সঞ্জয় গুপ্ত

‘গরম কাতুরে’ মানুষদের পক্ষে মার্চ মাসে শান্তিনিকেতন যাওয়ার ব্যাপারটা কিন্তু বেশ চাপের। শান্তিনিকেতনে ওই সময়টায় ৩০ থেকে ৩২ ডিগ্রি অবধি পারদ নামা ওঠা করে।

অথচ ওই মার্চ মাসেই, পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম সিগনেচার ইভেন্ট ‘বসন্ত উৎসব’ অনুষ্ঠিত হয় শান্তিনিকেতনে।

অনুষ্ঠানটি শুরু করার ভাবনার কৃতিত্ব অনেকেই দিয়ে থাকেন রবীন্দ্রনাথের ছোট ছেলে শমীন্দ্রনাথকে। ১৯০৭ সালের জানুয়ারি মাসে, মতান্তরে , ফেব্রুয়ারি মাসের ১৭ তারিখে, এগারো বছরের বালক, শমী, ঋতু উৎসবের আযোজন করেছিলেন। ওই অনুষ্ঠানের কথা বলতে গিয়ে প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় লিখেছেন ” শমীন্দ্র এবং আরো দুইজন ছাত্র বসন্ত সাজে, একজন সাজে বর্ষা আর তিনজন হয় শরৎ।” অনুষ্ঠানটি আয়োজন হয়েছিল শ্রী পঞ্চমী তিথি উপলক্ষ করে। ওই অনুষ্ঠানেই নাকি সবচেয়ে প্রথম আনুষ্ঠানিক ভাবে গাওয়া হয়েছিল “একি লাবণ্যে পুর্ণ প্রাণ, প্রাণেশ হে “। শমী এই গানটি খুব গাইতেন।

অনুষ্ঠানটি যেখানে আয়োজিত হয়েছিল, সেখানেই এখন শমীর নামে একটি পাঠাগার স্থাপিত হয়েছে। আরও একটি বলার মতো কথা, রবীন্দ্রনাথ সেই অনুষ্ঠানের দিনটিতে শান্তিনিকেতনে উপস্থিত ছিলেন না।

শমী অবশ্য ওই একবারই ছিলেন। সেবছরই , ২৩ নভেম্বর কলেরায় তাঁর মৃত্যু হয়। চলে যাওয়ার সেই রাতটি নিয়ে বড্ড মর্মস্পর্শী বিবরণ লিখেছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ।

১৯০৭ থেকে ১৯২২ অবধি, বসন্ত উৎসব হয়েছে নিশ্চয়ই। কিন্তু সেটা আশ্রমিক উৎসব তখনও হয়ে ওঠেনি। ১৯২৩ সালের ২২ জানুয়ারি শান্তিনিকেতনে বসন্ত উৎসব পালিত হয়েছিল। সেদিন বিকেলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছাত্রীদের নিয়ে কলাভবনে গান গেয়েছিলেন ।

‘শান্তিনিকেতন পত্রিকা’র চতুর্থ বর্ষ মাঘ সংখ্যায় বিবরণ হিসেবে লেখা রয়েছে, ” ছাত্রীরা সকলেই বাসন্তী রঙে ছোপানো শাড়ী পরিয়াছিল, মাথায় সকলের ফুল গোঁজা ছিল। পূজনীয় গুরুদেব রং-এর পোশাক পরিয়া তাহাদের মধ্যে বসিয়া ছিলেন। ”
শান্তিদেব ঘোষ একটি সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, ১৯৩১ সালে তিনি এবং কলাভবনের ছাত্র বনবিহারী ঘোষ , দোলের আনন্দ আসরে প্রথমবার বাউলের ভঙ্গিমায় নেচে উঠেছিলেন। শান্তিদেব জানিয়েছেন, তখন ‘বসন্ত উৎসব’ বলে কিছু ছিল না। সবাই মিলে আবির খেলা, গান গাওয়া— এসবই করা হতো। সন্ধ্যায় থাকতো কোনও অনুষ্ঠান।

তাঁর লেখা পড়লে মনে হয়, ১৯৩২ থেকেই “ওরে গৃহবাসী” গাইতে গাইতে শোভাযাত্রার চল হয়েছিল। ১৯৩৪ সালে, গানের সঙ্গে নাচ যোগ হয়েছিল। শান্তিদেব ঘোষের তথ্য অনুযায়ী, সেই সময় গানের দল প্রথম সারি বেঁধে আসতো, তাদের পিছনে ছাত্রীরা। তারপর কুড়ি-পঁচিশ জন মেয়ে সামনে, পিছনে গানের দল। সেই দেখে তাঁর মাথায় খেয়াল এসেছিল, মেয়েদের চলাটাকে নাচের মুদ্রায় করলে কেমন হবে। রবীন্দ্রনাথ সম্মতি দিলেন। একটা মণিপুরী নাচের সাধারণ মুদ্রা, এগিয়ে যাওয়ার ঢঙে শুরু হলো শোভাযাত্রা। তারপর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও পরিবর্তন এসেছে।

১৯৩৫ সালে বসন্তোৎসব পড়েছিল ২০ মার্চ তারিখে।
প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের ‘রবীন্দ্র জীবনী’-র চতুর্থ খণ্ডে সেবারের অনুষ্ঠানে নাচের দলের যে-তালিকা পাওয়া যায় তাতে রয়েছে ইন্দিরা নেহরুরও নাম। চৌদ্দটি গানের মধ্যে ‘কে দেবে চাঁদ, তোমায় দোলা’ এবং ‘তোমার বাস কোথা হে পথিক’ গান দু’টির সঙ্গে অন্যান্যদের সঙ্গে নেচেছিলেন ছাত্রী ইন্দিরা।

১৯৩৬ সালের ৮ মার্চ দোল পূর্ণিমার দিনেই বসন্তোৎসব হয়। সেদিন ভাষণ দিতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ স্মরণ করেছিলেন সদ্যপ্রয়াতা কমলা নেহরুকে।

১৯৩২ থেকেই, ধীরে ধীরে রবীন্দ্রনাথ বদল আনছেন এই অনুষ্ঠানে। প্রথা, নতুন নতুন জিনিস জুড়ছে অনুষ্ঠানে। আর আয়োজন করার দিন, জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি থেকে সরে গিয়ে স্থান করে নিচ্ছে মার্চ মাসে। উষ্ণ দিনগুলির মাসে। আর ধীরে ধীরে এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারার আকর্ষণ শুধু আশ্রমবাসী নন, আপামর জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে যাচ্ছে।

সবাই গরমকে এতো পরোয়া করে না। ঝাঁকে ঝাঁকে সংস্কৃতিবান বাঙালি ওই সময়টা হোটেল না পেলে গাছতলায় শুয়ে থাকার পণ নিয়ে শান্তিনিকেতনে যাওয়ার জন্য টিকিট কাটে ।

আর এত মানুষের মধ্যে অনেক কিছু কাণ্ডও ঘটে যায়।

১৯৮২ সালে, লোকজন আম্রকুঞ্জের গাছের উপর চড়ে বসেছিল। ডাল ফাল ভেঙে হুলুস্থুল কাণ্ড। পরের বার উপাচার্য অম্লান দত্তের তত্ত্বাবধানে একটু কম মাত্রায় অনুষ্ঠানটির আয়োজন করা হয়েছিল।

২০১৯ সালে, প্রায় আড়াই লক্ষ মানুষ এসেছিলেন বোলপুর। ভিড়ে ভিরাক্কার শহরে সব ব্যবস্থা ঠিক ভাবে চলতে পারেনি। এত লোক এলে, বেশ কিছু অসভ্য রকমের ঘটনা ঘটে যায়। বসন্ত উৎসব চলাকালীন সংঘটিত ঘটনা নিয়ে, তৎকালীন উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তী , যিনি নানা কারণেই বিতর্কিত, একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন ” শান্তিনিকেতনে বসন্ত উৎসব নয়, বসন্ত তাণ্ডব হতো, বন্ধ করে দিয়েছি। ” তিনি জানিয়েছিলেন উৎসব প্রাঙ্গণ থেকে ৩৫ বস্তা ভরা মদের বোতল আর অসংখ্য খাবারের প্যাকেট, প্রাঙ্গণ সাফ করতে গিয়ে পাওয়া গিয়েছিল। প্লাস্টিকের পাউচ করে লোককে জল খেতে দেওয়া হয়েছিল। পরে জলের ট্যাঙ্কার এনেও সামাল দেওয়া যায়নি। এরপর আবার একজন পরিবেশ দূষণ আদালতে ওই প্লাস্টিকের পাউচ দেওয়ার জন্য মামলা রুজু করে দিয়েছিলেন। ছাত্রীদের সঙ্গে অশোভন ব্যাবহার করা হয়েছিল। তাঁর মতে, পৌষমেলার মতোই, এই অনুষ্ঠানটি আয়োজন করার জন্য বিশ্বভারতীকে আলাদা কোনও টাকা দেওয়া হয় না। কোনও রোজগার হয় না। অন্য খাতের টাকা খরচ করতে হয়।

মেলা খরচ, ঝামেলা, তাছাড়া বিশ্বভারতীর পক্ষে এত বড় একটা ইভেন্ট সামলানো সম্ভব নয় বলে, কোভিড পরবর্তী সময়েও তাঁর কার্যকালে তিনি আর এই অনুষ্ঠান আয়োজন করতে চাননি।

২০২০ থেকে শুরু করে ২০২৩ অবধি তাই, সর্বসাধারণের জন্য এই অনুষ্ঠানটি আয়োজিত হয়নি। ছাত্র ছাত্রীদের নিয়ে হয়েছে, ছোট মাপে।

এই বছর অবশ্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তী নেই। কিন্তু এই বারও আয়োজন করা হয়নি। ব্যবসায়ীরা, সংস্কৃতিবান পর্যটকরা, হয়তো ক্ষুণ্ণ। কিন্তু মনে হয়, বিদ্যুৎ চক্রবর্তী যে প্রশ্নগুলি তুলে অনুষ্ঠানের আয়োজনে বিশ্বভারতীর অপারগতার কথা জানিয়েছিলেন, সেগুলির একটা মীমাংসা না হওয়া অবধি, অন্য কোনও উপাচার্য জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে অনুষ্ঠানটি আয়োজন করার দায়িত্ব নিতে চাইবেন না।

( কৃতজ্ঞতা …কিছু তথ্যের জন্য মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় লেখা প্রবন্ধ, শান্তিনিকেতনে বসন্ত উৎসব,
বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর লেখা My Fourth Missive 10th July 2020
এবং গুগল )

অলংকরণ- রাতুল চন্দরায়