শুভেন্দু রায় চৌধুরী

সময়টা ছিল ভীষণই অশান্ত। দুই বাংলাই তখন উত্তাল। এক বাংলার চোখে স্বাধীনতার স্বপ্ন। আর অন্য বাংলা দিনবদল ঘটাতে বদ্ধপরিকর। সমানে রক্ত ঝরছে দুই বাংলাতেই। সেই রক্তঝরা, দমবন্ধ সময়ের শিকার হয়েছিলাম আমি আর আমার মতো বেশ কিছু কিশোর-কিশোরী। তখন কার্যত গৃহবন্দি থাকতে হতো আমাদের। কারণ, পুলিশে (police) চাকরির সুবাদে আমাদের সকলেরই পিতৃদেবের উপর ছিল রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব। প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে বাড়িতে চিঠি আসাটা প্রায় নিয়মে পরিণত হয়েছিল। স্কুলে-কলেজ, খেলাধূলা সবকিছুই বন্ধ। মন ছটফট করত। কিন্তু করার কিছুই নেই। এমন পরিস্থিতিতে সময় কাটানোর সবচেয়ে বড় সহায় ছিল খবরের কাগজের খেলার পাতা আর রেডিয়োতে বড় ম্যাচের ধারাবিবরণী।

উত্তপ্ত সত্তর দশকের প্রথম কয়েকটা বছর আমাদের কেটেছে ঠিক এমন ভাবেই। তবে সেজন্য এখন কোনও ক্ষোভ নেই। কারণ, কার্যত গৃহবন্দি থাকায় বিনা বাধাতেই সত্তরের সাড়াজাগানো ফুটবল (football) উপভোগ করতে পেরেছিলাম আমরা। পড়ার বই খোলা। তবে কান রয়েছে স্থানীয় সংবাদের দিকে। খবরের একেবারে শেষে বলা হবে সিনিয়র ডিভিশন ফুটবল(football) লিগের সেই দিনের খেলার ফলাফল। খবর শেষের সময় যতই এগিয়ে আসত, ততই বুকের মধ্যে ধুকপুকানি বেড়ে যেত। একমনে প্রার্থনা করে যেতাম যাতে প্রিয় দল পয়েন্ট নষ্ট না করে। কারণ, তখন লিগ জেতা আর না জেতার মধ্যে পয়েন্টের ব্যবধান থাকত বড়জোর এক বা দুই। এক বড় দল পয়েন্ট নষ্ট করলেই অপর দল চ্যাম্পিয়ন হবার স্বপ্ন দেখতে শুরু করত। তাই প্রতিটি ফুটবল (football) ম্যাচেই হতো মরণ-বাঁচন লড়াই। সেই লড়াই শুধু যে আমাদের মতো কিশোরদের অনুপ্রেরণা দিত তা-ই নয়। প্রায় সব বাঙালির কাছেই তা ছিল অক্সিজেনের মতো।

ফুটবল (football) প্রেমের গভীরতা যে কী, সেই ছোটবেলাতেই একটা ছোট্ট ঘটনায় বুঝে গিয়েছিলাম। নিজের নিরাপত্তা নিয়ে যাবতীয় ভয়-ডর ফুৎকারে উড়িয়ে আমার ক্রীড়প্রেমিক পিতৃদেব সপরিবার হাজির হয়েছিলেন ইডেন গার্ডেনসে একাত্তরের বড় ম্যাচ (এখনকার ডার্বি) দেখতে। সে দিন দুই বড় দলের লড়াই উপভোগ করেছিলাম ঠিকই। কিন্তু সেই সঙ্গে সচেতনও ছিলাম যাতে বাবার পুলিশ (police) পরিচয় প্রকাশ না পায়। মা’র পইপই করে বলে দেওয়া নির্দেশ ঠিক মতোই পালন করেছিলাম সেই উদ্দেশে। সব কিছু প্রায় ম্যানেজ হয়েই এসেছিল। কিন্তু গোল বাধলো খেলার শেষে স্টেডিয়াম থেকে বেরিয়ে আকাশবাণী ভবনের সামনে আসতেই। ঘরমুখী বিশাল জনতার স্রোতের মধ্য থেকে হঠাৎই যেন মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে এলেন পুলিশের (police) ইউনিফর্ম পড়া এক তরুণ। সামনে এসেই বাবাকে পুলিশি কায়দায় স্যালুট ঠুকলেন। স্বভাবতই আশপাশের বেশ কিছু চোখের দৃষ্টি তখন এসে পড়ল বাবার উপর। তাদের চোখেমুখে জিজ্ঞাসা, এতক্ষণ পাশে বসে খেলা দেখা লোকটি আসলে কে? আকস্মিক এই ঘটনায় আমরা রীতিমতো শঙ্কিত। তীরে এসে তরী ডুববে না কি? বাবা কিন্তু যেন কিছুই হয় নি— এমন ভঙ্গিতে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়লেন, ‘আরে, তুমি এখানে? ডিউটি ছিল না কি?’ জবাবে সলজ্জ ভঙ্গিতে ওই ভদ্রলোক জানিয়েছিলেন, শত চেষ্টাতেও তিনি বড় ম্যাচের টিকিট জোগাড় করতে পারেননি। তাই বিপদের সম্ভবনা সত্ত্বেও পুলিশের (police) পোশাকেই চলে এসেছিলেন যাতে মাঠে ঢুকতে সুবিধা হয়। আর তাঁর উদ্দেশ্য সফলও হয়েছিল।

এই ছিল সেই সময় ফুটবলের প্রতি বাঙালির ভালোবাসা। যেখানে ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নেহাতই তুচ্ছ বিষয়। ওই তরুণ পুলিশ (police) অফিসার শুধুমাত্র খেলা দেখার জন্য নিজের জীবন কতখানি বিপন্ন করেছিলেন তা অন্য একটি ঘটনার উল্লেখেই স্পষ্ট হবে। খুনখারাবির জন্য কুখ্যাত এক অঞ্চল দিয়ে যাচ্ছিলেন এক সাধু। পরিবর্তনকামীদের চোখে পড়তে তাঁকে আটক করা হয়। পরের দিন একটি ঝোপ থেকে পুলিশ (police) ওই সাধুর মৃতদেহ উদ্ধার করে। সন্ন্যাসীকে কেন মরতে হয়েছিল? তদন্তে উঠে এসেছিল এক বিস্ময়কর তথ্য। হত্যাকারীরা নাকি সাধুর হাতে ঘড়ির দাগ দেখতে পেয়েছিলেন। সেই ঘড়ির দাগের ভিত্তিতেই তাঁকে পুলিশের চর ভেবে খুন করা হয়। আর এমন সময়েও পুলিশের পোশাক গায়ে চাপিয়ে শুধু খেলা দেখার উন্মাদনায় ফুটবল (football) মাঠে যাওয়া!

আসলে সেই অশান্ত সময়ে ফুটবলের (football) প্রতি বাঙালির প্রেম-উন্মাদনার যথেষ্ট কারণও ছিল। গ্রীষ্ম থেকে বর্ষা— বলা ভালো পুজোর আগে পর্যন্ত তখন কলকাতা ময়দান দাপিয়ে বেড়াতেন একদল দামাল যুবক। জীবনের সব ভালোবাসা তাঁরা উজাড় করে দিয়েছিলেন ফুটবলকে।
(ক্রমশ)

অলংকরণ- রাতুল চন্দরায়