শুভেন্দু রায় চৌধুরী

কলকাতা ময়দানে সখ্যের ছবি যেমন দেখেছি, তেমন দেখেছি বৈরিতার ছবিও। সারা বছর জুড়ে চলত দুই বড় দলের সমর্থকদের মধ্যে আলোচনা, তর্কাতর্কি। তবে বাড়িতে বা পাড়ায় এমন ঘটনা খুব ছোট বয়স থেকে দেখলেও, ফুটবল মাঠে দুই দলের সমর্থকদের মধ্যে উত্তপ্ত মেজাজের আঁচ পেতে আমাকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত। ওই বছরই দেখতে গিয়েছিলাম আমার জীবনের দ্বিতীয় বড় ম্যাচ। তবে এবার আর মায়ের হাত ধরে নয়। সঙ্গে ছিলেন বাবা আর এক মামা। সেই ম্যাচেরই একেবারে শেষের দিকে অশোক চ্যাটার্জির বিতর্কিত গোলের কারণে অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছিল গ্যালারি।

সেই বছরই মোহনবাগানের ঘরের ছেলে হিসেবে পরিচিত অশোক যোগ দিয়েছিলেন ইস্টবেঙ্গলে। ম্যাচে ইস্টবেঙ্গলের কিছুটা প্রাধান্য থাকলে, মোহনবাগান কিন্তু লড়াই থেকে পিছু হটেনি। খেলা একেবারে শেষের মুখে। সবাই ধরেই নিয়েছে ম্যাচটি ড্র হতে চলেছে, আর তখনই গোল পেল ইস্টবেঙ্গল। গ্যালারি থেকে মনে হয়েছিল, মূহূর্তের জন্য রক্ষণভাগের অসতর্কতার মাশুল দিতে হল মোহনবাগানকে। কিন্তু ভুল ভাঙতে বেশি দেরি হল না। মাঠেই সবুজ মেরুন দলের ফুটবলারদের প্রতিবাদ থেকে বোঝা গেল যে সুভাষ ভৌমিক অফসাইডে রয়েছেন দেখেই তাঁরা দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু রেফারি তাঁদের সেই কথায় কর্ণপাত করেননি। তিনি গোলের সিদ্ধান্তে অনড় ছিলেন। এই কারণেই তেতে উঠছিল গ্যালারি। বেশ কিছুক্ষণ খেলা বন্ধও ছিল। তারপর কোনওরকমে খেলা শুরু হতেই বেজেছিল শেষ বাঁশি। কিন্তু খেলা শেষ হলেও মাঠে উত্তেজনা শেষ হয়নি। দুই দলের সমর্থকেরাই একেবারে যুদ্ধং দেহি মেজাজে। বিতর্কিত গোলে প্রিয় দলের পরাজয়ে যথেষ্টই উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন আমার বাবা। হয়তো রেফারির বিরুদ্ধে প্রতিবাদেও শামিল হতেন। কিন্তু অমন উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতিতে দুই শিশুপুত্রের নিরাপত্তার কথা ভেবেই বোধহয় সেই ইচ্ছা অপূর্ণ রেখে মাঠ ছাড়তে হয়েছিল তাঁকে। তবে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতো ফেরার পথে প্রতিপক্ষ দলের সমর্থক আমার মামার সঙ্গে তাঁর তর্ক থামেনি। আর সেই তর্কের মাঝে আমরা কিছু বলতে গেলেই বকা খাচ্ছিলাম। ভেবেছিলাম, বাড়িতে এসে তর্কটা হয়তো থামবে। কিন্তু বাড়ির সামনে আসতেই প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য শুনতে হাজির হয়ে গেলেন পাড়ার ছোট বড় সকলেই। সেখানেও আরেক প্রস্থ বাকবিতন্ডা। এমনকি রাতে যখন সকলে খেতে বসেছেন, তখনও চলেছিল সেই তর্ক।

ওই গোলটা অফসাইড ছিল কি না, তা নিয়ে তর্ক চলেছিল একনাগাড়ে বেশ কয়েকদিন। তারপর ময়দানের নিয়মমতো সবকিছু আবার থিতিয়েও যায়। তাই অনেকদিন পর্যন্ত জানতে পারিনি গোলটির সময় সুভাষ ভৌমিক সত্যিই অফসাইডে ছিলেন কি না? বেশ কয়েক বছর পর সুভাষেরই একটি লেখায় সেই প্রশ্নের উত্তর পেয়েছিলাম। ওই লেখায় সুভাষ দাবি করেছিলেন যে অফসাইডে রয়েছেন বুঝেই তিনি মাঠের বাইরে চলে গিয়েছিলেন। আক্রমণে অংশই নেননি। কিন্তু তাঁর সেই কৌশল মোহনবাগানের রক্ষণভাগের খেলোয়াড়রা ধরতে পারেননি। তাই তাঁরা দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন। আর সেই সুযোগেই গোল করেছিলেন সুযোগসন্ধানী অশোক চ্যাটার্জি।

মোহনবাগানের তথাকথিত ঘরের ছেলে সব অপমানের যোগ্য জবাব দিয়েছিলেন। একটা ক্লাবে দীর্ঘদিন খেলার পরও যখন একজন ফুটবলারকে দল ছাড়তে হয় তখন তার পিছনে দু’টি কারণ থাকতে পারে। হয় ফুটবলারটির ফর্ম পড়তির দিকে। নয়তো কোনও কারণে ক্লাব কর্তাদের চক্ষুঃশূল হয়ে উঠেছেন তিনি। দুর্ভাগ্য যে কলকাতা ফুটবলে দ্বিতীয় কারণটির জন্যই দল ছাড়তে বাধ্য হওয়া ফুটবলারের সংখ্যা বেশি। সুধীর কর্মকার, সমরেশ চৌধুরী, সুরজিৎ সেনগুপ্ত, প্রসূন ব্যানার্জী— কাকে ছেড়ে কার কথা বলব। অশোক চ্যাটার্জিকে যেমন মোহনবাগান ছাড়তে হয়েছিল, তেমনি পরিমল দে-কে সরতে হয়েছিল ইস্টবেঙ্গল থেকে। সেটাও সত্তরের শিল্ড ফাইনালে হাবিবের পরিবর্ত হিসেবে মাঠে নেমেই দলকে জেতানোর পর। তবে ক্লাব কর্তারা যতই খারাপ ব্যবহার করুন না কেন, ফুটবলপ্রেমীদের মনে চিরকালের জন্য থেকে গিয়েছেন এই ফুটবলারেরা। তাই আজও প্রতিশ্রুতিবান কোনও ফুটবলারকে দেখলেই প্রবীণেরা অতীতের কোন ফুটবলারের নাম করে বলে ওঠেন— একেবারে ওর মতো খেলে। আসলে ফুটবল ও ফুটবলারদের প্রতি ক্রীড়াপ্রেমীদের ভালোবাসা চিরকালই ফল্গুর মতো বয়ে চলবে। কিছু বিত্তশালী, ক্ষমতালোভী কর্মকর্তার ক্ষমতা নেই সেই ভালোবাসার ছিটেফোঁটা কম করার।

অলংকরণ- রাতুল চন্দরায়