শুভেন্দু রায় চৌধুরী

ফুটবলকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার মতো সুরজিৎ সেনগুপ্তের সহজাত দক্ষতার সাক্ষী থেকেছি বহুবার। এখনও চোখের সামনে স্পষ্ট, ক্রীড়া সাংবাদিক ক্লাবের এক প্রতিযোগিতার সেমিফাইনালে রবীন দাসের সেন্টার থেকে বাঁ পায়ের সুতীব্র জ্যাবে ভাস্কর গাঙ্গুলিকে পরাস্ত করা গোলটির কথা। মনে আছে, সন্তোষ ট্রফি ফাইনালে পাঞ্জাবের বিরুদ্ধে করা গোলটির কথাও। তবে আমার দেখা সুরজিতের সেরা গোলটি ছিল ছিয়াত্তরের শিল্ডে খুব সম্ভবত মহারাষ্ট্রের একটি দলের বিরুদ্ধে।

ছিয়াত্তরে কলকাতা ফুটবলে একটানা ছয় বছরের একাধিপত্য হারিয়ে ইস্টবেঙ্গল তখন মনমরা। তাই বোধহয় এক অখ্যাত দলের বিরুদ্ধে ইস্টবেঙ্গল গোল পায়নি দ্বিতীয়ার্ধের মাঝামাঝি পর্যন্ত। গ্যালারি উত্তপ্ত হতে শুরু করেছে। এমন সময় ডানদিক থেকে ভেসে আসা এক নিরীহ বলে পেনাল্টি বক্সের বাঁ দিকের প্রান্ত থেকে গোটা শরীরটাকে শূন্যে ছুড়ে সুরজিৎ ডান পায়ে একটা ভলি করলেন। পায়ে বলে সংযোগের সময় তাঁর মাথা ছিল বিপক্ষের গোলের দিকে আর পা ছিল নিজের গোলের দিকে। এমন অবস্থায় বল তিরের মতো সোজা গোলে পাঠানো যে কত কঠিন— তা ফুটবল সম্বন্ধে সামান্য জ্ঞান থাকলেই বোঝা যায়। কিন্তু যিনি সেই অসাধ্য সাধন করেছিলেন আনায়াস দক্ষতায়, তাঁকে দেখলাম গোলের পর যেন কিছুই হয়নি— এমন ভঙ্গিতে নিজেদের অর্ধে ফিরতে।

ওই অবিশ্বাস্য গোলের বর্ণনা ভাষায় কতটা বোঝাতে পারলাম জানি না। তবে একটা তথ্য জানালে সকলেই বুঝে যাবেন গোলটি কোন পর্যায়ের ছিল। ২০১৬ সালের উয়েফা চ্যাম্পিয়নশিপে পোল্যান্ডের বিরুদ্ধে ঠিক একই ধরণের গোল করেছিলেন সুইজারল্যান্ডের সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবলার শ্রেডান শাকিরি। সেটি ওই প্রতিযোগিতায় অন্যতম সেরা গোলের সম্মান পেয়েছিল। ইউটিউবে সাকিরির গোলটি দেখলেই বুঝতে পারবেন, সত্তর দশকে কলকাতা ফুটবলের মান কতটা উন্নত ছিল। দু’টি গোলের মধ্যে তফাৎ বলতে কেবল দু’টি। শাকিরি গোলটি করেছিলেন ডানদিক থেকে বাঁ পায়ে এবং বলটি গোল ঢোকার আগে ড্রপ খেয়েছিল যা প্রথম গোলটির ক্ষেত্রে ঘটেনি।

ফুটবল মাঠের অসামান্য প্রতিভা সুরজিৎ সেনগুপ্ত মাঠের বাইরেও ছিলেন নিরলস যোদ্ধা। তাঁর অংসখ্য লড়াইয়ের মধ্যে কেবল একটির কথাই এখানে উল্লেখ করব। ১৯৭৯-র শুরুতেই এক ঝাঁক ভিনরাজ্যের ফুটবলারকে নিয়ে এসেছিলেন ইস্টবেঙ্গল কর্তারা। উদ্দেশ্য, ঘরের ছেলেদের কোণঠাসা করা। ভিনরাজ্যের ফুটবলারদের মধ্যে পাঞ্জাবের মনজিৎ সিং তখন অবসর নেওয়ার পথে। হরজিন্দার সিং দারুণ ফুটবলার। বাঁ পা চলে দুর্দান্ত। কিন্তু চোট থাকায় পুরো সময় খেলার মতো ফিট নন। আর গুরদেব সিং ছিলেন রক্ষণের সবচেয়ে দুর্বলতম স্থান। এককথায় তখনকার কলকাতা ফুটবলের সঙ্গে মোটেই মানানসই নন। তবুও গুরদেব কর্তাদের বদান্যতায় প্রথম দলে নিয়মিত সুযোগ পাচ্ছিলেন। কিন্তু অপর পাঞ্জাবি ফুটবলারদের ফর্ম এতটাই করুণ ছিল যে তাঁদের মাঠে নামানোই যাচ্ছিল না। আর সেই কারণেই শুরু হল দ্বন্দ্ব। যোগ্য ফুটবলাররা সুযোগ পাক বা না পাক— পেয়ারের ওই ফুটবলারদের সুযোগ দিতেই হবে, এমন জেদ ধরেছিলেন কর্তারা। কিন্তু কোচ এবং অনান্য সিনিয়র ফুটবলারেরা দলের কথা ভেবেই এমন সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে কর্তাদের রোষের মুখে পড়েন। তখন সুরজিৎ শুরু করেছিলেন সম্মানরক্ষার লড়াই। আর সেই লড়াইয়ে তাঁর সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন এক ঝাঁক ফুটবলার। সেই প্রথম এবং শেষ। কলকাতার ফুটবলে কর্তাদের বিরুদ্ধে এমন ভাবে রুখে দাঁড়ানোর ঘটনা কিন্তু আর কখনও ঘটেনি। সহখেলোয়াড়দের নিয়ে একযোগে দল ছাড়ায় তাঁকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছিলেন ওই ক্লাব কর্তারা।

১৯৮০ সালে নতুন দলের হয়ে ফেডারেশন কাপের ম্যাচ খেলতে গিয়ে গুরুতর আহত অবস্থায় সুরজিৎকে যখন স্ট্রেচারে করে মাঠের বাইরে নিয়ে আসা হচ্ছিল, তখনও ওই সমস্ত কর্তাদের কাছ থেকে টিকিট পাওয়া চামচেরা ইডেনে হরিবোল ধ্বনি তুলেছিলেন। তাতেও তাঁকে দমানো যায়নি। ওই সাংঘাতিক চোটের পরেও মাথা উঁচু করেই তিনি ময়দানে ফিরেছিলেন। তখনও তাঁর ফুটবলের দাপট এতটুকু কমেনি। এর প্রমাণ ১৯৮১-র ফেডারেশন কাপে সেরা খেলোয়াড়ের সম্মান। সেই ফুটবল দেখে ৮২ সালের এশিয়াডে ভারতীয় দলের টেকনিক্যাল ডিরেক্টর ডেটমার ফিফার সুরজিৎকে অনুরোধ করেছিলেন, অবসর ভেঙে আন্তর্জাতিক ফুটবলে ফিরতে। কিন্তু তিনি সেই অনুরোধে সাড়া দেননি। যেমন দেননি বিদেশে খেলার প্রস্তাবেও। এমন মাথা উঁচু করে চলার প্রবণতার জন্যই বোধহয় তাঁকে বঞ্চিত হতে হয়েছে অধিনায়কত্ব, পুরস্কার প্রভৃতি অনেক কিছু থেকেই। তবুও ফুটবল ও ফুটবলারদের প্রতি তাঁর ভালোবাসা টোল খায়নি। খেলা ছাড়ার পর গড়ে তুলেছিলেন ফুটবলার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন। সব মিলিয়ে এমনটাই ছিলেন কখনও হার না মানা সুরজিৎ সেনগুপ্ত।
(ক্রমশ)

অলংকরণ- রাতুল চন্দরায়