সৈয়দ রেজাউল করিম

(খাকি উর্দি গায়ে কয়েক যুগ চষে বেড়িয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্ত। রাজ্যের বিভিন্ন থানা ও ক্রাইম ব্রাঞ্চে কাজ করতে গিয়ে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাই হয়ে উঠেছে সৈয়দ রেজাউল করিমের লেখালেখির রসদ।)

সাধনবাবুকে বলে যোগেশবাবু আমাদের সাথে চলে এলেন সুচরিতাদির কোয়ার্টারে। আমি অবাক চোখে যোগেশবাবুর দিকে তাকিয়ে ছিলাম। তা উপলব্ধি করে যোগেশবাবু বললেন— আমাকে যেন তোমরা নতুন দেখছ। ওরকম করে দেখার কি আছে?
আমি বললাম— স্যার! আপনাকে দেখছি আর ভাবছি, কোন যাদুবলে এটা সম্ভব? পঁয়ত্রিশ বছর আগে যেমনটা দেখেছি, ঠিক একইরকম আছেন স্যার! একটুও পরিবর্তন হয়নি। এটা কি করে সম্ভব? এর রহস্যটা আমাদের জানা দরকার।
সুচরিতাদি বলল— আপনি কি যোগব্যায়াম করেন স্যার? না হলে শরীর এরকম ফিট থাকে কি করে?
—একটু আধটু যোগব্যায়াম করি। বাগানে খাটি। প্রতিদিন ঘন্টাখানেক হাঁটি। তবে এসব কিছু ফিট থাকার মূল মন্ত্র নয়।
—তাহলে ফিট থাকার মূল মন্ত্রটা কি স্যার? আমি সাথে সাথেই যোগেশবাবুকে জিজ্ঞেস করে বসলাম।
যোগেশবাবু বললেন— ডাক্তারবাবুরা কী বলেন জানি না। আমার মনে হয়, মনের সুখ শান্তি আর হাসিখুশি থাকাটা ফিট থাকার বড় কারন।
—কিন্তু আপনি যখন বালুরঘাট থানাতে ছিলেন তখন আপনাকে কোনওদিন প্রাণখুলে হাসতে দেখিনি— সুচরিতাদি প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে জবাবের অপেক্ষায় রইল।
যোগেশবাবু বললেন— সে তো তোমার চেহারায়ও দেখেছি। কেমন যেন একটা দুঃখ বিষণ্ণতায় ভরে থাকত তোমার মন। জানিনা এর পিছনে কী ইতিহাস লুকিয়ে আছে। তবে যাই থাক না কেন, বন্ধুবান্ধবদের কাছে বলে মনটা একটু হাল্কা করো। তাহলেই দেখবে চলার পথ অনেকটা সহজ হয়ে যাবে। শরীর স্বাস্থ্য ঠিক থাকবে।
সে কথা শুনে সুচরিতাদি কিছুটা সহজ হবার চেষ্টা করল, কিন্তু মুখ খুলল না। আমিও তা জানার জন্য জোরাজুরি করলাম না। প্রসঙ্গ পাল্টে যোগেশবাবু হঠাৎ আমাকে বললেন, তোমার নতুন বইটা পড়ে ফেললাম।
আমি অবাক হয়ে গেলাম। বললাম— স্যার! কোথায় পেলেন বইটা?
—অদ্ভুত প্রশ্ন করলে! প্রচ্ছন্ন ধমকের সুরে যোগেশবাবু বললেন— বইটা তুমি আমাকে দাওনি। এ কথাটা যেমন ঠিক, তেমন এটাও ঠিক বইটা প্রকাশিত হয়েছে কয়েক মাস আগে। আমি তোমার নাম দেখে ইংলিশবাজারের বইমেলা থেকে কিনে এনেছিলাম। পড়েও ফেললাম আগাগোড়া। খুব ভালো লিখেছ। পড়তে পড়তে খুঁজে পেলাম ফেলা আসা জীবনের বহু ঘটনা বহু ঘটনা। খুব মজা পেলাম। বদরুদ্দোজা সাহেব যে মুখবন্ধটা লিখে দিয়েছেন, সেটাও অনবদ্য। সাহিত্যের প্রতি গভীর নিষ্ঠা না থাকলে এরকম মুখবন্ধ লেখা যায় না।
যোগেশবাবু আমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। আর সুচরিতাদি তখন নীরব শ্রোতা। মুখ ভার। কিন্তু কেন? সুচরিতাদি তো কখনও আমার ভালো ছাড়া মন্দের কথা ভাবেনি। নিজে না খেয়ে আমাকে খাইয়েছে বহুদিন। আমার সুবিধে অসুবিধের কথা জানতে চেয়েছে বার বার। তাহলে হঠাৎ তার মন ভার কেন? যোগেশবাবু আমাকে প্রশংসা করছে বলে?
একটু খোঁচা দিতেই সুচরিতাদির বেশ গম্ভীর হয়ে বলল, এতবছর তোর সাথে আমার পরিচয়। কত কথাবার্তা হয় আমাদের মধ্যে। কোনওদিন তো বলিসনি, আমি একটু লেখালিখি করি। ভালোবেসে কোন লেখা তো পড়তে দিসনি। একটা বই তো হাতে তুলে দিসনি। এখন তোর উপর রাগ করব না তো কার উপর রাগ করব? তোকে দিনকে দিন দেখছি আর অবাক হচ্ছি, তুই মানুষ না অন্য কিছু! ভগবান তোকে কোন ধাতু দিয়ে গড়েছে?
সুচরিতাদির অগ্নিমূর্তি দেখে যোগেশবাবু বললেন— তুমি শুধু শুধুই ওর উপর রাগ করছো। তোমাকে ও খুব ভালোবাসে। সেইজন্যই তো ‘থানার দুয়ারে ভালোবাসা’ উপন্যাসের নায়িকা করে রেখেছে তোমাকে। তোমরা একসাথে যে সব কাজকর্ম করেছ, সে সমস্ত বর্ণনা দিয়ে লেখা। ও নিশ্চয়ই তোমাকে….।
যোগেশবাবুর কথা শেষ করতে না করতেই প্রতিবাদী সুরে সুচরিতাদি বলল— কি সব আজেবাজে বলেছেন স্যার? আমি ওর গল্পের নায়িকা হতে যাব কেন? ওর তো অনেক ভালোবাসার পাত্রী আছে। মিতা, মধুমতী, আর কে কে আছে কে জানে!
—আছে তো আরও অনেকেই। কিন্তু কাউকে নিয়ে ঘর বাঁধতে পারলাম না আজও। এই বয়সে আর ঘর সংসার বানাবার ইচ্ছে নেই আমার। কলেজ জীবনের পরে মনে মনে যাকে ভালোবেসেছিলাম,তার কাছ থেকেও সাড়া পাইনি কোনদিন।
সুচরিতাদি তৎক্ষণাৎ ভ্রুদুটো উঁচিয়ে জানতে চাইল– কে সে ? কার কথা বলছিস তুই ? আমাকে বল। তাকে ধরে এনে…।
সুচরিতাদি কথা শেষ করতে না দিয়ে আমি বললাম— তার কথা আর একদিন শোনাব তোমাকে। তার আগে আমার কথা শোন। তোমার জন্য আমি আমার লেখা পাঁচ খানা বই সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি। কিন্তু এখন সবগুলো বই পাবে না। তোমাকে তিনখানা, স্যারকে দু’খানা বই দেবো।
সুচরিতাদি নিজেই উঠে গিয়ে আমার ব্যাগ থেকে পাঁচটা বই বার করে নিয়ে এলো। নিজেই ভাগ বাটোয়ারা করে নিল। স্যারকে দিল ‘একটি মার্ডার এবং তারপর’ আর ‘খুনে’। নিজে রাখল ‘থানার দুয়ারে ভালোবাসা’, ‘যতীন দারোগার মেয়ে’ এবং ‘আনন্দের খোঁজে’।
যোগেশবাবু উপন্যাস দু’টি পেয়ে খুব খুশি। ঠিক সেইসময় খাবার জন্য ডাকতে এলেন সাধনবাবু। সুচরিতাদি বলল— চলুন। আমরা আসছি।
সাধনবাবু চলে যেতেই যোগেশবাবু আমাকে বললেন— আমার পুলিশ জীবনও অনেক ঘটনাবহুল। তার মধ্যে জীবনের গল্পও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। সে রকম দু’চারটে গল্প তোমাদের শোনাব। সাধন-সন্ধ্যার মতো কাহিনিও তার মধ্যে আছে। শুনলে চমকে উঠবে তোমরা। চোখ কপালে তুলে বলবে, এরকমটাও ঘটে?
আমি বললাম, খুব ভালো হবে স্যার! আমার গল্প উপন্যাসের রসদ পাওয়া যাবে।
(ক্রমশ)

অলংকরণ-রাতুল চন্দরায়