শুভেন্দু রায় চৌধুরী

সত্তরের দশকে ফুটবলের ব্যাপারটাই ছিল নিখাদ ভালোবাসার। শুধু ফুটবলের (football) জন্য খালি পেটে মাঠ দাপিয়ে বেড়ানো কিশোর, যুবকের অভাব ছিল না। ফুটবলকে (football) নিয়ে তাদের সকলেই চেয়েছিলেন নিজেদের স্বপ্নকে রূপ দিতে। কেউ পেরেছেন, আবার অনেকেই ব্যর্থ হয়েছেন। তবে তাদের ভালোবাসা কিংবা লড়াইয়ের কোনওটাই মিথ্যে হয়ে যায়নি।

সেই সময়ে ময়দান দাপিয়ে বেড়ানো ফুটবলারদের তালিকা তৈরি করতে যাওয়া ধৃষ্টতারই শামিল। চুনী, বলরাম, পিকে, জার্নাল সিং-রা তখন অন্তমিত। নতুন যাঁরা খেলতে এসেছিলেন, তাঁরা সব সময়েই চেষ্টা করে গিয়েছেন ওই সব মহীরুহদের ছুঁতে। কাকে ছেড়ে কার কথা বলব? একদিকে অশোকনগরের সমরেশ (পিন্টু) চৌধুরী থাকলে অন্যদিকে চুঁচূড়ার সুরজিৎ সেনগুপ্ত। হায়দ্রাবাদী হাবিব, নঈম, আকবর, লতিফউদ্দিনের পাশে সমান ভাবে উজ্জ্বল রিষড়ার সুধীর কর্মকার, শ্যামনগরের অশোকলাল ব্যানার্জি, কসবার শ্যামল ঘোষ। মাঝমাঠে বরানগরের গৌতম সরকার যদি লড়াকু ফুটবলের (football) প্রতীক হন, তাহলে কাটিহার থেকে কলকাতায় আসা সুভাষ ভৌমিক ছিলেন শক্তি আর স্কিলের চমকপ্রদ এক মিশ্রণ।

থঙ্গরাজ আর বলাই দে-র পর গোলপোস্টের নীচে তৎকালীন ময়দানের গ্ল্যামার বয় তরুণ বসু রাজত্ব করছিলেন। সত্তরের মাঝামাঝি থেকে বাটানগরের মানস ভট্টাচার্য এবং বর্ধমানের বিদেশ বসুর পাশাপাশি কালীঘাটের প্রশান্ত ব্যানার্জি হয়ে উঠেছিলেন ময়দানের সুপরিচিত নাম। সাফল্য ও গুণগত বিচারে এঁদের মধ্যে অল্পবিস্তর তারতম্য থাকলেও, একটা বিষয়ে এঁরা সকলেই অনন্য। সেটা হল, এঁদের প্রত্যেকেই সমস্যা জর্জরিত বাঙালিকে কিছু সময়ের জন্য হলেও দুঃখ কষ্ট ভুলতে সাহায্য করেছেন।

তখন সেই সামান্য সময়ের স্বস্তিটুকুই ছিল এক পরম পাওয়া। বর্হিজগতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক প্রায় ছিন্ন, অতি বাম রাজনীতির জ্বরে কাঁপছে বাংলা। আমাদের জন্য স্বাভাবিক ভাবে বাড়ির বাইরে বার হওয়ার, খেলতে যাওয়ার অনুমতি নেই। পুলিশ আবাসনের ছাদে রবারের বলেই পা রাখতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। আর তখন ময়দানের ওই ফুটবলাররাই হয়ে উঠেছেন আমাদের অনুপ্রেরণা।

সেই সময় ‘দেশ’ পত্রিকায় একটি পাতা বরাদ্দ ছিল ফুটবলারদের জীবনযুদ্ধ তুলে ধরার জন্য। খুব সম্ভবত সেটি লিখতেন সাংবাদিক মুকুল দত্ত। ফলে দেশ পত্রিকা প্রকাশের দিন তক্কে তক্কে থাকতাম সবার আগে ম্যাগাজিনটির দখল পেতে। এক নিঃশ্বাসে ওই পাতাটা পড়ে ফেলতাম। দীর্ঘ খরার পর ছিয়াত্তরে মোহবাগানের লিগ জয়ী দলের অধিনায়ক প্রশান্ত মিত্র সম্পর্কে একটা লেখার কথা আজও মনে রয়েছে। ওই লেখার প্রথম দিককার একটি লাইনে হালকা সুরে বলা হয়েছিল, ‘যে সমস্ত তরুণীরা প্রশান্তের প্রেমে পড়তে চান, তাদের হতাশ হতে হবে। কারণ, বহুদিন ধরেই প্রশান্ত মন দিয়ে বসেছেন এক চর্মগোলককে। তার বাইরে অন্য কিছু তিনি ভাবতে নারাজ।’

কথাটা মজার ছলে লেখা হলেও একশো শতাংশ খাঁটি। চুয়াত্তরে এশিয়ান যুব ফুটবলে ইরানের সঙ্গে যুগ্ম জয়ী ভারতীয় দলের গোলরক্ষক ছিলেন শামনগরের প্রশান্ত। তারপর প্রায় শুকিয়ে যাওয়া মোহনবাগানে ফুটবলে ফুল ফোটানো। কিন্তু চুয়াত্তর থেকে ছিয়াত্তরে মধ্যে তাঁর জীবনেই ঘটে গিয়েছিল এক অঘটন। পঁচাত্তরের বড় ম্যাচে মারাত্মক চোট পেলেন প্রশান্ত। খেলোয়াড় জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সেই চোটের কবল থেকে মুক্তি পাননি। অথচ ওই একই ধরনের চোটের পরও চুটিয়ে ক্রিকেট খেলে গিয়েছেন ওয়েষ্ট ইন্ডিজের কিংবদন্তী ক্লাইভ লয়েড। নিজের অসহায়তার জন্য যথেষ্ট আক্ষেপ ছিল সুদর্শন এবং অতীব ভদ্র এই ফুটবলারের। সেই অভিমানের কারণেই বোধহয় প্রশান্ত দুনিয়া ছেড়ে চলে গেলেন অসময়ে বাংলার ফুটবলকে (football) রিক্ত করে।

(ক্রমশ)

অলংকরণ- রাতুল চন্দরায়