সুখেন্দু হীরা

(আইপিএস সুখেন্দু হীরা বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল (নিরাপত্তা)। প্রতারণার নানা কাহিনি ধারাবাহিক ভাবে তিনি তুলে ধরছেন বালিহাঁস-এর পাতায়।)

অমলকান্তি পুলিশ হতে চেয়েছিল। অমল থাকে পশ্চিম মেদিনীপুরের পিংলা থানার এক গণ্ডগ্রামে, পুলিশ হবে বলে ছোটাছুটিতে কোনও দিন সে ক্ষান্ত দেয়নি। সেই সঙ্গে গ্রেজুয়েশনটাও করে নিয়েছিল। ইতিমধ্যে এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ থেকে রাজ্য পুলিশে ভর্তির পরীক্ষার অংশগ্রহণ করার ডাক পায়। ওর সঙ্গে পাড়াতুতো এক দাদাও ‘কল’ পায়। দাদা বলে, “যাবি একজনের কাছে? ‘তেনা’র নাকি হাত আছে লম্বা, চাকরি-বাকরি দেওয়ার ব্যাপারে। ওপর মহলে অনেকের সঙ্গে ‘তেনা’র ওঠা বসা!”

অমলকান্তি ‘তেনা’র নাম শুনেছিল। ভদ্রলোক পিংলা থানা এলাকার জামনা গ্রামে থাকেন। রাজপ্রাসাদের মতো বাড়ি। ঘরের মধ্যে বিখ্যাত বিখ্যাত ব্যক্তিদের সঙ্গে তোলা ছবি বড় বড় করে বাঁধানো। যে এই বিখ্যাত ব্যক্তিদের সঙ্গে ‘তেনা’র ছবি দেখবে, তাঁদের ‘তেনা’র প্রতি সম্ভ্রম জাগবেই। তারপর বাড়ির সামনে প্রায় ঝকঝকে চকচকে গাড়ির লাইন লেগে থাকে। গ্রামে সবাই বলাবলি করে ‘তেনা’র বাড়িতে প্রায় ডিএম, এসপি আসেন। আসেন অন্যান্য বড় বড় অফিসার। এরকম লোক চাকরি দেবে না তো কে দেবে?

কিছু ছেলে হয়তো ‘তেনা’র সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। তিনি বললেন, ওমুক দিন আমার বাড়িতে এসো। চাকরিপ্রার্থী ছেলেরা গেল যথাসময়ে। কিছুক্ষণ বাদে বাড়িতে একটা লাল বাতি লাগানো গাড়ি এসে ঢুকলো। বাড়িতে শোরগোল পড়ে গেল। কি ব্যাপার? স্কুল সার্ভিস কমিশনের পশ্চিমাঞ্চলের চেয়ারম্যান এসেছেন। উপস্থিত ছেলেগুলো ‘স্কুল সার্ভিস’-এর কৃপাপ্রাপ্তি। আর যায় কোথা?

অমলকান্তি পরে সব জেনেছিল, এগুলো সব সাজানো। কিন্তু ততদিন
অমলকান্তির যা ক্ষতি হবার হয়ে গেছে। অমলকান্তি পাড়ার দাদার সঙ্গে ‘তেনা’র দেখা করতে যায়। কথাবার্তা হয়। প্রথমে কিছু টাকা। আর চাকরি পেয়ে গেলে বাকি টাকা। কোনও অসুবিধা নেই। সুন্দর ব্যবস্থা! চাকরি পেয়ে গেলে তারপর সিংহভাগ টাকা দিতে হবে, এর থেকে ভালো প্রস্তাব আর কি হতে পারে?

কিন্তু অমলকান্তি পরে জেনেছে, ‘তেনা’র সঙ্গে যোগাযোগ করে যারা চাকরি পেয়েছে, তারা নিজের যোগ্যতায় পেয়েছে। ‘তেনা’র কোনও হাত ছিল না। মাঝখান দিয়ে ‘তেনা’ নেপোর মত দই মেরে দিয়েছেন।

অমল ভেবেছিল, মাঠ কমপ্লিট করে দিলে আর ওকে কে আটকাবে? কনট্রাক্ট তো হয়ে গেছে। ফলে অমলকান্তি বাকি প্রস্তুতিতে একটু ঢিলা দিয়েছিল। যেমন লেখা পরীক্ষার জন্য পড়াশোনা ও মৌখিক পরীক্ষার জন্য সাধারণ জ্ঞানের ভাণ্ডার বৃদ্ধি। তাই যা হবার তাই হল, অমলকান্তি পুলিশ হতে পারল না। অমলকান্তির পাড়াতুতো দাদা চাকরি পেয়ে গেল। একই চুক্তিতে একজন পেল আর একজন পেল না। এই চুক্তি ভঙ্গের কারণে এলাকায় সামান্য গোলযোগ হল, কিন্তু অমলকান্তির দাদাকে টাকা দিতে হল। আর অমলকান্তি কিছু পেল না। পরের বার দেখা যাবে বলে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বাড়ি পাঠানো হ’ল। অমলকান্তি এখন খরিদ্দার বাড়াতে চায়, কারণ বাড়িতে সে এখন একটা মুদি দোকান দিয়েছে।

যারা এরকম চাকরি করে দেবে বলে প্রচার করে, তারা ‘তেনা’র মত এলাকার একটা কৃত্রিম প্রভা ছড়িয়ে রাখে। যাতে লোকজন সহজেই তার স্তোক বাক্যে আকৃষ্ট হয়। বাড়িতে নামকরা লোকেদের ছবি রাখা, বিভিন্ন পদস্থ ও প্রভাবশালী লোকেদের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া, সর্বসমক্ষে সেইসব ব্যক্তিদের সঙ্গে কথাবার্তা বলা। হালে যুক্ত হয়েছে ফেসবুকে সেইসব ব্যক্তির সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখা। অর্থাৎ ‘তেনা’দের ফেসবুকের ফ্রেন্ডলিস্টে বিখ্যাত ব্যক্তিদের নাম দেখতে পাওয়া যায়।

আগেও বলা হয়েছে ‘তেনা’দের মতো লোকের মুখের কথা হয় খুব মিষ্টি। কখনোই তারা বলে না, ‘তোমার চাকরি হবে না, তোমার চাকরি করতে পারবো না, এবার হয়নি তো কী হয়েছে, পরের বার হবে।’ চাকরির বয়স চলে গেলে তখনও বলবে না, ‘তোমার টাকা ফেরত দেবো না।’ বলবে, ‘পরে দেবো, আস্তে আস্তে দেবো।’ খুব চাপাচাপি করলে দশ শতাংশ টাকা দিয়ে বলবে, ‘বাকিটা কিস্তিতে দেবো।’ পরের কিস্তি দেওয়ার সময় আর হবে না। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি প্রশাসনের দ্বারস্থ হলে, প্রশাসন থেকে তাকে ডেকে পাঠালে, ‘তেনা’র মতো ব্যক্তিরা বলে, ‘আমি তো কখনো বলিনি আমি টাকা ফেরত দেবো না’। একবার সামান্য কিছু দিলে বলবে, ‘আমি তো টাকা দিয়েছি, আমার হাতে টাকা এলেই বাকি টাকা দিয়ে দেবো।’

যদি আরও চাপাচাপি করে, ‘তেনা’র ব্যক্তিরা তখন ভয় দেখাবে, ‘তুমি যা পারো করে নাও!’ আরও বলবে, ‘এখানে বারবার এলে পুলিশ ডেকে ধরিয়ে দেবো। বলবো তুমি আমার বাড়িতে এসে ঝামেলা করেছ।’ এই প্রতারকদের প্রভাবশালী ভেবে অনেক ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্তরা পিছিয়ে যায়। আগেই বলা হয়েছে, যে ক্ষতিগ্রস্তরা টাকা দিয়েছেন, তাঁদের কাছে তেমন কোনও মজবুত প্রমাণও থাকে না। জামনার ‘তেনা’ একই ভাবে ভয় দেখাতেন।

যখন কোনও একজন প্রার্থী ‘তেনা’দের সঙ্গে যোগাযোগ করেন, তখন ‘তেনা’ বলেন, “দেখো, যদি তোমার চেনাশোনা আরও কেউ থাকে, তাহলে তোমার একটু কনসেশন হয়ে যাবে।” সেও লোভে পড়ে আরও কয়েকজনকে খুঁজে বার করে, অমলকান্তির দাদা হয়তো এই কারণে অমলকান্তিকে খুঁজেছিল। এর খারাপ ফল যেটা দেখা গেছে, সেই ‘ক্যান্ডিডেট’ চাকরি পেয়ে যাবার পরও যখন লোভ সামলাতে পারে না।

চাকরি পাবার পরেও সে আরও লোক জোগাড় করে আনে কমিশনের লোভে। অথবা সে কিছু অঙ্ক টাকা বাড়িয়ে পরবর্তী ক্যান্ডিডেটদের বলে। পরের প্রার্থীরা সহজেই তার কথা বিশ্বাস করে, কারণ প্রার্থীরা জানে, মধ্যস্থতাকারী এই ভাবেই চাকরি পেয়েছে। পরে যখন চাকরি হয় না, তখন থানায় মামলা রুজু হয়। ‘তেনা’দের মতো ব্যক্তির খুব একটা বেশি কিছু হয় না। কারণ তিনি ‘পাবলিক’ লোক, জনসাধারণ হিসাবে আইনের সুরক্ষা তিনি পান, কিন্তু সেই সরকারি কর্মচারীর পালাবার পথ থাকে না। সরকারি চাকরি বিধি এবং সরকারি চাকরির আচরণ বিধিতে সহজেই আটকে যায়। এ রকম অভিযোগে অনেক পুলিশ কনস্টেবলকে অ্যারেস্ট হতে দেখেছি।

‌ যারা এরকম ভাওতা দিয়ে চাকরি করে দেবে বলে টাকা তোলে, তাদের চাল-চলন, হাব-ভাবের মধ্যে এক বিশেষ ‘ভাও’ থাকে। তাদের টিপটপ পোশাক-আশাক, দামি গাড়ি, ‘পয়সা ওড়ানো’ স্বভাব সবার নজরে পড়ে। যেমন মঙ্গলের সেলুনে ঝিঙ্কিরহাট থেকে একটা ঝকঝকে ছেলে আসতো চকচকে দামি মোটরসাইকেল চালিয়ে। মঙ্গলের সেলুন দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার বারুইপুর রেল স্টেশনের পাশে।

ঝকঝকে ছেলেটা বলত, তার শালা স্বাস্থ্য দপ্তরে কাজ করে। তাই স্বাস্থ্য দপ্তরে তার অগাধ জানাশোনা। দু একটা চাকরি করে দেওয়া কোনও ব্যাপার নয়। মঙ্গল ভাবল, কিছু টাকা দিয়ে যদি এই পৈত্রিক ব্যবসা থেকে ছুটকারা পাওয়া যায়। ‘নরসুন্দর’ নয়, শুধু সুন্দর হয়ে বেঁচে থাকতে পারবে। টাকা দেওয়ার পর মঙ্গল বুঝতে পারে সে ঠকেছে। মঙ্গল অবশ্য এখনও ‘নরসুন্দর’ হয়ে অন্যদের ‘সুন্দর’ করে চলেছেন।

শুধু ঠাঁট-বাট নয়, হাতে রাখতে হয় নানান শ্রেণীর লোকজনকে, ছড়িয়ে রাখতে হয় দালাল। এরকম দালালের কথায় ভুলে ঠকেছিল বীরভূম জেলার মারগ্রাম থানার শিলগ্রামের অসিত। অসিতের গল্প পরের পর্বে বলি।

(ক্রমশ)

অলংকরণ- রাতুল চন্দরায়

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here