সঞ্জয় গুপ্ত

এরকম ফোন পেলে কিন্তু চমকে যাওয়ারই কথা।

২০২৩ সালের ১২ অক্টোবর , হরিয়ানার ফরিদাবাদ শহরের ২৩ বছর বয়সি এক যুবতীর কাছে একটি ফোন এসেছিল। লখনউ থেকে একজন কাস্টমস অফিসার তাঁকে ফোন করেছে। মেয়েটিকে সেই অফিসার জানালো, কাস্টমস একটি পার্সেল আটক করেছে— যার মধ্যে প্রচুর পরিমাণে জাল পাসপোর্ট ও ক্রেডিট কার্ড পাঠানো হচ্ছিল। আর এতে ব্যবহৃত হয়েছে ওই যুবতীর আধার কার্ড। তাঁকে বলা হলো, তিনি যেন শিগগিরই পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেন, অন্যথায় লখনউয়ের কোর্টে আসতে হবে।

একটু পরেই যুবতী একটি কল পেলেন স্কাইপে। সেখানে সেই কাস্টমস অফিসার বলে পরিচয় দেওয়া মানুষটি , তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলো আরও কয়েকজন পুলিশের উর্দি পরা লোকজনের সঙ্গে। পুলিশের উর্দি পরা একজন লোক যুবতীকে জানালো, ইতিমধ্যেই তাঁর নাম এফআইআর রুজু করা হয়েছে। লোকটি আরও জানালো , তারা একজন ব্যাঙ্ক ম্যানেজারকে অ্যারেস্ট করেছে, যার বিরুদ্ধে মানুষ পাচার করার অভিযোগ রয়েছে। মেয়েটি সেই ম্যানেজারের সহযোগী হিসেবে কাজ করেছে বলেও তাদের কাছে খবর রয়েছে।

ওই লোকেরা আরও কয়েকটি অভিযোগনামা পড়ে শোনাল, যেখানে বেশ কিছু মানুষ অভিযোগ করেছেন, ওই যুবতী তাঁদের থেকে টাকা নিয়েছেন তাদের সন্তানদের পাচার করার জন্য। সব মিলিয়ে তিনি প্রায় ৩.৮০ কোটি টাকা নিয়েছেন ওদের কাছ থেকে।

এরপর একজন লোক স্কাইপ কলের মাধ্যমেই নিজের পরিচয় দিলো সিবিআই অফিসার হিসেবে। জানাল, ওই তিন কোটি আশি লাখ টাকার পাঁচ শতাংশ জমা দিতে হবে মেয়েটিকে। যুবতী নিজের অপারগতার কথা জানাবার পর, সেই লোকটি বলল, তারা মেয়েটিকে ডিজিট্যাল ভাবে অ্যারেস্ট করছে!

যুবতী এই সময় আড়াই লক্ষ টাকা ওদের দেওয়া একটি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করেছিল জামিনের টাকা হিসেবে। ওরা প্রচুর জোর করছিল, যুবতীর বাবার এটিএম কার্ডের বিশদ বিবরণ দিতে। বেশ কিছুদিন চেষ্টার পর, যখন সফল হলো না, তখন মেয়েটিকে তারা জানালো, ডিজিটাল অ্যারেস্ট থেকে যুবতীকে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। মেয়েটি স্কাইপ অ্যাকাউন্ট থেকে লগ আউট করতে পারে।

ওই লোকগুলি, মেয়েটিকে সব সময় স্কাইপ কলটি চালিয়ে রাখতে বলেছিল। সব মিলিয়ে এই ভাবে সতেরো দিন ডিজিটাল ভাবে অ্যারেস্ট হয়ে রইলেন যুবতী। ওপারে থাকা লোকগুলি ওই যুবতীকে বারবার সাবধান করে দিয়েছিল, অ্যারেস্ট করার ব্যাপারটি সে যেন কাউকে না বলে।

আর আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, এই সতেরো দিন মেয়েটির পরিবারের লোকেরাও কিছুই বুঝতে পারেননি। তাঁরা ভেবেছিলেন, মেয়েটি অনলাইনে কাজ করছে।

এটা অবশ্য একমাত্র ঘটনা নয়।

দিল্লির উপকন্ঠে উত্তরপ্রদেশের নয়ডায় এক ভদ্রমহিলা IVR কল পেলেন ২০২৩ সালের নভেম্বর মাসের ১৩ তারিখে। ৫০ বছর বয়সি ওই মহিলা কর্মসূত্রে ইঞ্জিনিয়ার। তাঁকে জানানো হলো, তাঁর আধার কার্ড ব্যাবহার করে মুম্বইয়ে একটি সিম কার্ড কেনা হয়েছে অপরাধমূলক কাজের জন্য। কলটি এরপর ট্রান্সফার করা হলো আরও একজনের কাছে, যিনি নিজের পরিচয় দিলেন মুম্বইয়ের একজন পুলিশ অফিসার হিসেবে। ভদ্রমহিলাকে যাকে বলে পুলিশি ভাষায় জিজ্ঞাসাবাদ করা, সেভাবে বেশ কিছুক্ষণ জেরাও করলেন। জানালেন, অভিযোগ হচ্ছে, ভদ্রমহিলা একজন বিমান কোম্পানির মালিককে বেনামী টাকা পাইয়ে দিয়েছেন। এর পর মহিলাকে জানানো হলো, একজন সিবিআই অফিসার তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন। এমনকি, তাঁকে সেই অফিসারের স্কাইপ আইডি অবধি দেওয়া হলো যোগাযোগ করার জন্য। সেই সিবিআই অফিসার জানালেন, মহিলার নামে থাকা ডেবিট কার্ড পাওয়া গিয়েছে ওই বিমান কোম্পানির মালিকের বাড়ি সার্চ করে। সুপ্রিম কোর্ট থেকে মহিলার নামে ওয়ারেন্ট অবধি বেরিয়ে গিয়েছে।
সকাল সাড়ে নটা থেকে রাত আটটা অবধি ভদ্রমহিলাকে এই সব বলে আটকে রাখা হয়েছিল ভিডিও কলে। বলা হয়েছিল, তাঁকে ডিজিটাল ভাবে অ্যারেস্ট করে রাখা হয়েছে।

তারপর যা হয়।

এই তদন্ত থেকে নাম কাটিয়ে দেওয়ার জন্য ভদ্রমহিলাকে বলা হলো বেশ কিছু টাকা দিতে। সেটা অবশ্য ঠিক টাকা চাওয়ার ভঙ্গিতে চাওয়া হয়নি। ওই সিবিআই অফিসারের ভেক ধরা লোকটি বলেছিল, সে জানে মহিলাটি নির্দোষ। কিন্তু তাঁকে টাকা ট্রান্সফার করতে হবে একটি অ্যাকাউন্টে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী। সেই টাকা তিনদিনের মধ্যে তাঁকে ঘুরিয়ে দেওয়া হবে, অডিটররা হিসাব মিলিয়ে দেওয়ার পর। টাকা কম থাকায়, তাঁকে বলা হলো একটি পার্সোনাল লোন নিতে। সব মিলিয়ে প্রায় ১১ লক্ষ ১১ হাজার টাকা দিতে হলো ভদ্রমহিলাকে। লোকগুলি আরও বলেছিল, ব্যাপারটির সঙ্গে ‘National Security’ জড়িত রয়েছে। তাই কাউকে ব্যাপারটি না জানাতে।
তিনদিন পর টাকা যখন ফেরত এলো না, লোকগুলির দেওয়া ফোন নম্বরে যোগাযোগ করা গেল না, তখনই ভদ্রমহিলা পুলিশে প্রথম যোগাযোগ করলেন।

তবে সবসময় অপরাধীদের ভাগ্য ভালো থাকে না। এয়ার ইন্ডিয়ার প্রাক্তন কর্মী, ৬৫ বছর বয়সি অঞ্জনা চক্রবর্তীর কাছে ফোন এসেছিল। জানানো হয়েছিল, তিনি নাকি জন ডেভিড ছদ্মনামে ডিএইচএল ক্যুরিয়ার কোম্পানির মাধ্যমে যে প্যাকেট পাঠিয়েছেন তার মধ্যে ড্রাগস পাওয়া গিয়েছে। মুম্বই কাস্টমস তাঁকে খুঁজছে। ভিডিও কল চলাকালীন তাঁকে আবার একটি ঘর দেখানো হয়েছিল, যেখানে ইউনিফর্ম পরা দু চারজন লোক ছিল। ভদ্রমহিলার কাছ থেকে সব মিলিয়ে ৩৫ লাখ টাকা নিয়ে নেওয়া গিয়েছিল।

কিন্তু এই বার অভিযোগ খুব তাড়াতাড়ি, পুলিশের কাছে জমা পড়েছিল। The Intelligence Fusion and Strategic Operations (IFSO) নামে দিল্লি পুলিশের এই বিভাগটি সাইবার অপরাধীদের ধরার জন্য তৈরি করা হয়েছে। এরা কল রেকর্ড এবং ব্যাঙ্ক ডিটেইলস খুঁজে দিল্লি ও উত্তরপ্রদেশ থেকে চারজন অভিযুক্তকে খুব তাড়াতাড়ি গ্রেফতার করে ফেলেছিল। এরা একটি অর্গানাইজড অপরাধী গ্রুপের সদস্য। অসংখ্য সিম কার্ড, জাল কাগজে তৈরি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের হদিস পাওয়া গিয়েছিল এদের কাছ থেকে।
তবে কারও কারও ভাগ্য ভালো থাকে।
গত বছরের অক্টোবর মাসের ৩ তারিখে ফোন এসেছিল সাক্ষী গুপ্তা নামে এক মহিলার কাছে। ওই একই গল্প। ড্রাগস পাওয়া গেছে। সব মিলিয়ে সাত লাখ টাকা ট্রান্সফার হলো। কিন্তু ওই সাত লাখ টাকা ট্রান্সফার হওয়া মাত্রই ফোনের ওধারে থাকা মানুষজন সব যোগাযোগ বন্ধ করে দিলো। চমকিত সাক্ষী সঙ্গে সঙ্গেই ব্যাঙ্ক, পুলিশে ফোন করে টাকা ব্লক করতে অনুরোধ করলেন। কপাল ভালো, সাক্ষীর অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা বের হয়ে দ্বিতীয় অ্যাকাউন্টে পৌঁছে গিয়েছিল মাত্র। সেখানে টাকা আটকে দেওয়া হলো।
ডিসেম্বর মাসের পাঁচ তারিখে, ঠিক দু মাস পর টাকা ফেরত এলো সাক্ষীর কাছে।
এরকম ঘটনা আরও ঘটেছে। কিছু রিপোর্টেড হয়। কিছু হয় না।

তবে এগুলো আটকানোর কি কোনও উপায় নেই?

হ্যাঁ, একমাত্র উপায় হচ্ছে সাইবার ক্রাইমের রকম সকম সম্পর্কে অবহিত থাকা। অচেনা লোকের ফোন পেলেই গড় গড় করে সব কথা বলে না দেওয়া আর ফোন সময় মতো নামিয়ে রাখতে জানা।

যাঁরা সাইবার ক্রাইমের শিকার হন, তাঁদের অধিকাংশই কিন্তু ‘লেখাপড়া না জানা’ সেই কোটি কোটি ভারতবাসীদের মধ্যে পড়েন না। তাঁরা যথেষ্ট পড়াশুনা করা, আধুনিক জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত মানুষজন।
নাকি আমরা ভুল জানি। আসলে এই মানুষদের ব্যবহারিক জীবনের জ্ঞান একদম শূন্য।

অলংকরণ- রাতুল চন্দরায়