শুভেন্দু রায় চৌধুরী

সত্তর দশকে অনান্য তারকাদের কথায় আবার পরে ফিরব। তার আগে আমার প্রথম বড় ম্যাচ দেখার অভিজ্ঞতা একটু জানাই। সেটা ছিল সাতষট্টির শিল্ড ফাইনাল। মনে আছে, ইডেনে সেই খেলা দেখতে বালি থেকে চুয়ান্ন নম্বর বাসে এসেছিল মা। গোটা বিষয়টা মনে পড়লে এখনও খুব অবাক লাগে। কারণ, সেই সময় একজন মহিলা দুই শিশুপুত্রের হাত ধরে ইষ্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচ দেখতে আসছেন, এমনটা প্রায় অকল্পনীয় ছিল। তার উপর বালি থেকে সরাসরি ধর্মতলা আসার কোনও উপায় ছিল না। হাওড়া থেকে বাস বদলাতে হতো। কিন্তু আমাদের ভাগ্য ভালো বলতে হবে। শিল্ড ফাইনাল বলে ওইদিন একটা বিশেষ বাস চালানো হয়েছিল বালিখাল থেকে ইডেন পর্যন্ত। বাসে আসার কারণেই হয়তো মাঠে পৌঁছতে কিছুটা দেরিই হয়েছিল। কারণ, ইডেনে ঢুকে দেখেছিলাম গ্যালারি পুরো ভর্তি। উপর থেকে নীচে দু’বার ওঠানামা করেও কোনও খালি জায়গা চোখে পড়েনি। গ্যালারিতে ঠাঁই নেই বুঝে ফেন্সিংয়ের এর সামনে যখন জায়গা খুঁজছি, তখনই ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন বাবার সিনিয়র সহকর্মী কাম বন্ধু সুহৃদ সেনগুপ্ত। তিনিই আশপাশের লোকজনকে বলে আমাদের বসার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন অনেক কষ্টে।

 

ততক্ষণে দুই দলই মাঠে নেমে পড়েছে। ইডেনে সেই সময় দুই গোলপোস্ট হতো হাইকোর্ট আর ময়দানের প্রান্তে। আমরা বসেছিলাম আকাশবাণী ভবনের সামনের গ্যালারিতে। বসার জায়গা পেয়ে মাঠের দিকে তাকাতেই দেখতে পেয়েছিলাম বিক্রমজিৎ দেবনাথকে। ফর্সা রং, চাপ দাঁড়িতে তাঁকে দেখতে লাগতো একেবারে সিনেমার নায়কের মতো। দক্ষিণ কলকাতায় মামাবাড়ির পাশে থাকার কারণে তখন তিনি আমাদের দেবনাথদা হয়ে উঠেছেন। মামার বাড়িতে গেলেই আমরা দুই ভাই চলে যেতাম তাঁর বাড়িতে। ছোট্ট একটা ঘর। তবে বেশ ছিমছাম ভাবে সাজানো। বাড়িতে গেলেই পাজামা ও গেঞ্জি গায়ে দেবনাথদার দেখা মিলত। সবসময়ই হাসিমুখে স্বাগত জানাতেন। আমাদের করা বোকার মতো প্রশ্নগুলিরও জবাব দিতেন গুরুত্ব সহকারে। দেমাকের ছিটেফোঁটা দেখিনি তাঁর ব্যবহারে। ওভারল্যাপিং শব্দটা তখনও ভারতীয় ফুটবলে অজানা। তবুও সাতষট্টিতেই লিগের বড় ম্যাচে ইষ্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে গোল করেছিলেন দেবনাথদা। কয়েক দিন আগে জানতে পারলাম যে তিনিই এখন ময়দানের প্রাক্তন ফুটবলারদের মধ্যে বয়োজেষ্ঠ্য। সুস্থ থাকুল দেবনাথদা। যোগাযোগ অনেক আগেই বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেও আমার মনে আপনি আজীবন থেকে যাবেন।

 

সেদিন ইডেনে ছিল তারকার মেলা। চুনী গোস্বামী, পরিমল দে, প্রদ্যোৎ বর্মণ, থঙ্গরাজদের চোখের সামনে দেখার যে রোমাঞ্চ তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তবে মনে যতটা রোমাঞ্চ ছিল, ততটা আনন্দ কিন্তু ওইদিনের ম্যাচ দেখে পাইনি। গোলশূন্য ভাবেই শেষ হয়েছিল ম্যাচটা। এমনকি, ম্যাচে বলার মতো তেমন কিছু ঘটেওনি। কেবল একবার চুনী গোস্বামীর ড্রিবলিংয়ের ঝলক দেখেছিলাম। তখনও জানতাম না যে ওটাই হতে চলেছে ভারতের সর্বকালের সেরা ফুটবলারদের অন্যতম চুনী গোস্বামীর শেষ শিল্ড ফাইনাল। কারণ রিপ্লের বদলে গোটা প্রতিযোগিতাটাকেই পরিত্যক্ত বলে ঘোষণা করা হয়েছিল। আর আটষট্টিতে শিল্ডের আসর বসেইনি। আর ওই বছরেই ফর্মের চূড়ায় থাকতে থাকতে ফুটবলকে বিদায় জানিয়েছিলেন তিনি। বলেছিলেন ‘কেন এখনও অবসর নিচ্ছ না— এই কথাটা শোনার বদলে, এখনই অবসর নিলে কেন— এই প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়া অনেক বেশি সম্মানের’। তবে ফুটবলকে বিদায় জানালেও চুনী গোস্বামী প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে খেলে গিয়েছেন আরও কয়েকটা বছর। রঞ্জিতে বাংলার অধিনায়কত্বও করেছেন। তাই ফুটবলার চুনীর থেকে ক্রিকেটার চুনীকে আমি বেশি দেখেছি।

 

পেশাগত কারণে এক বিকেলে সাউথ ক্লাবে সামান্য সময় কথাও বলেছিলাম। তবে চুনী গোস্বামী সম্বন্ধে আমার সেরা স্মৃতি হল স্টেট ট্রান্সপোর্টের তাঁবুতে তাঁকে প্র্যাকটিস করতে দেখা। অনান্য দিনের মতো সেদিনও ঘেরা মাঠে খেলা দেখে রেড রোড পার হয়ে ডাফরিন রোডের মুখে ওই তাঁবুর সামনে দাঁড়িয়েছিলাম মিনিবাসের অপেক্ষায়। বাস স্ট্যান্ড থেকে তাঁবুর ভিতরের ছোট্ট লনটির দিকে দৃষ্টি পড়তেই বিস্ময়ের ঘোর কাটতে সময় লেগেছিল। সাদা শর্টস, সাদা গেঞ্জি গায়ে প্র্যাকটিস করছেন চুনী গোস্বামী। আর তাঁবুর বারান্দায় বসে সেই দৃশ্য উপভোগ করছেন পরিমল দে (জংলা)। এই দুইজনকে নিয়ে ষাটের দশকে দুই দলের সমর্থকদের মধ্যে রেষারেষি ছিল চরমে। কিন্তু সেই দিন দেখেছিলাম, ফুটবলার চুনীর প্রতি তাঁর বিরুদ্ধ দলের ফুটবলাররাও কতটা শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। চুনী একের পর এক শট মেরে যাচ্ছেন। আর জংলা ‘এবার একটা ভলি হোক’ বলে গলা ফাটিয়ে যাচ্ছেন।

(ক্রমশ)

অলংকরণ- রাতুল চন্দরায়