সৈয়দ রেজাউল করিম

(খাকি উর্দি গায়ে কয়েক যুগ চষে বেড়িয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্ত। রাজ্যের বিভিন্ন থানা ও ক্রাইম ব্রাঞ্চে কাজ করতে গিয়ে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাই হয়ে উঠেছে সৈয়দ রেজাউল করিমের লেখালেখির রসদ।)

 

যুগ অনেক বদলে গেছে। আগে গাঁয়ে গঞ্জে কোনও আচার-অনুষ্ঠান, বিয়ে-সাদি হলে ফাঁকা জায়গায় প্যান্ডেল বেঁধে সেই কাজ সম্পন্ন হতো। কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে সেই ফাঁকা জায়গা ক্রমশ কমে গিয়েছে। কিন্তু আচার অনুষ্ঠান তো থেমে থাকার বস্তু নয়, তাহলে তা হচ্ছে কোথায়? সে সমস্যার সমাধানও করে নিয়েছে মানুষজন। তারা এখন বিভিন্ন অঞ্চলে অধিক পরিচিত জায়গায় বিয়েবাড়ি, অনুষ্ঠানগৃহ, হোটেল ইত্যাদি তৈরি করে রেখেছে। যেগুলি ভাড়ার বিনিময়ে আগ্রহী লোকজন নিতে পারে। শহরাঞ্চলে তার আধিক্য অনেক বেশি।

মেয়ের বিয়েতে অতিথি আপ্যায়ণ করা, খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থার জন্য বালুরঘাট থানার পাশে একটা হোটেল ভাড়া করে রেখেছে সাধনবাবু। দুপুর থেকে শুরু হয়েছে জিনিসপত্র নিয়ে যাওয়ার কাজকর্ম। প্রায় তিনশো অতিথির অ্যারেঞ্জমেন্ট। ক্যাটারারদের কাছে সেই দায়িত্ব দিয়ে রেখেছে সাধনবাবু। একেবারে সন্ধ্যালগ্নে বিয়ে। প্রতিবেশী হিসেবে সুচরিতাদি তাই আগেভাগেই চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হল। বিয়ের কাজকর্ম করবে বলে। যাওয়ার আগে কাপ চারেক চা বানিয়ে ফ্লাস্কে ভরে দিয়ে রাখল। যাতে ইত্যবসরে আমাদের চা পানে কোনও ব্যাঘাত না ঘটে। সেই সাথে সতর্ক করতে বলল– ঠিক আটটা নাগাদ বিয়ে বাড়িতে পৌঁছে যেতে। যাতে প্রথম ব্যাচে আমরা খেয়ে নিতে পারি।

আমরা তথাস্তু বলে বিদায় করলাম সুচরিতাদিকে। তারপর ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা করছিলাম। আচমকা যোগেশবাবু বললেন– তুমি তো গল্প উপন্যাস ভালো লিখছো দেখছি। কিন্তু গল্পের কাঠামো কেমন হওয়া উচিত সে সম্পর্কে কি তোমার সম্যক ধারণা আছে?

আমি বললাম– এ ব্যাপারে তো রবিঠাকুর একটা ধারণা দিয়ে গেছেন আমাদের। ছোট ছোট কথা…।

আমার বিদ্যের দৌড় বুঝতে পেরে যোগেশবাবু বললেন, আমি তোমাকে ক’টা কথা বলি, মনে রেখো। পরবর্তীতে কাজে দেবে। আসলে চিন্তাই হল সাহিত্য। সাহিত্য হল দর্শন। সাহিত্য হল সঠিক ইতিহাস। সেই যুগের, সেই কালের। তবে সাহিত্যিক যতই কল্পনার আকাশে বিচরণ করুক না কেন, যতই সমাজ সংসারের প্রতি নিরাসক্ত থাকুক না কেন, তাঁর চেতন বা অবচেতন মনে সমকালীন ঘটনাপ্রবাহ স্থান করে নেয়, যা ফুটে ওঠে তাঁর রচনায়। তাতে দেখা যায় সাহিত্যিকের সামাজিক দায়বদ্ধতা ও আনুগত্য…।

একথা বলে থামলেন যোগেশ স্যার। দেওয়াল ঘড়ির দিকে আড়চোখে তাকিয়ে দেখলেন। আমি বিস্ময়ে তাকিয়েছিলাম তাঁর মুখের দিকে। এমন কোনও ব্যাপার নেই, যা তিনি জানেন না। সে পরিচয় যে একেবারে আমাদের অজানা, তা নয়। কর্মজীবনে তাঁর সে পরিচয় আমরা পেয়েছি। তা বলে সাহিত্য?

হঠাৎ স্যারের মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল। স্ক্রিনে নাম দেখে স্যার বললেন– সুচরিতা ফোন করেছে, রেডি হয়ে নাও।

ফোন ধরে যোগেশ স্যার বললেন– আমরা আসছি।
এমনিতে আমরা রেডি হয়েই বসেছিলাম। বিলম্ব না করে ঘরে তালা-টালা দিয়ে তাই বেরিয়ে পড়লাম। মাত্র মিনিট দুয়েকের পথ সুচরিতাদির বর্তমান কোয়ার্টার থেকে। তাই দ্রুত পৌঁছে গেলাম বিয়েবাড়িতে। সুচরিতাদি দু’টো সিট ধরে রেখেছিল। তাই একদম দেরি হল না। অন্যন্য অতিথির সঙ্গে আমরা বসে গেলাম খেতে।

খাওয়া তখনও শেষ হয়নি কারও। শেষপাতে দই মিস্টি চাওয়ার হিড়িক ছাপিয়ে হঠাৎ একটা বচসার সুর কানে ভেসে এলো। তাকিয়ে দেখি, আমাদের টেবিল ছাড়িয়ে দুটো টেবিল পরে দুই মহিলা কিছু একটা নিয়ে উচ্চস্বরে বচসা করছে। আমাদের সবার চোখ আছড়ে পড়ল সেদিকে। তাদের দু’জনকে আমরা চিনি না। বিয়ে বাড়িতে কত লোকজনের আনাগোনা হয়, সবাইকে কি চেনা সম্ভব?

কী নিয়ে তাদের হাতাহাতি, চুলোচুলি, বচসা তা বোঝার জন্য কান পাততে বাধ্য হলাম আমরা। তাদের রোষান্বিত কথাবার্তা, গালাগালি থেকে বোঝা গেল দু’ জনই অন্ধগলির পূর্ববাসিন্দা। সন্ধ্যার আমন্ত্রণে তারা নিমন্ত্রণ রক্ষার্থে এসেছে। সেজেগুজে,পরিপাটি হয়ে। বিয়েবাড়ির এক নিমন্ত্রিত যুবক অতিথি হঠাৎ তাদের টেবিলের কাছে এসে একজনের উদ্দেশে বলল— সাবিত্রী! আজকাল তোমাকে পাড়ায় দেখি না কেন? তুমি কি অন্য কোথাও…।

যুবকের সেই অবাঞ্ছিত প্রশ্নে অস্বস্তির মধ্যে পড়ে যায় সাবিত্রী ওরফে বাসন্তী। একযুগের বেশি বই কম নয়, পাড়ামুখো হয়নি সে। একসময় তার কুঠরিতে প্রায় রোজই নাচ, গান-বাজনার আসর বসতো, কত লোকজনের আনাগোনা ছিল, তাদের ক’জনকে মনে রাখা সম্ভব?

সাধনবাবু ও সন্ধ্যা তাকে একজন মনের মানুষ খুঁজে দিয়েছিল। সুজনকে বিয়ে করে সুখে ঘরসংসার করছিল সে। কিন্তু লোকটা চলে গেল অকালে। তার পরে পঙ্কিল পথে আর পা বাড়ায়নি। ঘৃণ্য অতীতটাকে মন থেকে বিদায় দিয়েছে অনেকদিন। আজ সে কথা আর মনে করতে চায় না বাসন্তী। তাই দায় এড়াতে অবলীলাক্রমে সে বলল– আপনি আসুন, আপনাকে আমি চিনি না।

– এখন আর চিনতে পারবি কি করে? এখন তো আমার নাগরের সাথে ফস্টিনস্টি করে দিন কাটছে তোর। গরিব খদ্দেরের কথা মনে পড়বে কি করে?

বেশ তির্যক সুরে মনের মধ্যে জমে থাকা গরল উগরে দিল কল্পনা। অন্ধগলিতে একসঙ্গে জীবনযাপনের সময় সে ছিল বাসন্তীর অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী। আজও বাসন্তীকে সেই পর্যায়ে পর্যবসিত করতে বিন্দুমাত্র বাধল না তার।

ব্যাপারটা ক্রমশ ঘোরালো হয়ে যাচ্ছে দেখে নিমন্ত্রিত সেই অতিথি পায়ে পায়ে সরে পড়ল সেখান থেকে।

কিন্তু বাসন্তী ও কল্পনার বাকবিতন্ডা থামার নাম নেই। হঠাৎ কল্পনা একটা কাণ্ড করে বসল। এক হ্যাঁচকায় বাসন্তীর সিল্ক শাড়ির আঁচলটা ধরে টান দিল। আর সেই টানে হড়হড় করে শাড়িটা খুলে পড়ল বাসন্তীর শরীর থেকে। লোকজনের সামনে নিজের নগ্নতা দেখে ভীষণ লজ্জা পেল এককালের দেহপসারিনী। আব্রু রাখতে দু’হাত ভাঁজ করে বসে পড়ল সেখানে। আকাশে চিল উড়তে দেখলে মা মুরগি ঠিক যে ভাবে তার ছানাদের ডানার মধ্যে লুকিয়ে রেখে একজায়গায় বসে পড়ে— ঠিক সে ভাবেই বসে পড়ল বাসন্তী।

(ক্রমশ)

অলংকরণ- রাতুল চন্দরায়

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here