সুখেন্দু হীরা

(আইপিএস সুখেন্দু হীরা বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল (নিরাপত্তা)। প্রতারণার নানা কাহিনি ধারাবাহিক ভাবে তিনি তুলে ধরছেন বালিহাঁস-এর পাতায়।)

“সংসারে অনেক ঘটনাই যোগাযোগের ওপর নির্ভর করে। আমার পুলিশে ঢোকাও বলতে হবে সেইরূপ যোগাযোগের ফল।”
—বিশ্বনাথ লাহিড়ী, উত্তরপ্রদেশ পুলিশের প্রথম ভারতীয় আই.জি.

বিশ্বনাথ লাহিড়ী মহাশয় তাঁর এই উক্তি করেছেন তাঁর স্মৃতিকথা ‘কোটাল কাহিনী’তে। তিনি পরাধীন ভারতে ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে ‘ইন্ডিয়ান ইস্পিরিয়াল পুলিশ সার্ভিস’-এ যোগদান করেন। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে এই সার্ভিসের প্রথম প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা ভারতবর্ষে হয়েছিল। তার আগে এই পরীক্ষা ইংল্যান্ডে হতো।

ছাত্র অবস্থায় হস্টেলে থাকার সময় হস্টেলের অধ্যক্ষের মাধ্যমে এক ইংরেজ মহিলার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল বিশ্বনাথ লাহিড়ীর। পরীক্ষার খবর দেন সেই ইংরেজ মহিলা। মহিলার স্বামী উত্তরপ্রদেশ সিআইডি.-র উচ্চপদস্থ কর্মচারী ছিলেন। তিনি ডিআইজি সিআইডি-র কাছে বিশ্বনাথবাবুর জন্য পরিচয়পত্র লিখে দেন। ডিআইজি সিআইডি বিশ্বনাথ লাহিড়ীর নামাঙ্কন করে দেন। তখনকার দিনে এই পরীক্ষায় বসতে গেলে পরীক্ষার্থীদের কোনও এক উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারীর দ্বারা নামাঙ্কন আবশ্যক ছিল। এই যোগাযোগ সবার ভাগ্যে হয়ে ওঠে না; তাই তিনি এ কথা তাঁর আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেছেন।

স্বাধীন ভারতে উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের দ্বারা নামাঙ্কন পদ্ধতি উঠে গেছে। সরকারি ভাবে চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে মুখ চেনাচিনির কোনও ব্যাপার নেই। অনেকেই অভিযোগ করেন, প্রচলিত নিয়োগ পদ্ধতির আড়ালে মুখ চেনাচেনি বা স্বজনপোষণ থেকে গেছে। যা আপাতদৃষ্টিতে বা বাইরে থেকে বোঝা যায় না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এটা খুব বেশি ক্ষতিকরও নয়। এই কারণে, এটা নিয়োগ পদ্ধতিকে ব্যাহত করে না। এর ফলে একদম অযোগ্য ব্যক্তি সুযোগ পায় সেটা বলা যাবে না। তবে একজন হলেও যোগ্য ব্যক্তি উপেক্ষিত হন।

উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে যে কোনও বাহিনীর পরীক্ষার কথা। সেনা বা পুলিশ বাহিনীতে সাধারণ বাহিনী নিয়োগের সময় আগের নিয়োগপদ্ধতি অনুযায়ী মাঠ পাশ করতে হ’ত অর্থাৎ দৌড়, ঝাঁপ, শারীরিক মাপজোখে উত্তীর্ণ হতে হ’ত। তারপর নামমাত্র লেখা পরীক্ষা এবং শেষে মৌখিক পরীক্ষা। চাকরিপ্রার্থীর শারীরিক সক্ষমতা ও দেহের গঠন বেশি প্রাধান্য পেত। তাই ইন্টারভিউ বোর্ডে পৌঁছতে পারলে নিয়োগকর্তারা অনেক সময় তাঁদের পরিচিত, অর্ধপরিচিত এবং অন্যান্য প্রভাবশালীর ব্যক্তিদের অনুরোধ ফেলতে পারতেন না। যদিও এখন আর এত সরল পদ্ধতিতে নিয়োগ হয় না।

ছেলেবেলা থেকে শুনে আসছি, ওকে ওঁর বাবা, ওকে ওঁর মামা, ওকে ওঁর জামাইবাবু চাকরিতে ঢুকিয়ে দিয়েছে। এটা প্রকৃত অর্থে ‘স্বজনপোষণ’। আত্মীয়-স্বজনকে চাকরি পাইয়ে দেওয়াটা অতি স্বাভাবিক ছিল। এমনও দেখেছি কোনও ছেলে কোনও বাহিনীতে চাকরির পরীক্ষা দিতে গেছে; সেখানে সেই বাহিনীর কোনও অফিসারের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। তিনি ‘অফার’ দিয়েছেন, “যদি তুমি আমার মেয়েকে বিয়ে করো, তোমার চাকরি করে দেবো”। কন্যা হয়তো অতটা সুন্দরী নয়, কিন্তু চাকরির লোভে বিবাহ করেছে এবং পরে চাকরি পেয়েছে।

সব সময় এ রকম যোগাযোগ ফলপ্রসূ হয়নি। আমার এক নিকট আত্মীয়ের দাদা এই ভাবে বিবাহ করেন। কিন্তু তিনি বাহিনীর চাকরি পাননি বা শ্বশুরমশাই তাঁকে চাকরি করিয়ে দিতে পারেননি।
এ রকম জনশ্রুতি অনেক শুনেছি, কোনও নেতা সিগারেটের প্যাকেটের উপরে, বাসের টিকিটের পিছনে লিখে দিয়েছেন; সেই লেখা দেখিয়ে কেউ সরকারি অফিসে চাকরি পেয়ে গেছে।
চেনাচেনির ব্যাপারটা যে শুধু সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে আছে তা নয়, বেসরকারি চাকরির ক্ষেত্রে আরও প্রবল ভাবে রয়েছে। সেক্ষেত্রে সেই ব্যবস্থাপনা খুব বেশি ‘সোসাইটি’কে বিচলিত করে না। কারণ, বেসরকারি সংস্থার যিনি কর্তা, তিনি চাইলেই যাকে খুশি নিতে পারেন। তাঁরাও কিন্তু চাকরিপ্রার্থীর গুণগত মান দেখেই নেন। কারণ, তাঁরা তাঁদের ব্যবসার সঙ্গে খুব বেশি সমঝোতা করেন না।
‘স্বজনপোষণ’কে ইংরেজিতে ‘নেপোটিজম’ বলে। এই স্বজনপোষণ চাকরি গণ্ডি ছাড়িয়ে রাজনীতি, ব্যবসা, শিল্প-সংস্কৃতি, বিনোদন জগতে ছড়িয়ে রয়েছে। রাজনীতির ক্ষেত্রে বিরোধীরা অবশ্য ‘পরিবারতন্ত্র’ আখ্যা দিয়ে আন্দোলন করেন বা ভোটের সময় প্রচার করেন। আগেই বলা হয়েছে, ব্যক্তিগত ব্যবসার ক্ষেত্রে বিশেষ কিছু বলার থাকে না। অভিনয় জগতে অভিনেতা, অভিনেত্রীর পুত্র কন্যারা সহজে সিনেমায় সুযোগ পান। শিল্প-সংস্কৃতির জগতে পরিবারের কেউ আগে থেকে থাকলে সহজে কাজ শুরু করতে বা কাজ পেতে সুবিধা হয়। আইন পেশার ক্ষেত্রেও আইনজীবীর পুত্র কন্যারা বাড়তি সুবিধা পান। ডাক্তারদের সন্তানদেরও পসার জমাতে সুবিধা হয়।
শুধু চাকরি পেতে বা কাজ শুরু করতে নেপোটিজম সাহায্য করে তা নয়, কাজ টিকিয়ে রাখতে, পদোন্নতি করতে, আরও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে স্বজনপোষণ সাহায্য করে। এর ফলে প্রকৃত যোগ্য ব্যক্তি বঞ্চিত হলেন। সমাজ একটু হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হল। তবে এটাও ঠিক— যদি যোগ্যতা না থাকে তাহলে যতই স্বজনের পোষণ থাক, যেখানে প্রকৃত গুণের মর্যাদা দেওয়া হয়, সেখানে টিকে থাকা মুশকিল। আবার সেই রবীন্দ্রনাথের কথা মনে পড়ে যায়, যথার্থ প্রতিভাকে পৃথিবীর কোনও শক্তি বাধা দিতে পারে না।
শুধু জীবিকা বা নাম অর্জন করার ক্ষেত্রেই স্বজনপোষণ চলে না; বিভিন্ন পরিষেবা পাইয়ে ক্ষেত্রেও স্বজনপোষণ চলে। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা, স্কুলে ভর্তি, বিভিন্ন পরিষেবামূলক সংযোগ আগেভাগে পাওয়া, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে টিকিট বা আমন্ত্রণ পাওয়া, ইত্যাদি ইত্যাদি।
অর্থের বিনিময়ে বা অন্য কিছু সুবিধার বিনিময়ে বিভিন্ন রকম সুবিধা পাইয়ে দেওয়া হয়। সে ক্ষেত্রে সেটা আর স্বজনপোষণ থাকে না, সেটা উৎকোচ গ্রহণের অপরাধ। সেটাকে ঠিক প্রতারণার মধ্যে গণ্য করা ঠিক হবে না। সেটা সাদা-কালো অপরাধ।
যারা স্বজনপোষণ করেন, তারা এক প্রকার প্রতারক তো বটেই। তিনি একজন যোগ্য প্রার্থীর সঙ্গে প্রতারণা করলেন, সমাজব্যবস্থার সঙ্গে প্রতারণা করলেন, তা সে প্রমাণিত হোক, বা না হোক।
( ক্রমশ)

অলংকরণ-রাতুল চন্দরায়