনের টিকিট না কেটে, ট্রেনের টিকিট এক্সামিনারকে ফাঁকি দিয়ে এলাম; কে কীভাবে বাসে উঠে টিকিট না কেটে, নামার সময় পুরনো টিকিট দেখিয়ে পার পেয়ে গেলাম; এসব গল্প আমরা ফলাও করে পাড়ায় বন্ধুদের মাঝে বলতাম।

বাস থেকে নামার সময় কন্ডাক্টর জিজ্ঞাসা করতেন, “টিকিট”। বাসের একটা পুরনো টিকিট হাতঘড়ির বেল্টের নীচে গুঁজে অথবা ঠোঁটের মাঝে চেপে নামতাম। যারা বেশি সাহসী, তাঁরা নামার সময় সরাসরি বলতো, “হয়ে গেছে”।

যারা ট্রেনের টিকিট ফাঁকি দিতেন, তারা মজা করে বলতেন, “আমি টিকিট ফাঁকি মারার টাকা জমিয়ে রাখলে লাখপতি হয়ে যেতাম।” কেউ বলতেন, “আমি একটা বই লিখব টিকিট ফাঁকি দেওয়ার ১০১ উপায়।” এগুলোকে অনেকে নিছক মজা হিসাবে ধরলেও এগুলো অবশ্যই একটা প্রতারণা। অনেকে তত্ত্বকথায় বলবেন, “এগুলো দেশকে ফাঁকি দেওয়া, দেশের ক্ষতি করা, দেশের অর্থনৈতিক বুনিয়াদে তৈরিতে সাহায্য না করা, ইত্যাদি। কিন্তু একটা কথা আমাদের প্রত্যেকের মনে রাখা উচিত, “বিনা পয়সায় আমি কোনও সার্ভিস অর্থাৎ পরিষেবা নেব কেন!”

টিকিট ফাঁকি দেওয়াটা যেমন বাহাদুরির ব্যাপার, তেমন আইন ভঙ্গ করাটা বীরত্বের ব্যাপার। অনেক মনস্তত্ত্ববিদরা বলেন, আমাদের দেশে আইন ভঙ্গকারীরা বা অপরাধীরা সমাজে উচ্চপদে আসীন হয়, জনসমক্ষে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ান, সম্মান না পেলেও সম্ভ্রম পান, ক্ষমতা ভোগ করেন; এই সব কারণে জনসাধারণ আইন ভাঙাকে বীরত্বের প্রতীক হিসেবে দেখেন। এই তত্ত্ব সর্বসম্মত না-ও হতে পারে। কিন্তু বাস্তবে আমরা এই রকমটাই দেখি।

জলজ্যান্ত উদাহরণ দিতে পারি, মোটরযান আইন ভঙ্গকারীদের বা ট্রাফিক নিয়ম অমান্যকারীদের। সাধারণ ভাবে মোটরসাইকেল আরোহী মাথায় হেলমেট পরতে চান না। চারচাকার সওয়ারিরা সিটবেল্ট বাঁধতে চান না, গাড়ির দূষণ চেক করিয়ে রাখতে চান না, গাড়িতে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র রাখতেও অনীহা। রাস্তায় ধরা পড়লে নানা অজুহাতের ফুলঝুরি। বাড়িতে অসুস্থ, হাসপাতালে ভর্তি, ওষুধ আনতে বেরিয়ে ছিলাম, সামনেই বাড়ি, পাড়ার দোকানে এসেছি— ইত্যাদি ইত্যাদি। এতেও যদি কোনও ছাড় না পাওয়া যায় তাহলে কোনও পরিচিত দাদা বা পরিচিত পদস্থ অফিসারকে ফোন।

এরপর কেউ যদি এ ভাবে ছাড়া পেয়ে যান, তিনি পাড়ায় ফিরে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তার বীরত্বের কাহিনি শোনাবেন। যদি তিনি পুলিশের চেকিং এড়িয়ে পালিয়েও আসেন, তবুও তিনি এসে বড়াই করে বলবেন— কীভাবে আজ পুলিশকে চুক্কি দিয়ে এলাম। একটি বারের জন্য তার মনে হবে না আমি অন্যায় করেছি বা আমি আইন ভঙ্গ করে অপরাধ করেছি। জনসাধারণও মনে করে, অকারণে এগুলো পরীক্ষা করে প্রশাসন অহেতুক তাদের হয়রান করছে।

এই ফাঁকি দেওয়া প্রবণতা জনসাধারণের সমস্ত স্তরে আছে। ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়া, আয়কর ফাঁকি দেওয়া, বিক্রয়কর ফাঁকি, দেওয়া বিদ্যুতের মাসুল ফাঁকি দেওয়া। অনেক বিদ্যুৎ গ্রাহক বিদ্যুতের মিটারে পিছনে চুম্বক লাগিয়ে রাখেন, যাতে বিদ্যুতের বিল কম আসে। হুকিং করে বিদ্যুতের সংযোগের কথা তো বাদ দিলাম।

এই ফাঁকিবাজি আমাদের সমাজে রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে আছে। সরকারি কর্মীরা ঠিক সময় অফিসে আসেন না, এলেও যথার্থ কাজ করেন না। অনেক শিক্ষক ক্লাসে ঠিক মতো পড়ান না, চিকিৎসকদের একাংশ হাসপাতালের আউটডোরে রোগী দেখার থেকে নিজের চেম্বারে রোগী দেখতে বেশি পছন্দ করেন, ইত্যাদি ইত্যাদি।

আসলে আমাদের মধ্যে একটা ভণ্ডামি কাজ করে। আমি নিজে একটু আধটু অসৎ হলে অসুবিধা নেই, কিন্তু অন্যেরা যেন সৎ হয়। আমি একটু ফাঁকিবাজ হলে ক্ষতি নেই, অন্য কেউ যেন ফাঁকি না দেয়, সবাই যেন নিয়ম-কানুন মেনে চলে। অন্য কেউ আমার ফাঁকিবাজি ধরলে বলবো, সামান্য কারণে আমাকে হয়রান করছে বা এর পিছনে নিশ্চয়ই কোন অসৎ উদ্দেশ্য আছে। কিন্তু অন্যের খুঁত ধরতে পারলে আমি ছেড়ে কথা বলবো না।

ভণ্ডামি মানে তো প্রতারণা। আর যিনি ভণ্ডামি করেন, তিনি প্রতারক তো বটেই।

অলংকরণ-রাতুল চন্দরায়