সুখেন্দু হীরা

(আইপিএস সুখেন্দু হীরা বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল (নিরাপত্তা)। প্রতারণার নানা কাহিনি ধারাবাহিক ভাবে তিনি তুলে ধরছেন বালিহাঁস-এর পাতায়।)

ভণ্ড শব্দটির আক্ষরিক অর্থ কপট, ভানকারী, প্রতারক, ধূর্ত। ভণ্ড কথাটি সবচেয়ে বেশি প্রয়োগ হতে দেখি ভণ্ডসাধুর ক্ষেত্রে। এবারের পর্বে কিছু ভণ্ড সাধুর কথা।

সাধু শব্দের আক্ষরিক অর্থ শোভন, সুন্দর, মনোহর। নির্দোষ, সদাশয়, মহাত্মা, পুণ্যশীল ব্যক্তিকেও সাধু বলা হয়। প্রাচীন যুগে মুনি ঋষিরা ছিলেন সাধুব্যক্তি। আমরা সাধারণ ভাবে পূজা-অর্চনা করেন এমন ধার্মিক ব্যক্তিকে সাধু বলে থাকি।

ভণ্ডসাধুর কথা বললেই প্রথমে মনে আসে রাজশেখর বসুর ‘বিরিঞ্চি বাবা’র কথা। গল্পে আছে, বিরিঞ্চি বাবা বলতেন তিনি সৃষ্টির আগে থেকেই আছেন। চন্দ্র-সূর্য চালাবার ভার তাঁর হাতেই। তিনি সাগরেদ ক্যাবলাকে দেবতা সাজিয়ে হোমের সময় আবির্ভূত করতেন। মিথ্যা আগুন লাগার ভয় সৃষ্টি করে বিরিঞ্চি বাবার জারিজুরি ধরা হয়। এই কাহিনি নিয়ে সত্যজিৎ রায় কালজয়ী চলচ্চিত্র ‘মহাপুরুষ’ নির্মাণ করেছিলেন।

জনসাধারণের সরল বিশ্বাস আছে এই যে, সাধুরা চাইলে অনেক কিছু করতে পারেন। তাঁরা অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী। এই ক্ষমতা জ্যোতিষী তথা তান্ত্রিকদেরও রয়েছে— এমনটাই বিশ্বাস সাধারণ লোকের। অনেক লোকের বিশ্বাস জ্যোতিষীরা গ্ৰহরত্ন ধারণ করিয়ে মানুষের ভাগ্য ফিরিয়ে দেয়। যে কারণে গ্রহরত্নের রমরমা ব্যবসা। হাত দেখা, ঠিকুজি-কোষ্ঠী বিচার, সেই সব বিচার করে জ্যোতিষীদের নানান নিদান দেওয়া, সেই অনুযায়ী গ্রহরত্ন ধারণ বা অন্য কোনও কাজ করা।

এর মধ্যে আইনত কোনও প্রতারণা নেই। কারণ, এটা গ্রাহক ও পরিষেবা দাতার সম্পর্কের উপর বা বলা যেতে পারে বিশ্বাসের উপর নির্ভরশীল। যতক্ষণ না গ্রাহক পরিষেবা দাতার কাজে অসন্তুষ্ট না হচ্ছেন, ততক্ষণ গ্রাহক কোনও অভিযোগ করেন না। অভিযোগ করলেও তা প্রমাণ করা শক্ত। কারণ, সাধারণত বিক্রেতা বা পরিষেবা দাতাদের মতো এখানে কোনও সর্বসমক্ষে ঘোষিত প্রতিশ্রুতি থাকে না।

তান্ত্রিকেরা এদিক থেকে একটু এগিয়ে। যেমন তারা বলেন থাকেন, ভাগ্যের পরিহাস থেকে রক্ষা পেতে এই যজ্ঞ করতে হবে, ওই জায়গায় গিয়ে হোম করতে হবে। এতে অর্থনাশটা আরও বেশি এবং সরাসরি। খবরের কাগজে এমনও সংবাদ আমরা পেয়েছি তান্ত্রিকের আদেশে মানুষ নরবলিও দিয়েছে। আবার এমনও ঘটনা ঘটেছে তান্ত্রিক নিজেই গ্রাহকদের বলি দিয়ে অর্থাৎ হত্যা করে যজমানের সম্পত্তি লুট করে পালিয়েছে। এরকম একটা ঘটনা ঘটেছিল মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুর শহরের এক আবাসনে। তান্ত্রিক যজ্ঞ করার নামে ফ্লাটে এসে, ফ্ল্যাটের মা ও মেয়েকে হত্যা করে লুট করে পালায়।

ট্রেনের ভিতরে, বাসস্ট্যান্ডের কাছে লাইট পোস্টে, সর্বজনের চোখে পড়ার মতো বিভিন্ন জায়গায় সাধু, তান্ত্রিক, জ্যোতিষীদের বিজ্ঞাপন দেখা যায়। বশীকরণ, প্রেমে বাধা, সন্তানহীনতা প্রভৃতি বিষয়ে সমাধান পেতে আসুন এই ঠিকানায়। এই বিজ্ঞাপন তালিকার মধ্যে মুসলিম তান্ত্রিকদেরও নাম দেখা যায়। এগুলি কতটা ফলপ্রসূ তা বলতে পারব না। যুক্তিবাদীরা বলেন, এ সবই বুজরুকি। যুক্তিবাদী বা বিজ্ঞান মঞ্চের লোকে দীর্ঘদিন ধরে এসবের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে আসছেন। তাতেও কিন্তু এই সব ব্যবসার বিন্দুমাত্র ঘাটতি হয়নি।
গ্রাম বাংলায় আগে জলপড়া, তেলপড়া, ঝাড়ফুঁকের বিরাট চাহিদা ছিল। এখন যে এর কদর খুব কমেছে, তা-ও নয়। তারপর ছিল দাঁতের পোকা বার করার লোক, কুকুরের বিষ নামানোর লোক, সাপের বিষ ঝাড়ার ওঝা, ন্যাবা অর্থাৎ জন্ডিস সারানোর লোক। পিঠে কাঁসার থালা বসিয়ে দেখা হ’ত কুকুর কামড়ানো বিষ দেহে আছে কিনা। জন্ডিস কমাতে খাওয়ানো হয় ‘মন্ত্রপূত’ দই। পরানো হয় বিশেষ কাঠির মালা। অনেকে বলেন এটা হল তুকতাক। লাগলে তাক, না লাগলে তুক। দাঁতের যন্ত্রনায় কাবু রোগীর চোখের সামনে দাঁতের পোকা বার করে দেখাবে। যুক্তিবাদীরা বলেন এগুলির সবই হাতসাফাই।
দাঁতের পোকা বার করার একটা সত্যি গল্প বলি। এখনও দাঁতের পোকা বার করবার লোক কলকাতার উপকণ্ঠে আছে। আমার এক বন্ধু দাঁতের যন্ত্রণায় কাতর হয়ে গেলেন সেখানে। আমি বললাম, দাঁতের পোকা বলে কিছু হয় না। বন্ধু দিব্যি দাঁতের পোকা নিজের চোখে দেখে এলেন, দাঁতের যন্ত্রণাও দূর। বন্ধু ফিরে স্বগর্বে গল্প করলেন। কিছুদিন বাদে আবার দাঁতের যন্ত্রণা। এবার অবশ্য দাঁত ফেলে আসতে হলো দাঁতের ডাক্তারের কাছে। এবার কিন্তু আমায় গল্প করল না।
এটাই হল ঘটনা। মানুষ যখন উপকার পায় বা সফল হয়, তখন গর্ব করে বলে আমি এঁর কাছে গিয়ে ফল পেয়েছি। আপনারাও যেতে পারেন। কিন্তু যখন ফল পাই না তখন কিন্তু কাউকে বলি না, আপনি ওখানে যাবেন না, কোনও ফল হবে না। এই ভাবে তুকতাকের জায়গাগুলো প্রচারের আলো পেয়ে আসছে।
তান্ত্রিক বা জ্যোতিষেরা কথায় কথায় তাদের যজমানদের তারাপীঠ বা কামাক্ষা নিয়ে যান যজ্ঞ করানোর নামে। যজ্ঞ করানোর নামে উপাচারের জোগার করতে যজমানদের সর্বস্বান্ত হওয়ার জোগার হয়। অনেক তান্ত্রিক যজ্ঞ করানোর নামে গৃহস্থের সবাইকে অজ্ঞান করে সর্বস্ব চুরি করে নিয়ে গেছে।
ভূত তাড়ানো ওঝার অনেক গল্প আমরা শুনি। যুক্তিবাদীরা বলেন ভুত তাড়ানোরটা একটা ভেল্কি। ভূত আছে কি, না? এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ যথেষ্ট আছে। তবে ভূত তাড়ানো ওঝাদের সংখ্যা এখনও কম নেই। যাই হোক, মানুষের বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ধোঁয়াশার মধ্যে এই প্রতারণা ব্যবসা সসম্মানে টিকে আছে।

অলংকরণ-রাতুল চন্দরায়