শুভেন্দু রায় চৌধুরী

কলকাতা ময়দানে ভদ্র এবং শিল্পী ফুটবলারদের তালিকায় দু’টি নাম অবশ্যই থাকবে। এঁদের একজন হলেন সমরেশ চৌধুরী অন্যজন সুরজিৎ সেনগুপ্ত। দু’জনের বেড়ে ওঠার পরিবেশে ভিন্ন। কিন্তু দু’জনেরই যেন ঈশ্বরদত্ত প্রতিভা। বলের উপর দক্ষতা সংশয়াতীত। সমরেশ পেয়েছিলেন বাঘা সোমের সান্নিধ্য। সুরজিৎ বেড়ে উঠেছিলেন অচ্যুৎ ব্যানার্জীর ছত্রছায়ায়। দলমত নির্বিশেষে এঁদের খেলার ভক্ত ছিলেন সকলেই।
সেই সময় কলকাতার ময়দান কাঁপানো সমরেশ ও সুরজিৎ সেনগুপ্তের মধ্যে অন্য একটি জায়গাতেও মিল রয়েছে। সেটা হল, কর্মকর্তাদের মন জুগিয়ে চলতে না পারার জন্য একই ক্লাবে সারজীবন খেলে যাওয়া এই দু’জনের ক্ষেত্রেই সম্ভব হয়নি। সমরেশ চৌধুরী আর সুরজিৎ সেনগুপ্তের মতো খেলোয়ারদের বারে বারে ক্লাব কর্মকর্তাদের অবিচারের শিকার হতে হয়েছে। তবু যে দলেই এঁরা গিয়েছেন, সেখানেই সফল হয়েছেন। নিজেদের দলকে একাধিক ট্রফি জিততে সাহায্য করেছেন এই শিল্পী ফুটবলারেরা। গ্যালারিতে বসে ওঁদের খেলা দেখার মুগ্ধতা জীবনেও কাটবে না।
সে এক আশ্চর্য সময়। এখন ভাবলে অবাক লাগে। খুনখারাপি, বোমাবাজি, পুলিশের গুলি ছিল নিত্যদিনের ব্যাপার। সেই সমস্ত ঝামেলার মধ্যে পড়ার যথেষ্ট ভয় থাকলেও, শহর ও শহরতলি থেকে অসংখ্য যুবক ভোরের আলো ঠিক মতো ফোঁটার আগেই হাজির হয়ে যেতেন ময়দানে। তাঁদের অনেকেই পরবর্তীকালে ময়দান মাতিয়েছেন। আবার বেশ কিছু যুবক জ্বলে উঠতে না পেরে ময়দান থেকে হারিয়েও গিয়েছেন। চুনী, বলরাম, পিকে, জার্নাল সিংরা তখন অস্তমিত। তবুও যাঁরা ছিলেন— তাঁরা খেলোয়াড় জীবনের শেষদিন পর্যন্ত চেষ্টা করে গিয়েছেন ওই সব মহীরুহদের ছুঁতে।
কাকে ছেড়ে কার কথা বলব? চট্টগ্রাম থেকে অশোকনগরে এসে ডেরা বেঁধেছিল চৌধুরী পরিবার। ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকেই সেই পরিবারের সন্তান সমরেশ (পিন্টু) চৌধুরী হয়ে উঠেছিলেন কলকাতা ময়দানের এক সুপরিচিত নাম। ছেষট্টি সালে বেনিয়াটোলা ক্লাবের হয়ে ময়দানে পা রেখেছিলেন তিনি। তারপর আর ঘুরে তাকাতে হয়নি। বেনিয়াটোলা থেকে উয়াড়ি হয়ে সোজা ইস্টবেঙ্গল। জ্যোতিষ গুহের জহুরি চোখ ঠিক চিনেছিল তাঁর ফুটবল প্রতিভাকে। আর সেই বিশ্বাসের মর্যাদাও রেখেছিলেন সমরেশ।
সমরেশ প্রথম দু’টি খেলায় প্রথম একাদশে জায়গা পাননি। কিন্তু তৃতীয় ম্যাচে সুযোগ পেয়েই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন ভারতীয় ফুটবলে উদয় হয়েছে এক নতুন তারকার। ইস্টবেঙ্গলের বহু স্মরণীয় জয়ের অন্যতম কারিগর ছিলেন তিনি। চুয়াত্তরে মহামেডানের পাঁচবার লিগ জয়ের রেকর্ড ছোঁয়ার বছরে তিনিই ছিলেন দলের অধিনায়ক। গোটা দেশ তাঁকে চিনত একজন শিল্পী ফুটবলার হিসেবে। তাঁর পায়ের জাদুতে মুগ্ধ হননি— এমন ফুটবলপ্রেমী পাওয়া যাবে না। কলকাতার তিন প্রধানেই দাপটের সঙ্গে খেলেছেন পিন্টু। নিজেকে আদ্যন্ত ইস্টবেঙ্গল সমর্থক হিসেবে পরিচয় দিলেও, সবুজ-মেরুন বা সাদা-কালো জার্সি পরে লাল-হলুদকেও ছেড়ে কথা বলেননি। বড় ম্যাচে সকলেই যখন স্নায়ুর চাপে অল্পবিস্তর কাবু হয়ে পড়তেন, তখন তিনিই দলের সকলকে জাগিয়ে রাখতেন নানান হালকা কথাবার্তা বলে।
বড় অথবা ছোট, সব ম্যাচের দিনই সমরেশ চৌধুরীর রুটিন থাকত প্রায় এক। নুন শোতে সিনেমা দেখে, রেস্টুরেন্টে মাটন খেয়ে ময়দানমুখী জনতার ভিড়ের মধ্য দিয়ে পায়ে হেঁটে তাঁবুতে আসতেন তিনি। চারপাশের উত্তেজনা, আবেগ যেন তাঁকে স্পর্শ করতো না। যে কারণে বড় ম্যাচে তাঁর উপস্থিতি ছিল সবসময়েই উজ্জ্বল। ফুটবল মাঠে মনে রাখার মতো অসংখ্য মূহূর্ত উপহার দিয়েছেন সমরেশ। পঁচাত্তরে বড় ম্যাচে উলগানাথনের গোলার মতো শট গোলে প্রায় ঢুকেই গিয়েছিল। সকলে হাল ছেড়ে দিলেও, সমরেশ কিন্তু ভেবেছিলেন অন্যরকম। গোলমুখী বলে একেবারে শেষ মূহূর্তে মরিয়া চেষ্টায় পা ছোঁয়াতে পেরেছিলেন তিনি। আর তাতেই বদলে গিয়েছিল বলের গতিপথ। ক্রসবারে ধাক্কা খেয়ে বল চলে যায় মাঠের বাইরে। আর গোল বাঁচানোর সেই আপ্রাণ চেষ্টা দেখে পরের দিন মতি নন্দী লিখেছিলেন, ‘কখনো কখনো নিয়তি এমন ষড়যন্ত্র করে যে পোড়া শোল মাছও জ্যান্ত হয়ে ওঠে।’ এতটাই অবিশ্বাস্য ছিল সেই গোল বাঁচানো।
সাতাত্তরে লিগ হারিয়ে শিল্ড জিততে মরিয়া মোহনবাগানের কোচ প্রদীপ ব্যানার্জী হাবিবকে লাগিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর প্রিয় শিষ্য পিন্টুর পিছনে। যাতে সে খেলাটা তৈরি করতে না পারে। সেই প্রথমবার সমরেশ চৌধুরীকে দেখেছিলাম মাঠ থেকেই মোহনবাগান বেঞ্চের দিকে হাত-পা নেড়ে এই পুলিশম্যান ফুটবলের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করতে। তবে সমরেশ চৌধুরীর কথা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে উনআশিতে সাদা-কালো জার্সি গায়ে চোটে কাহিল অবস্থাতেও তাঁর অসমান্য লড়াইয়ের কথা না বললে। ছুটতে পারছেন না। সেই অবস্থাতেই গোললাইনে দাঁড়িয়ে ইষ্টবেঙ্গলের নিশ্চিত গোল আটকে দিয়েছিলেন তিনি। চুরমার করে দিয়েছিলেন ইস্টবেঙ্গলের লিগ জয়ের স্বপ্ন। এমন মধুর প্রতিশোধের কাহিনি ময়দান খুব বেশি দেখা যায় না। নিজের ইস্টবেঙ্গল প্রেম কখনও গোপন রাখেননি সমরেশ। তা সত্ত্বেও ফুটবল জীবনে দু’বার ক্লাব ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তাতেও তাঁর লাল-হলুদ প্রীতি এতটুকুও টোল খায়নি। ছিয়াত্তরে ছয় বছর পর মোহনবাগানের লিগ জয়ের বছরে তিনি মশাল ছেড়ে সওয়ার হয়েছিলেন পালতোলা নৌকায়। লিগ জেতায় ক্লাবের তরফ থেকে একটি বড় পার্টি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পিন্টু সেই পার্টিতে যাননি। বদলে ক্লাব কর্তাদের বলেছিলেন ‘আমাকে টাকা দিয়ে দিন। আমি নিজের মতো খেয়ে নেব।’’ তবে এটা ছিল নেহাৎই কথার কথা। আসলে রেকর্ড পরপর সাতবার লিগজয়ী দলের সদস্য হয়েও, সমরেশ খুশি হতে পারেননি। তিনি মুষড়ে পড়েছিলেন প্রিয় দলের ব্যর্থতায়। এমনই এক ব্যতিক্রমী মানুষ, ফুটবলার সমরেশ চৌধুরী। আর সুরজিৎ? তাঁর কথা পরের পর্বে।
(ক্রমশ)

অলংকরণ- রাতুল চন্দরায়