সুখেন্দু হীরা

(আইপিএস সুখেন্দু হীরা বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল (নিরাপত্তা)। প্রতারণার নানা কাহিনি ধারাবাহিক ভাবে তিনি তুলে ধরছেন বালিহাঁস-এর পাতায়।)

ছেলেবেলায় দেখেছি— যে সব জিনিস কোম্পানি থেকে মোড়কবন্দি বা প্যাকেজিং হয়ে আসতো, তার ওপর যে দামের উল্লেখ থাকতো, সেই দামের নীচে বন্ধনীর মধ্যে লেখা থাকত ‘লোকাল ট্যাক্স এক্সট্রা’। অর্থাৎ স্থানীয় কর অতিরিক্ত। এজন্য কোনও সাবান কিনতে গেলে, যদি সাবানের প্যাকেটের গায়ে লেখা থাকতো— পাঁচ টাকা ২৫ পয়সা; তাহলে কোনও দোকানদার সাড়ে পাঁচ, কোনও দোকানদার পাঁচ পঁচাত্তর, আবার কেউ কেউ ছয় টাকা নিতো। আমরা খুঁজতাম কোন দোকানদার অতিরিক্ত কর কম নেন, তাঁর কাছ থেকে জিনিস নেব।

ছাত্র অবস্থাতেই পণ্য আইনে পরিবর্তন আসতে দেখলাম। তখন দামের নীচে ব্রাকেটে লেখা হলো, সমস্ত কর সমেত অর্থাৎ ‘ইনক্লুসিভ অল ট্যাক্সেস’। অর্থাৎ পণ্য কিনতে গেলে মুদ্রিত মূল্যের বেশি দিতে হবে না। এই ব্যবস্থাপনা সত্যিই যুগান্তকারী এবং ক্রেতাসুরক্ষা প্রদায়ী। শুধু তাই নয় কোনও কোনও দোকানদার তার উপর কিছু ছাড় দিতেন। এই ছাড়ের লোভে আমরা সেই সব দোকানদার খুঁজতে থাকলাম, যাঁরা বেশি ছাড় দেবেন।

এই ছাড়ের লোভ সবার আছে। আগেই বলেছি, লোভ থাকা অন্যায় নয়। কিন্তু বেশি লোভী হলে ঠকতে হতে পারে। বিভিন্ন কোম্পানি বছরের শেষে বা পণ্যের এক্সপায়ারি ডেট শেষ হয়ে আসলে পণ্যগুলি অতিরিক্ত ছাড়ে, কখনও কখনও নামমাত্র দামে বিক্রি করে দেয়। বড় বড় কোম্পানির পোশাকের ক্ষেত্রে দেখেছি পুজোর আগে বর্ষাকালে এরকম ছাড় দিতে। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সারা বছরের অবিক্রিত মাল বেশি ছাড়ে অর্থাৎ সেল-এ বার করে দেয় বছরে শেষে চৈত্র মাসে। তাই নতুন বছর পদার্পণের আগে বাংলার সমস্ত ছোট-বড় শহরের ফুটপাত ভরে উঠে সেলের দোকানে।

খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, সেলের সব মাল ব্যবসায়ীদের পড়ে থাকা জিনিস নয়, সেলের জন্য আলাদা করে মাল তৈরি হয়। ও হরি! আমরা সস্তায় পাচ্ছি বলে একটার জায়গায় দুটো অথবা নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস সারা বছরের জন্য কিনে নিচ্ছি। শুধু পোশাকের ক্ষেত্রে নয়, অন্যান্য ‘প্রোডাক্ট’-এর ক্ষেত্রেও এই পলিসি গ্রহণ করে নানা নামী কোম্পানিগুলো।

‘একটা কিনলে একটা বিনামূল্যে’ বিভিন্ন শপিংমলে ঘুরলে দেখা যায়। অনেক ক্ষেত্রে এই ‘বাই ওয়ান অ্যান্ড গেট ওয়ান ফ্রি’ -এইসব পণ্যগুলো আলাদা করে প্যাকিং করা হয়। আপনি যদি এই পণ্যটি সাধারণ ভাবে কিনতে যান, দেখবেন সমপরিমাণ পণ্যের দাম ‘একটি কিনলে একটি বিনামূল্যে’-এর প্যাকেটের মুদ্রিত মূল্যের থেকে কম।

এই সব ছোটখাটো চমক লাগানো, লোক ঠকানো প্রচারগুলো নিয়ে জনগণ বেশি ভাবিত নয়। বরং বেশি সাশ্রয়ের আনন্দে এইসব দ্রব্য আমরা বেশি করে কিনে থাকি। এইসব বিষয়গুলো ক্রেতা সুরক্ষা আদালতে এবং দফতরে অভিযোগ আকারে আসেও না।

ব্যবসায়ীকুল বা উৎপাদকবর্গ যাতে ক্রেতা সাধারণকে ঠকাতে না পারে এবং ক্রেতাসমাজকে সুরক্ষা প্রদান করতে পারে এই জন্য সৃষ্টি হয়েছে ক্রেতা সুরক্ষা দফতর এবং ক্রেতা সুরক্ষা আদালত। এই বিভাগগুলো মহকুমা স্তর থেকে শুরু করে জাতীয় স্তর পর্যন্ত আছে।

ক্রেতা সুরক্ষা দফতরে বা আদালতে যে অভিযোগ বেশি পরিমাণে আসে তার মধ্যে প্রধান হচ্ছে গাড়িতে উল্টোপাল্টা পার্টস বা যন্ত্রপাতি লাগানো। যেগুলোতে নির্দিষ্ট মান নির্ণয়ের নির্দেশ করা নেই— সে ক্ষেত্রে এসব বেশি হয়ে থাকে। আর আছে গ্যারান্টি, ওয়ারেন্টি পিরিয়ডের জিনিস খারাপ হয়ে গেলে তার মূল্য ফেরতে বা জিনিস বদলে বা বিনামূল্যে সারাই করতে অনীহা। এগুলোর মধ্যে প্রধানত থাকে ফ্রিজ, এসি ইত্যাদি। বিভিন্ন সরকারি কোম্পানিগুলোও এক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই।

আপনি ক্রেতা সুরক্ষা আদালত ও দফতরে খোঁজ নিয়ে দেখবেন— বিমা, ব্যাংক, মেডিক্লেমের সরকারি, আধা সরকারি, বেসরকারি কোম্পানিগুলো প্রায় সমান ভাবে মানুষজনকে বিব্রত করে। সরকারি কোম্পানিগুলোর উদাসীনতা, বেসরকারি সংস্থার উপেক্ষার ফলে সাধারণ মানুষ অনেক সময় হাল ছেড়ে দেয়। অত্যাধিক ঘোরাঘুরি করে জুতোর শুকতলা ক্ষইয়ে ফেলার থেকে, যা পাচ্ছি, তাই নিয়ে সন্তুষ্ট থাকার মতবাদে অনেকে বিশ্বাসী হয়ে থেমে যায়। বেসরকারি কোম্পানিগুলো অর্থশালী হওয়ায় ভালো আইনজীবী নিয়োগ করে, নিজেদের ইচ্ছামতো তারিখ এগিয়ে পিছিয়ে নেয় প্রভাবশালী হওয়ার দরুন।

ক্রেতা সুরক্ষা দফতর অনবরত গণবান্ধব হওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে। আইনের নানা পরিবর্তন আনা হয়েছে। একটা ছোট্ট উদাহরণ দিই, আগে কোম্পানির যেখানে হেড অফিস সেখানে তারা কেসটাকে নিয়ে যেতেন। এখন অভিযোগকারীর রেসিডেন্ট কনজিউমার কমিশনে কেস লড়া যায়। সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য ক্রেতা সুরক্ষা মেলা, পঞ্চায়েতের স্তরে জনসচেতন শিবির আয়োজন করা হয়।

একটা খুব সাধারণ অভিযোগ হল প্যাকেটের গায়ে যা লেখা থাকে, সেই পরিমাণ ওজনের মাল থাকে না। সেই অভিযোগ অবশ্য যোগ্য দোকান থেকে কেনার সময় ওজন করে ভিডিও রেকর্ডিং করে অভিযোগ করলে গ্রাহ্য হয়। তবে এ ব্যাপারে একটা উন্নতি হয়েছে – আগে প্যাকেটে ভগ্নাংশের ওজন লেখা থাকত, যেমন ২৯৭ গ্রাম। বর্তমানে রাউন্ড ফিগারের ওজন প্যাকেটবন্দি করতে বলা হয়। যাতে ক্রেতা সহজে ওজন করে নিতে পারেন।

ওষুধ মানুষের জীবনদায়ী। এই ওষুধ নিয়ে মানুষের অভিযোগের শেষ নেই। প্রথমত ওষুধের যে পরিমাণ আণবিক যৌগ উল্লেখ, সেই পরিমাণ থাকে না। এটা অবশ্য সাধারণ লোকের পক্ষে ধরা সম্ভব নয়। এর জন্য অবশ্য ফার্মাকো ভিজিল্যান্স আছে। তারা জাতীয় নির্দেশিকা অনুযায়ী খতিয়ে দেখেন ওষুধ কোম্পানিগুলো তাদের উৎপাদনের গুণমান ঠিক রাখছেন কিনা? আয়ুর্বেদিক ওষুধের প্রধানত অনুসরণ করেন চরক, শশ্রুত ও ভৈষজ্য রত্নাবলী গ্রন্থে বর্ণিত নিয়মাবলী। আয়ুর্বেদ ওষুধের ক্ষেত্রে অবশ্য ফার্মাকো ভিজিল্যান্স লাগু হয়েছে। কিন্তু আয়ুর্বেদ পণ্য ও ভেষজ দ্রব্যের ওপর সরকারি নজরদারির ব্যবস্থা নেই। তাই আয়ুর্বেদিক পণ্য কেনার ক্ষেত্রে মানুষের সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত।

জনগণের অভিযোগ, ওষুধ কোম্পানিগুলো আরেকটি অনৈতিক কাজ করে, তা হল মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিড পাঠিয়ে ডাক্তারদের প্ররোচিত করে তাদের কোম্পানির ওষুধ লিখতে। সেই কোম্পানিগুলো প্রাইভেট প্র্যাকটিস করা ডাক্তারবাবুদের অনুরোধ করতেই পারেন। আরও অভিযোগ, কোম্পানিগুলোর ওষুধ প্রেসক্রাইব করার সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারবাবুরা প্রভাবিত হয়ে ওষুধ ছাড়াও নানা সহকারী পথ্য যেমন টনিক, এনজাইম, ভিটামিন ট্যাবলেট লিখে দেন। এর বিনিময়ে অনেক ডাক্তারবাবুদের প্রাপ্তি হয় বিদেশ ভ্রমণ সহ নানান উপঢৌকন।

বাজার-হাটে সাধারণত বিক্রেতারা যে ভাবে লোক ঠকান বড় বড় কোম্পানিগুলো সে ভাবে ঠকায় না। তারা প্যাকেটে যে গুণমান বা ওজন লেখে তা সাধারণত বজায় রাখে; কারণ এটা তাদের ঘোষিত অঙ্গীকার। এর অন্যথা হলে অঙ্গীকার ভঙ্গের অপরাধে দণ্ডিত হতে হবে। এজন্য তারা বিজ্ঞাপন দেওয়ার ক্ষেত্রেও সাবধান থাকে। তবে বিজ্ঞাপনে চমক আনার জন্য বা মানুষকে প্রলুব্ধ করার জন্য নানা কৌশল অবলম্বন করে। তার মধ্যে প্রধান হচ্ছে লুক্কায়িত খরচ অর্থাৎ হিডেন চার্জ।

উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় অমুক জায়গা থেকে অমুক জায়গার বিমান ভাড়া মাত্র ‘এত’ টাকা। ছোট্ট করে লেখা থাকে ‘টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশন অ্যাপ্লাই’। তার মধ্যে নানা ট্যাক্স, ইন্সুরেন্স খরচ ভরা। এমনটা ব্যাঙ্ক লোনের ক্ষেত্রে ‘প্রসেস চার্জ’-এর মধ্যেও দেখা যায়। মিউচুয়াল ফান্ড, বিমা কেনার ক্ষেত্রেও দেখা যায় এগুলো। আইনগত ভাবে কিছু করা যায় না। কারণ, তুমি ‘T & C’ পড়ে নাওনি কেন?

সংস্থাগত ভাবে আর একটি বড় প্রতারণার জায়গা হল ‘রিয়াল এস্টেট’ বিজনেস। একে তো তারা স্বপ্নের মতো বিজ্ঞাপন দেয়, তার সঙ্গে বাস্তব মেলে না। ইমারত তৈরির মালমশলাতেও গুণমান ঠিক থাকে না। ঘোষিত সময়ের মধ্যে বাড়ি তৈরি শেষ করে না। শেষ হয়ে গেলেও হস্তান্তর করে না। হস্তান্তর করলেও মিউটেশন করে না। এরকম ভূরি ভূরি অভিযোগ শুনতে পাওয়া যায়।

যাই হোক, জাতীয়, বহুজাতিক নানা অর্থশালী কোম্পানির নানা ফন্দি-ফিকির বুঝে-শুনে জনগণ নিজেদের প্রতারিত হওয়ার থেকে যতটা সম্ভব রক্ষা করে চলেছেন। ক্রেতাসুরক্ষা দফতর ও ক্রেতাসুরক্ষা আদালত যতটা সম্ভব জনসাধারণের মাথায় সুরক্ষার ছাতা দিয়ে চলেছে, তবুও প্রতারণার একটা বড় অংশ ‘সামান্য প্রতারণা’ বা ‘ক্ষুদ্র ক্ষতি’র আড়ালে থেকে গেছে।
(ক্রমশ)

অলংকরণ-রাতুল চন্দরায়