স্বাগতা চৌধুরী

শ্রীনন্দিনী চক্রবর্তী, আমেরিকার এক প্রখ্যাত ইনস্টিটিউটে গবেষণা এবং অধ্যাপনা করেন। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স অর্থাৎ এআই নিয়ে দারুণ কাজ করছেন। তাঁর একটি গবেষণাপত্র একটি ফরেন জার্নালে বেরিয়েছে এবং উচ্চ প্রশংসিত। এই নিয়ে রবিবারের আনন্দবাজারের তিন নম্বর পাতার নীচের দিকে একখানা আর্টিকেল বেরিয়েছে। ভারতীয় বিজ্ঞানী, ভারত কা নাম রওশন ইত্যাদি। মৌকে ডেকে দেখালাম।

—দেখেছ? আমার ক্লাসমেট।

আমার দশ বছরের পুরনো বিয়ে করা বৌ, ইংরেজি মাধ্যম ইস্কুলের ভূগোল শিক্ষিকা বাঁ চোখের কোণ দিয়ে আধখানা দেখে বলল, এই বুঝি সেই বসরাই গোলাপ?
—হ্যাঁ, কিন্তু পাল্টে গেছে অনেক। তা-ও সুন্দর।

রাজাবাজার সায়েন্স কলেজের সামনের স্টপে বাস থেকে নেমে ফুটপাত ধরে হেঁটে যখন আসত, সিঁড়ি দিয়ে হেঁটে উঠত, ওহ্ সে কী দৃশ্য… আমরা এপাশে ওপাশে “ম্যায় হুঁ না” র শারুক্কানের মতো বুকে হাত রেখে ছিটকে যেতাম। তখন লম্বা বিনুনি ছিল। ছিপছিপে দেহবল্লরী। পাঁচ ছয় হাইট ছিল শ্রীর। ফর্সা রং। গোলাপি গালের হনু, ছোট্ট চিবুক। খাড়া নাক। কাউকেই পাত্তা দিত না। ডিপার্টমেন্টে নাম ছিল, বসরাই গোলাপ। এখন ক্রপড চুল। চোখের পাশে পায়রার পায়ের ছাপ। বয়স তো হয়ে গেছে কুড়ি কুড়ি বছরের পার।
আমি একটা নিঃশ্বাস ফেললাম।

মৌ ভুরু তুলে দেখল। শ্রীর উপর ডিপার্টমেন্টের সবার ব্যথা ছিল। মায় অধ্যাপকদেরও কারও কারও। বেশ বোঝাও যেত। আমারও ছিল।
মৌ সে সব গল্প অনেক শুনেছে।
এখন রবিবার সকালে কড়াইশুঁটি ছাড়াতে ছাড়াতে আমার পুরনো ব্যথার উপর ওর পুরনো ঈর্ষা জেগে উঠলো কিনা ঠিক বুঝলাম না। তবে শ্রীনন্দিনীর উপর গুরুত্ব না দিয়ে অন্য গল্প শুরু করে দিল।

—এই জানো তো, কাল কী হয়েছে? তমাদি আর আমি বাসে ফিরছি, আমরা খুব গল্প করছিলাম। তমাদি দুঃখ করছিল, এইবার ছট চলে গেল চোখের উপর দিয়ে, বিন্দিয়া ঠেকুয়া নিয়ে এল দেশ থেকে, অথচ আমরা দুজনেই ছুটিতে চলে গেছিলাম বলে আর ঠেকুয়া খাওয়া হল না। ঠেকুয়া মিস্।

আমি কাগজে আরেকটু মাথা ডুবিয়ে শ্রীর নাকের ডগার সেই পুরনো তিলটা আছে কিনা দেখার চেষ্টা করলাম। ঠেকুয়ার মত বিস্বাদ একটা বিস্কুট মাফিক জিনিসে মিস করার মত কী আছে বুঝে পাই না।
মৌ উঠে এসে আমার পাশে বসে পড়ে বলল, আরে শোনোই না, তারপর দেখি রুবির কাছে বাসটা ফাঁকা হয়েছে, সামনের সিটে বসে সুকন্যা। সেই যে, তোমার সেই বিহারি বন্ধুর বউ।

সুকন্যা আমার পুরোনো কলিগ, রবিশের বউ। সে যদিও আমার মনে নেই। রাস্তায় দেখলে চিনতেও পারব না। সুকন্যার নাম মনে আছে, কারণ বাঙালি মেয়ে, বিহারিকে বিয়ে করা নিয়ে তুমুল অশান্তি হয়েছিল। আমরা ঠিক করেছিলাম, সুকন্যাকে বাড়ি থেকে তুলে এনে বিয়ে দেবো। তার আর দরকার হয়নি। রবিশ ব্রিলিয়ান্ট ছেলে, কেপজেমিনির লোগো আর পে প্যাকেজের ওজন দেখে বাড়ির লোক কষ্ট করে মেনে নিয়েছিল। রবিশ পরে মুম্বই শিফট করে। আবার কোলকাতায় এসেছে নাকি? জানিনা তো।
তো সেই সুকন্যাকে মৌ বাসে দেখে চিনে ফেললে! প্রতিভাময়ী…
মৌ ধীরে ধীরে খোলসা করে।

—আরে না রে বাবা, সুকন্যা নিজেই ডেকে কথা বলল। ও এসেছিল তো একবার আমাদের বাড়ি। সেই যখন খুব ঝামেলা হচ্ছিল।
—আচ্ছা।
শ্রীনন্দিনীর তিল দেখা যাচ্ছে না। কাগজটা ভাঁজ করে রেখে দিই।

মৌ এদিকে বলে চলেছে।

—সুকন্যা বুঝলে ছট পালন করতে কোলকাতা এসেছিল। কসবা থেকে শ্বশুর বাড়ি হয়ে বাপের বাড়ি যাচ্ছে। ওর ব্যাগে ছটের প্রসাদ ছিল, আমাদের দিল। কেমন মজা বলো? তো তমাদি নেমে বলছিল, হ্যাঁ রে, এআই কি আজকাল ছটের ঠেকুয়াও পাঠানোর ব্যবস্থা করে দিচ্ছে? তাও এই ভাবে?

আমি মৌয়ের দিকে তাকালাম। এআইকে দিয়ে এই বোকা কথাগুলো বন্ধ করার জন্য কী করা যায় ভাবতে হবে। এমন যদি হতো, মৌ যখন বোকা কথাগুলো বলবে, তখন একটা সেন্সর ওর ভোকাল কর্ডগুলো আন্দাজ করে সাউন্ডটা মিউট করে দেবে। মানে মৌ কথা বলবে, বলেই যাবে। কিন্তু আমি কিছু শুনতে পাব না। আবার দরকারি কথার সময় সেন্সর আওয়াজ ফেরত দেবে। ভেবেই বেশ আরাম লাগলো।
মৌ হাসিমুখে কড়াইশুঁটি ছাড়িয়েই চলেছে।

—এর মধ্যে এআই কোথা থেকে এল? এটা তো কোইনসিডেন্স। মায়েদের সময় হলে, এটাকে বলত, ঠাকুর পাঠিয়ে দিয়েছেন। তোমরা এখন বেশি স্মার্ট তাই, কথায় কথায় এআই টেনে আনো।

মৌ টেবিল থেকে উঠে রান্না ঘরে চলে গেল। আমি ফেসবুকে মন দিলাম। শ্রীনন্দিনীর বেশ ঝকঝকে প্রোফাইল। একটা রিকু দিয়ে রাখলাম। অ্যাকসেপ্ট করবে হয়ত। আমরা রেডিওফিজিক্স ডিপার্টমেন্টে পড়তাম। আমি, শ্রী, শৌভিক। প্রত্যেকেই মেধাবী। ডিপার্টমেন্টে মাত্র চারটি মেয়ে। সবথেকে উজ্জ্বল শ্রীনন্দিনী। বাকিরা মন দিয়ে পড়াশোনা করত। ক্লাসনোট নিত। শ্রীও ক্লাস করত। একটু কম। আর নোট তো নিতই না। জোগাড় করত। বিচিত্র উপায়ে।

মৌ রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। রবিবারের ব্রেকফাস্ট, পেঁয়াজ পরোটা আর রায়তা। কড়াইশুঁটি বোধহয় রাতের জন্য ছাড়াচ্ছিল। সামনের টেবিলে ঠক করে থালাটা নামিয়ে বললে,
—কোইনসিডেন্সই হল। সায়েন্স পড়িনি বলে কি ইয়ার্কিও মারা যাবে না?
আমি থালা হাতে তুলে বললাম,
—সব কিছুর লজিক থাকে। এআই তোমার মন বুঝে নিয়ে কিছু করে না। তোমারই কোনও না কোনও অ্যাকশন তাকে সিগনাল দেয় , তুমি এটা চাইছ.. তবেই। ধরো যেমন আমার কদিন ধরেই মনে হচ্ছে, ব্রীফ কেনা দরকার। আর আজ সকাল থেকে মিন্ট্রা আমাকে ক্রমাগত জানাচ্ছে, জানিয়েই চলেছে যে, মিন্ট্রায় পুরুষ অন্তর্বাসে 65% ছাড় চলছে। মানে , আয়াম জাস্ট ফ্লাডেড উইথ অফার্স। কেন?
—বলো কেন?
মৌ ধনুক ভুরু উপরে তুলে তাকিয়ে থাকে।
—কারণ হচ্ছে, কাল দুপুরে আমি দু সেকেন্ডের জন্য ফেসবুকে স্ক্রল করতে গিয়ে ভ্যান হুসেনের জাঙিয়া দেখেছিলাম। মানে দুসেকেন্ড বেশি দেখেছিলাম আরকি। তো এই ট্র্যাক করে ডেটা মাইনিং করে বের করেছে যে আমার জাঙিয়ার চাহিদা আছে। আমাকে বেচা যায়। ওক্কে? এই হচ্ছে কারণ, আর মিন্ট্রার অফার হচ্ছে ফলাফল।
মৌ ছোট্ট করে বলল, “ও”।
—ছোটবেলায় যেমন বাচ্চাদের কারণ বোঝাতে না পারলে বলা হতো, ভগবান দিয়েছেন, এ সেরকম না।
মৌ উঠে যেতে যেতে বলল, তাহলে বলছ এখন আর কোইনসিডেন্স হয় না?

আমি আরেকটা পরোটা নিলাম ক্যাসারোল থেকে। বেড়ে বানিয়েছে। শ্রীনন্দিনীর বাড়ি যেদিন শেষ বার গেলাম, মাসিমা পরোটা আর আচার খাইয়েছিলেন। আলুর পরোটা আর রসুনের আচার। আর ঘোষ সুইটসের ক্ষীর চমচম। চমচমটা আমিই নিয়ে গেছিলাম। পরীক্ষার পর, জামাই সেজে, অনেক আশা নিয়ে। বাড়িতে ডাকছে। বলাতো যায় না। হয়ত তিন বছরের না বলা কথা আজ মাসিমাকে দিয়েই বলাবে। শ্রীর দাদু থেকে নাতি পর্যন্ত দীর্ঘ প্রেমিক তালিকায় যদিও আমি কখনও ছিলাম না। কিন্তু ও এমনিই আমায় খুব পছন্দ করত। পরীক্ষায় আমরা পাশাপাশি বসতাম। ও আমায় খাতা দেখাত। আমি ওকে। সহযোদ্ধা ছিলাম বলা চলে। যাই হোক, শ্রী আশাপূর্ণা নয়। সব আশায় জল ঢেলে মাসিমা জানিয়ে দিলেন, ও ঘুড়ির লাটাই অন্য হাতে আছে।
শোক-দুঃখ মুখে দেখাইনি। মনের কষ্টে দশটার মধ্যে চারখানা চমচম একাই খেয়ে চলে এসেছিলাম।

—কোইনসিডেন্স হয়তো। তবে কোথাও না কোথাও কিছু একটা মিসিং লিঙ্ক থাকে।

আমি সোফায় পা তুলে বসলাম। তাহলে সেই গল্পটা বলে দিই।
মৌ আরেকটা পরোটা প্লেটে দিয়ে ঘন হয়ে বসল।

রাজাবাজারে ভর্তি হলাম ফিজিক্সে বি টেক পড়তে। সপ্তাখানেক হয়েছে। মুখ চেনাচিনি শুরু হয়েছে। একদিন বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি, শ্রীনন্দিনী গেট দিয়ে ঢুকে লম্বা রাস্তা দিয়ে পিপুল গাছের তলা দিয়ে হেঁটে আসছে হিলজুতো খুটখুটিয়ে। লম্বা বিনুনি চাবুকের মতো পিঠে শপাং শপাং পড়ছে। সে এক আলাদাই ব্যাপার। চোখের আরাম, হৃদয়ের শান্তি।

শৌভিক বসু এসে পিঠে হাত রেখে বলল,
—ওদিকে তাকাসনি ভাই। ও বৌদি।
চমকে জিগ্গেস করলাম, বৌদি? কার?
শৌভিক নেড়া মাথায় দিনের বেলায় সানগ্লাস পরে ঘুরত। সিনিয়ররা এলে সানগ্লাস কপালে তুলে কথা বলত। জুনিয়ররা এলে সানগ্লাসের ফাঁক দিয়ে তাচ্ছিল্য ছুড়ে দিত। আর ক্লাসের, অন্য ক্লাসের সব মেয়েকে ফাঁক পেলেই আই লাভ ইউ বলতো। তো সেই সানগ্লাস শুদ্ধু মুন্ডু উপর দিকে হেলিয়ে বললে, তোর , আমার, সবার , গোটা ডিপার্টমেন্টের বৌদি।

হোকগে বৌদি। আমি দু চারদিন চেষ্টা করে শ্রীর সঙ্গে ভাব করে ফেললাম। ক্লাসে ওকে ধরার উপায় ছিল না। চতুর্দিকে কৃষ্ণ ভ্রমর। আমি ওকে ধরার জন্য বাড়ি থেকে আগে বেরিয়ে ফুলবাগান থেকে বাসে উঠতে শুরু করলাম।
শৌভিক ব্যাটা সেটাও ধরে ফেললে কদিন পরেই। বলে, কী? খুবই আঠা দেখছি যে। মরবি শালা। ও বাজে মেয়ে, ঘোল খাইয়ে ছেড়ে দেবে।

শৌভিক হচ্ছে পড়াশোনায় সেরা ছেলে। রামকৃষ্ণ মিশন থেকে পাশ করা। তারপর সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ। দুর্ধর্ষ সেতার বাজায়। ক্রিকেট খেলে। অতিরিক্ত প্রতিভাবান হবার সুবাদে অল্প বিস্তর পাগলও। উত্তরবঙ্গ থেকে কোলকাতায় পড়তে আসা এই আমাকে ও প্রায় ভাই বানিয়ে ফেলেছিল। জাঁ, দিল, জিগরি দোস্ত। ও আমাকে ধরে ধরে কোলকাতা চেনাত। ওর সঙ্গে নাইট শোয় সিনেমা, মদ খাওয়া, গাঁজা সব চালিয়েছি। চমৎকার গাঁজা বানানোর হাত ছিল শৌভিকের। ওর কথা অমান্য করার সাহস ছিল না আমার।
কিন্তু নারী যেখানে, সেখানে শুম্ভ নিশুম্ভ টিকতে পারেনি। আমি আর শৌভিক তো তুচ্ছ। আমি শৌভিককে না বলেই এস পাল স্যারের বাড়ি সন্ধ্যা বেলা যাওয়া শুরু করলাম। পড়া বুঝতে, টিউশন নিতে, অবশ্যই শ্রীর সঙ্গে। ফেরার সময় দুজনে অটোতে পাশাপাশি বসে ফিরতাম। শ্রীর উদ্ধত বুক, গরম শরীর আমার কনুই ছুঁয়ে যেত। উষ্ণ, কোমল হাত আমার হাতের তালুতে লেগে গেলে হাত ঘেমে উঠত। ঐটুকু উত্তেজনাতেই আমার মন প্রাণ যাকে বলে শ্রীনিবেদিত ছিল।

শ্রীকে অন্যরা বিরক্ত করত। চিঠি লিখত, ফলো করত। শ্রী, স্বভাবতই সেই সব নিয়ে আমার কাছে মাঝে মাঝে গজগজ করত। কিন্তু স্পষ্ট বোঝা যেত যে ও এই মনোযোগ পেতে অভ্যস্ত। শ্রী বেশ ডাঁটিয়ালও। ক্লাসে দু চারজন ছাড়া কারো সঙ্গে মেশা দূরের কথা, তাকাতোই না‌। আমি বুঝতাম, আমি ধীরে ধীরে ফ্রেন্ডজোন হয়ে যাচ্ছি। কিন্তু ওই, ক্ষীণ আশা কোথাও না কোথাও থেকে যায়…
.
শৌভিক ওকে উপেক্ষা করত। কিন্তু সে হচ্ছে পাগলা দাশু। কখন ক্লাস করে, কখন করে না… ঘুরে বেড়ায় কোথায় কোথায়। ডিপার্টমেন্টের পরীক্ষা স্কিপ করে বন্যাত্রাণে চলে গেল একবার। খরগোশ পুষেছিল বাড়িতে। একদিন ব্যাগে করে ক্লাসে নিয়ে এল। সে কি হৈ চৈ। মারপিটও করেছে কয়েকবার রাস্তায়। এই ফেস্টে গীটার বাজিয়ে গান গাইল , তো পরেরদিন চলে গেল শ্যামবাজার মোড়ে সিটুর মিছিলে। মোটকথা পড়াশোনা ছাড়া আর সব করত। মহিলাদের বিষয়ে তার বক্তব্য হচ্ছে ওতো টু-বি বাস। একটা যাবে, আরেকটা আসবে। এক জায়গায় থেমে গেলে চলবে না।

শ্রীও ওকে উপেক্ষাই করত‌। কেরিয়ার কনসাস মেয়ে। ফার্স্ট ইয়ারের মাঝামাঝি সময়ে বহু সম্ভাব্য প্রেমিকের বুকে তির মেরে শ্রীনন্দিনী ঘুরতে লাগল ঋষিদার বাইকে। এক বছরের সিনিয়র ঋষিদা ওকে পড়ায়। বাইকে, ক্যান্টিনে, মাঠে, গাছের তলায়। বি গার্ডেন, সিনেমা হলে, আর কোথায় কোথায় জানতে পারিনি। খুবই বিমর্ষ হয়ে গেছিলাম। শৌভিক কদিন ক্লাসে আসেনি। এসেই দুঘণ্টার মধ্যে জল মেপে নিলে। তারপর আমাকে বুকে জড়িয়ে ক্যান্টিনে নিয়ে সিগারেট ধার দিয়ে বললে, নেভাই, খা। আগেই বলেছিলাম, বাজে মেয়ে।

সান্তনা পেয়ে মন হালকা হলো। ঠিক করলাম, এসব ভুলে মন দিয়ে পড়াশোনা করব। পাশ করে ক্যাম্পাসিং-এ ভালো চাকরি পেলে ওরম কতো মেয়ে আসবে যাবে। বসরাই না হোক কাশ্মীরি গোলাপ জুটেই যাবে।

শৌভিক মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ, তুই ওসব ধান্দাবাজ মেয়েদের ছেড়ে দে। নোট নেবার জন্য প্রেম করে। তুই বরং আমার বোনটাকে দ্যাখ। বেশ সুন্দরী না!

চায়ের কাপ থেকে মাথা তুলে দেখলাম। শৌভিকের বোনকে আমি দেখেছি। প্রেসিতে কেমিস্ট্রি পড়ে। ক্যারাটেতে লাল নীল বেগুনি সব বেল্ট করা আছে। মারাত্মক গুন্ডা মেয়ে। দুহাতে সিগারেট টানতে পারে । রজনীকান্তের মতো ধোঁয়ার রিং বানায়। সরাসরি রাজনীতিতে যুক্ত। সব ডিবেটে চ্যাম্পিয়ন। এর সঙ্গে আমি কিভাবে পারব? আমি নিরীহ পড়ুয়া মফস্বলী ছেলে। আর তাছাড়া শৌভিকেরই তো বোন। না পসন্দ হলে বিরাশি সিক্কার কিল মেরে ফাটিয়ে দেবে।

মুখে বললাম, থাক ভাই । ক্ষ্যামা দে। আর তাছাড়া তোর বোনকে আমি বোনের চোখে দেখি।
শৌভিক দাঁত কিড়মিড়িয়ে একটা চার অক্ষরের গালি দিলে। যাকগে।

তো ফার্স্ট ইয়ারে গেল ঋষিদা। শ্রীর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব কিন্তু থেকে গেল। সেকেন্ড ইয়ারে ঋষিদা ভ্যানিশ। নতুন জুটি। শ্রী আর সায়ন। আমি আবার নতুন করে আহত।
ওর মধ্যে কী আছে যা আমার, আমাদের মধ্যে নেই শ্রী?
সে বলা যাবে না। আমার আশার কুসুম তখনো প্রস্ফুটিত। বোধহয় আরো অনেকের। ঋষির পরে সায়ন। সায়নের পরে তো আর কেউ হতেই পারে।

সায়ন প্রচন্ড ভালো ছেলে। মন দিয়ে পড়াশুনা করে। ক্লাসনোট নেয়। শ্রীকে সাপ্লাই করে। শ্রী দেরি করে এসে লাস্ট বেঞ্চে বসে। একেক দিন ক্লাসেই সায়নের গায়ে ঢলে পড়ে। দুজনের চোখে চোখে কথা হয়। তারপর হাতে হাতে। তারপর পায়ে পায়ে। আমি নিজের বুকে হাত বোলাই। চিনচিন করে। হার্ট অ্যাটাক হবে নাকি! বাথরুমে গিয়ে চোখে জল দিয়ে আসি।

শৌভিক দুদিন ক্লাস করে বলল, মরবে শালা সায়ন। তুই কাঁদিস না। মামণি এরও থাকবে না।

সত্যিই থাকল না। থার্ড ইয়ার, দীপেশ স্যার। শ্রীনন্দিনী নর্মাল ক্লাস ছেড়ে স্পেশাল ক্লাস ধরল।
আমাদেরো পড়ার চাপ বেড়েছে। লাস্ট ইয়ার। ক্যাম্পাসিং-এ পেতেই হবে। নাক কান বন্ধ করে পড়াশোনায় মন দিলাম। একমাত্র অকুতোভয় শৌভিক। তার বাউন্ডুলেপনা বিন্দুমাত্র কমেনি। ক্লাস কম করে। সেতারের জলসায় বেশি যায়। তাছাড়াও সমাজসেবা ইত্যাদি। অধ্যাপকদের উদ্ভট সব প্রশ্ন করে বলে, তাঁরাও বিশেষ ঘাটান না। একবার ইলেকট্রনিক্সের বিশাখা সেন ম্যাডামকে বলেছিল, আপনার মেয়ের ফাংশন দেখলাম ম্যাডাম প্রেসির ফেস্টে। বেশ ডাগর হয়ে উঠেছে তো।
আমরা তো খাবি খাচ্ছিই। ম্যাম নিজে এতো অবাক হয়েছিলেন, যে রিঅ্যাক্ট না করেই চলে গেলেন।

তো যাই হোক, শ্রীর সামনে ভালো নম্বর পাওয়াটা চ্যালেঞ্জ, তাই মন দিয়ে পড়ছি রাত জেগে। কাকার বাড়িতে থাকতাম। তখন কাকাদের ল্যান্ডলাইন ফোন ছিল। আর ওই পড়ার ঘরের দরজার ঠিক বাইরেটাতেই টেলিফোনটা রাখা থাকত। বেশিরভাগ সময় ফোন বাজলেই আমি ধরতাম। পরীক্ষার আগে কদিন খেয়াল করলাম, ঠিক রাত বারোটা-সোয়া বারোটায় একটা রিং হচ্ছে। ধরতে গেলে কেটে যাচ্ছে। কিন্তু হচ্ছে ফুল রিং। একবার বারোটার আশেপাশে। আরেকবার সাড়ে বারোটা নাগাদ। আন্দাজ করলাম খুড়তুতো বোন টিকলির কোনও প্রেমিক টেমিক জুটেছে হয়তো। কিন্তু টিকলি তো দোতলায় ঘুমায়। যাক গে। অত মাথা ঘামানোর সময় নেই।

পরীক্ষার আগে অ্যাডমিট নিতে কলেজ গেছি। ডিপার্টমেন্টে শুনছি তুমুল হইচই। কাছে গিয়ে দেখি, শৌভিক, দিব্যকে, আমাদের দিব্যপ্রতীমকে কলার ধরে মেঝে থেকে উপরে তুলে শাসাচ্ছে।

—ফের যদি দেখেছি তোকে শ্রীর আশেপাশে, সোজাসুজি আপার সার্কুলার রোডে ছুড়ে লরির সামনে ফেলে দেব।

দিব্য রোগা পাতলা, নিরীহ, কপালে ফোঁটা কাটা, ঠাকুর ভক্ত নদীয়া জেলার ছেলে। সে হাত পা ছুড়ছে প্রাণপনে। কী বলার চেষ্টা করছে, ভালো বোঝা যাচ্ছে না। কোনো রকমে নামিয়ে, দুজনকে ছাড়িয়ে শৌভিককে সাইডে নিয়ে এলাম। বাকিরা দিব্যকে ধরেটরে ডিপার্টমেন্টের ভিতরে নিয়ে বসাল। জলটল খাইয়ে ঠিক করছে। পিছনের বেঞ্চে দেখি, শ্রীনন্দিনী মুখ শুকিয়ে বসে আছে।

শৌভিককে বাদুড়বাগান পার্কে নিয়ে একটা সিগারেট দিয়ে বললাম,
—ভাই একি হল? তুই না বলেছিলি, ও বাজে মেয়ে,মিশিস না..
শৌভিক ফ্যাঁচ করে নাক টেনে বললে,
—সেতো তোরা যাতে না ঘেঁষিস সেইজন্য।
—মানে? তুই সেই ফার্স্ট ইয়ার থেকে ছিপ ফেলে বসেছিলি?
আমি আশ্চর্য হয়ে যাই।
—কিন্তু দিব্যর সঙ্গে কিভাবে জানলি? দীপেশ স্যার কবে শিফট করল?
শৌভিক জামার আস্তিনে মুখ মুছলে। মুখ না হতাশা কে জানে!
—দূর, দীপেশের পাত্তা অনেক দিন কেটে গেছে। আমি ফলো করতাম তো। দীপেশের বাড়ি যাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। তাহলে মালটা ফাঁকা নয় কেন? এক তুই ছিলি আর দিব্য। তোদের দুজনের সঙ্গেই ডেকে কথা বলে। আমি রাতে ফোন করতাম ল্যান্ডলাইনে। বারোটা নাগাদ। তোর ফোন রিং হতো। হয়ে কেটে যেত। শ্রীর ফোন, দিব্যর ফোন রাত এগারোটা থেকে রাত একটা , দুটো পর্যন্ত বিজি। আর কী হবে!
আমি হাঁ হয়ে যাই। মুখ থেকে পট করে সিগারেট পড়ে যায়। ওই ফোন করত রোজ। আর তাও এইজন্য!

শৌভিককে পার্ক থেকে তুলে বাড়ি দিতে গেলাম। আহত, মনমরা শৌভিককে দেখে ওর সেই গুন্ডা বোন মিলু মহাকাঁইমাই লাগিয়ে দিল।
—দাদাটা চিরকাল গাধা। আরে প্রেমের জন্য মারপিট করতে আছে! ও হল টু-বি বাস। একটা কাটবে আরেকটা আসবে।
ভাইবোনের সম্প্রীতি দেখে মুগ্ধ হয়ে বাড়ি চলে এলাম। আসার আগে, শৌভিক জামা খামচে বললে,
—বলতো ওই হতভাগা মফস্বলী দিব্যর কি আছে? যা আমার নেই?

পরীক্ষা শেষের দিন শ্রীনন্দিনী আমাকে ওর বাড়ি নিয়ে গেল। আনন্দে আমার পেটের মধ্যে প্রজাপতি উড়ছে। বাড়িতে ঢোকার আগে, একটু ঘুরে আসছি বলে, মিষ্টিও নিয়ে গেলাম।
শ্রীর মা, আমাকে বললেন,
—তুমি তো ওর বেশ বন্ধু । তোমার কথা মেয়ে খুব বলে। একটা কথা বলি বাবা বিশ্বাস করে?
বাবা! তবে তো বাবাজীবন হতে বেশি দেরি নেই। আনন্দে আমার মন ডগোমগো।
—দেখো, শৌভিকও তোমার বন্ধু। ওর মা আমাকে ফোন করে বলছেন, বিয়ের কথা। পাশ করে, চাকরি হলেই শ্রীকে উনি বিয়ে দিয়ে নিয়ে যেতে চান। কিন্তু মেয়ে তো এসব ভাবছে না। ওঁরা শুনছেন না কিছুতেই। খুবই নাছোড়বান্দা ছেলে।
আমি ঢোঁক গিলে বললাম,
—তা কি হয়েছে মাসিমা, শৌভিক তো ভালো ছেলে। চাকরি তো পাবেই। খুব গুণীও।
মাসিমা একটু চুপ থেকে বললেন,
—কিন্তু শ্রীর বিয়ে যে ক্লাস নাইন থেকে ঠিক করা আছে বাবা। ওর বাবার বন্ধুর ছেলে, অনীশ। সে এখন বার্মিংহামে আছে। চাকরি করে। ইঞ্জিনিয়ার। শ্রীর পরীক্ষা শেষ হলেই দেশে ফিরে বিয়ে করে নিয়ে যাবে ওখানে। সব সেটলড।

একই সঙ্গে আনন্দ এবং বেদনা হলে বুকের অবস্থা কী হয় সেই আমি বুঝলাম।
শ্রী চলে যাবে অন্য কারও হয়ে। এটা বেদনা।
আর আমি একা নই, সকলেই, মানে ডিপার্টমেন্টের প্রায় সকলেই, মায় দীপেশ স্যার পর্যন্ত মরীচিকা দেখছিলেন, এইটেই আনন্দের। চারখানা চমচম সাঁটিয়ে উঠে পড়লাম।
শৌভিককে বললাম,
—ছেড়ে দে, বাস ছেড়ে গেছে। পরের বাসের জন্য চেষ্টা কর।

মৌ এতক্ষণ গোল চোখ করে শুনছিল। বলল, তারপর?

—তারপর কী? শ্রীনন্দিনী, অনীশ সেনকে বিয়ে করে বার্মিংহাম চলে গেল। তারপর ওখানে পিএইচডি করল। তারপর চাকরি। উন্নতিই উন্নতি। কবছর আগে শুনেছি ডিভোর্স হয়ে গেছে। এখন তো দেখছি সিয়াটলে আছে।
শৌভিক চাকরি পেয়ে প্রথমে ব্যাঙ্গালোর, তারপর এখন আমেরিকায় সেটলড। বিয়ে করেছে, অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ। ওর বউও শুনেছি সেতার বাজায় চমৎকার। স্বামী স্ত্রী মিলে বাজনা বাজিয়ে ভালোই আছে। যোগাযোগ প্রায় নেই কারও সঙ্গে। সবাই ব্যস্ত। আমিও। আজ কাগজে শ্রীনন্দিনীর ছবি দেখলাম বলে মনে পড়ল এসব।

মৌ মুখ টিপে হেসে উঠে গেল খালি প্লেট নিয়ে। এবার বাজার যেতে হবে।
উঠব উঠব করছি, ফোন বাজল।

অচেনা নম্বর। ধরতেই বহুযুগ আগের চেনা গলা।
—ভাই কেমন আছিস? চিনতে পারছিস?
চমকে গেলাম। শৌভিক! প্রায় দশ বছর পর। শেষ দেখা হয়েছিল ওয়াশিংটনে। আমি গেছিলাম অনসাইট পোস্টিংএ। এতদিন পর..

বিস্ময়ের তখনও বাকি। শৌভিক এখন সিয়াটলে। শ্রীনন্দিনীও ওখানেই।
মৌ এসে গেছিল গাড়ির চাবি নিয়ে। কথোপকথনে বুঝতে পেরেছে। মুখ টিপে হেসে বলল, কোইনসিডেন্স! না না ভগবান মিলিয়েছেন।

অলংকরণ-রাতুল চন্দরায়

1 COMMENT

Comments are closed.