সুজিত সাহা

মাত্র পনেরো বছর বয়সে ফিল্ম ফেয়ার অ্যাওয়ার্ড! এখনও যা রেকর্ড। তবুও তাঁর কথায়, সঙ্গীত ছিল শুধুমাত্র শখ। স্বয়ং রাজ কাপুর তাঁর ‘হেনা’ সিনেমায় অভিনয়ের জন্য দিতে চেয়েছিলেন ব্ল্যাঙ্ক চেক। তবুও অভিনয়ে তাঁর কোন আগ্রহ ছিল না। ‘ডিসকো দিওয়ানে ‘ অ্যালবাম বেরনোর দিন ভারতে বিকিয়েছিল লক্ষাধিক। আপ জ্যায়সা কোই … লাইনটা শুনলেই রক্তে এখনও উত্তেজনার স্রোত বয়ে যায়। আশির দশকে বেড়ে ওঠা মানুষদের কাছে নামটা বলে দিতে হবে না। হ্যাঁ, নাজিয়া হাসান। স্বল্পায়ু অসম্ভব প্রতিভাময়ী একজন গায়িকা, সঙ্গীত রচয়িতা এবং সমাজকর্মী। যার সুরের জোয়ারে ভেসে গিয়েছিল সমগ্র ভারত তথা দক্ষিণ এশিয়া। তিনি ছিলেন প্রথম দক্ষিণ এশীয় পপ স্টার।

এই প্রজন্মের অনেকের কাছে নামটা হয়তো অজানা। তবুও নির্দ্বিধায় বলা যায়, নাজিয়া হাসানের মতো অননুকরণীয় কণ্ঠস্বর ভবিষ্যতের শ্রোতারাও মনে রাখবেন । অদ্ভুত মাদকতাময় এক মায়াবী কণ্ঠ। মাত্র ৩৫ বছর ভূ-পর্যযটনে এসেছিলেন। এমন কণ্ঠস্বর— যার জন্য কোন তালিমের প্রয়োজন হয়নি। পরীর মতো রূপ নিয়ে আক্ষরিক অর্থে যেন ‘ ঘুরতে’ এসেছিলেন এই পৃথিবীতে।

জন্ম ৩ এপ্রিল, ১৯৬৫। পাকিস্তানের করাচিতে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। বাবা বসির হাসান ছিলেন বিশিষ্ট শিল্পপতি। মা মুনিজা বসির ছিলেন একজন সমাজকর্মী। ভাই-বোন জোহেব এবং জারাও বেশ পরিচিত। বিশেষ করে বলতে হবে, জোহেব হাসানের কথা। নাজিয়ার সঙ্গীত সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল ভাইকে নিয়ে। জোহেব একজন অসম্ভব প্রতিভাবান সঙ্গীত শিল্পী। মনে প্রাণে গান ভালবাসতেন। বিনা বাদ্যযন্ত্রেই রচনা করতে পারতেন সুর। হাতের সামনে যা পেতেন তা-ই হয়ে উঠত বাদ্যযন্ত্র। আর একজন সুরকারের কথা উল্লেখ করতে হবে, তিনি বিড্ডু আপ্পাইয়াহ। লন্ডনবাসী ভারতীয় বংশোদ্ভূত সুরকার। সঙ্গীত জগতের প্রতিটি মানুষ বিড্ডুর প্রতিভাকে কুর্নিশ করে। বিড্ডুর সুর ঝর্না হয়ে ঝরে পড়েছিল নাজিয়ার কন্ঠে। রচনা হয়েছিল ইতিহাস, আপ জ্যায়সা কোই …। ‘ বুম বুম ‘ অ্যালবামটিতেও ছিল বিড্ডুরই সুর।

অসংখ্য সুযোগ এলেও নাজিয়া কোনওদিন সিনেমায় অভিনয় করেননি। তাঁর জীবনটাই যেন ছিল একটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি।

পড়াশোনা এবং বেড়ে ওঠা লন্ডনে। লন্ডনের রিচমন্ড আমেরিকান ইউনিভার্সিটি থেকে বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ও ইকনমিক্সে স্নাতক। লন্ডন ইউনিভার্সিটি থেকে এলএলবি । ১৯৯১ সালে নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে দু’বছর কাজ করেছিলেন। ঠিক যেন প্রিজমের মতো জীবন! যে পৃষ্ঠে আলো পড়েছে ঝলমল করে উঠেছে। পাহাড় প্রমাণ সাফল্য পেয়ে গিয়েছিলেন মাত্র একটি গান করে। পপস্টারের মোড়কের আড়ালে নাজিয়ার ব্যক্তিগত জীবন ছিল অত্যন্ত সহজ, সাদামাটা। জীবনে বাঁচতে চেয়েছিলেন অতিসাধারণ মানুষ হয়ে। একজন মা-মেয়ে- বোনের পরিচয়ে।

মনেপ্রাণে ছিল সমাজসেবার ব্রত। সমাজকর্মী হিসেবে গায়িকা সত্তাকেও ছাপিয়ে গিয়েছিলেন। গান গেয়ে যে অর্থ উপার্জন করেছিলেন, তার অধিকাংশই দান করে গেছেন দুঃস্থ শিশুদের জন্য। জড়িয়ে ছিলেন বিভিন্ন সেবামূলক সংস্থার সঙ্গে। মানসিক ভাবে আপাদমস্তক সমাজকর্মী ছিলেন। পপ সম্রাজ্ঞী হয়েও গ্ল্যামারের খোলস হেলায় ত্যাগ করেছিলেন। মানুষ নাজিয়া গায়িকা থেকেও ছিলেন অনেক বড়। গঠন করেছিলেন BAN ( Battle Against Narcotics )। কাজ করেছিলেন Unicef -এর হয়েও। গরিব শিশুদের উন্নতির জন্য গঠন করেছিলেন তহবিল। মৃত্যুর পরও সেই ইচ্ছা বেঁচে রয়েছে ‘ নাজিয়া হাসান ট্রাস্ট ‘- এর মাধ্যমে। ২০০৩ সালে তাঁর মা, ভাই ও বোনের হাতে গড়ে উঠেছিল এই সংস্থা।

তবে নাজিয়ার যে গানে ভুবন মাতলো, সেটা ছিল নিছকই এক দুর্ঘটনা। গল্পটা অবশ্যই বলা উচিত। বলিউড অভিনেত্রী জিনাত আমান ছিলেন মুনিজা বসিরের বান্ধবী। সেই সূত্রেই লন্ডনের বাড়িতে শুনেছিলেন নাজিয়ার গান। নাজিয়া গিটার বাজিয়ে গান করতে পারতেন। জিনাত চমকে গিয়েছিলেন কণ্ঠ শুনে। সেই সময় ফিরোজ খান ‘কুরবানি ‘ সিনেমার জন্য খুঁজছিলেন সম্পূর্ণ নতুন এক কণ্ঠ। নাজিয়ার জাদু কণ্ঠ ব্যবহার করার জন্য প্রস্তাব দিয়েছিলেন জিনাত। ফিরোজ-জিনাত-বিড্ডু যোগে তৈরি হল, আপ জ্যায়সা কোই …। রক্ষণশীল পরিবারে বাবার মত ছিল না, মেয়ে ফিল্মে গান করুক। মা’র জোড়াজুড়িতে নাজিয়া শেষমেষ গান করেন। চোদ্দ বছরের স্কুলছাত্রী। স্কুল ছুটির ফাঁকে লন্ডনে মাত্র দু’দিনে রেকর্ডিং হয়ে যায়। গান গাওয়ার পর পরিবারের সবাই ভুলে গিয়েছিলেন। কিন্তু ‘কুরবানি’ রিলিজ হওয়ার পর নাজিয়ার কণ্ঠ ভারতীয় উপমহাদেশে আলোড়ন ফেলে দেয়।

এরপর নিজের তোলা ঢেউয়ে ভেসে যান গানের সমুদ্রে। যতই না চান গান তাঁকে তাড়া করে বেরিয়েছে। ১৯৮১- তে বের হয় ‘ডিস্কো দিওয়ানে’। হিন্দি পপ সঙ্গীতের মাইলস্টোন। চুরমার হয়ে যায় সমস্ত রেকর্ড। এটাই ছিল প্রথম ভারতীয় ভিডিও অ্যালবাম। সুনামির মতো যা ছড়িয়ে পড়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ, সাউথ আফ্রিকা এমনকি রাশিয়া পর্যন্ত। বের বয়েছিল ইংরেজি ভার্সন — ‘ ড্রিমার দিওয়ানে ‘। এরপর ‘বুম বুম’। বিড্ডুর সুর। জোহেবের সঙ্গে’ ইয়ং তরং ‘ (১৯৮৪)। হট লাইন (১৯৮৭)। শেষ অ্যালবাম ক্যামেরা ক্যামেরা (১৯৯২)। আগেই ঘোষণা করে দিয়েছিলেন, এটাই শেষ অ্যালবাম। এরপর নাজিয়া গানের জীবনে সম্পূর্ণ দাড়ি টানেন।

১৯৯৫ সালের ৩রা মার্চ মির্জা ইশতিয়াক বেগ নামে এক ব্যবসায়ীকে বিয়ে করেন নাজিয়া হাসান। তবে তাঁর বৈবাহিক জীবন ছিল দুঃস্বপ্নের মতো। পরে জানা যায়, এটা ছিল মির্জার তৃতীয় বিবাহ। বিয়ের দু’বছরের মাথায় একমাত্র পুত্র আরেজ হাসানের জন্ম হয়।

নাজিয়ার মাত্র ৩৫ বছরের জীবনে শেষ পর্ব ছিল ভয়ঙ্কর। ফুসফুসে বাসা বাঁধে মারণ কর্কট রোগ। মৃত্যুর আগে ভাই জোহেবকে বলেছিলেন, তিনি দুটো ক্যান্সারের সঙ্গে লড়ছেন। একটি বিবাহ, দ্বিতীয়টি রোগ। সেই কারণে হয়তো দেহের সঙ্গে হার মানে মনও। ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে থাকেন মৃত্যুর দিকে। ভর্তি করা হয় নর্থ লন্ডন হসপাইস -এ। দিনটা ছিল ১৩ অগস্ট ২০০০। এত সুর আর এত গান থেমে যায়। মৃত্যুর আগে নাজিয়ার বয়ান অনুযায়ী, তাঁর নাকি ক্যান্সার নির্মূল হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তাঁর স্বামী খাবার আর চায়ের সঙ্গে আর্সেনিক মিশিয়ে দিতেন। সেই কারণেই নাকি তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন।

অন্তিম সংস্কার বন্ধ করে নাজিয়া হাসানের দেহ সংরক্ষণ করে রাখা হয় টানা পাঁচ মাস। তদন্তে নামে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড। মৃত্যুর পাঁচ মাস পর, ২০০১ সালের ৭ জানুয়ারি দেহ হস্তান্তর করা হয় পরিবারের হাতে। তদন্তে অবশ্য স্বাভাবিক-মৃত্যুই প্রমাণিত হয়েছিল। মৃত্যুর কারণ বলা হয়— ডিপ ভেইন থ্রম্বোসিস এবং বাম ফুসফুসে কার্সিনোমা। শেষ পর্যন্ত শান্তির শয়ান মেলে লন্ডনের হেন্ডন কবরস্থানে।

এপিটাফে কোথাও তাঁর গায়িকা সত্তার পরিচয় নেই। লেখা আছে, A LOVING DAUGHTER SISTER AND MOTHER— WHO WAS LOVED AND CHERISHED BY MILLIONS OF PEOPLE.

অলংকরণ- রাতুল চন্দরায়