সুখেন্দু হীরা

(আইপিএস সুখেন্দু হীরা বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল (নিরাপত্তা)। প্রতারণার নানা কাহিনি ধারাবাহিক ভাবে তিনি তুলে ধরছেন বালিহাঁস-এর পাতায়।)

আমার বাবার মামার বাড়ি ঠাকুরনগরে। সেখানে বাবা একখণ্ড জমি কিনেছিলেন। বাবা ভেবেছিলেন অবসর জীবন মামাতো ভাই-বোনদের কাছে কাটাবেন। সেটা অবশ্য সম্ভব হয়নি। একদিন আমার পিসতুতো ভাই বলল, মামার ঠাকুরনগরের জায়গায় লম্বু গাছ লাগিয়ে দে। গাছ বড় হলে বিক্রি করলে প্রচুর লাভ। লম্বু গাছের নাম আমি প্রথম শুনলাম। লম্বু গাছ হল আফ্রিকান মেহেগনি। মেহেগনি কাঠের দাম আমরা জানি। দামী হিসেবে মেহগনি কাঠের পর নাম আসে সেগুনের। অনেকে নিজের জমিতে মেহেগনি, সেগুন, লম্বু লাগিয়ে বিনিয়োগ করে। লম্বু গাছের সুবিধা হল পরিচর্যা কম করতে হয়। তুলনামূলক দাম কম হওয়ায় চুরি যায় কম।
আমি বললাম, গাছ কাটতে গেলে তো আবার বন দফতরের অনুমতি নিতে হবে। ভাই বলল, সে পাওয়া যাবে। তা ছাড়া আমরা চাষ করছি বলে উল্লেখ করব। চাষের ফসল কাটাই যায়। আমার অবশ্য পিসতুতো ভাইয়ের ব্যবসায়িক বুদ্ধি নেওয়া হয়নি। কিন্তু এই ব্যবসায়িক বুদ্ধি বিভিন্ন ক্ষুদ্রসঞ্চয় সংগ্রহকারী সংস্থা, এমনকি বড় বড় কোম্পানি প্রয়োগ করেছিল। তারা সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিতেন উত্তর ভারত বা দক্ষিণ ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে তারা সেগুন গাছ লাগাবেন। তার মধ্যে এত শতাংশ বাঁচবে। বেঁচে থাকা গাছ বেচে এত টাকা আয় হবে। আপনার বিনিয়োগ এত, আর লাভ এত!
একবিংশ শতাব্দী মানুষের মধ্যে অ্যাগ্ৰো, অর্গানিক এসব নিয়ে বিশেষ আগ্রহ দেখা দিল। সেই সঙ্গে চিটফান্ড কোম্পানি গুলিকেও দেখলাম তাদের নামের সঙ্গে অ্যাগ্ৰো নামটা লাগিয়ে দিল। আগে অর্থাৎ বিংশ শতাব্দীতে এদের কখনও চিটফান্ড বলা হত না। শুধু কোম্পানি বা অনেকে ব্যাঙ্ক বলত। চিটফান্ড নামটা শুনলাম এদের প্রতারণা বা জালিয়াতি সামনে আসার পর।
আমি তো প্রথমে ভাবতাম এরা মানুষের টাকা ‘চিট’ অর্থাৎ প্রতারণা করেছে বলে এই কোম্পানিগুলিকে চিটফান্ড কোম্পানি বলে। পরে শুনলাম এই ‘Chit’ সেই ‘Cheat’ নয়। এই Chit -এর অর্থ ক্ষুদ্রপত্র বা চিরকুট। স্বল্প সঞ্চয় বা ক্ষুদ্র সঞ্চয় থেকেই ‘চিটফান্ড’।
নতুন শতকে পদার্পণ করে ক্ষুদ্রসঞ্চয় প্রকল্পগুলো নব কলেবরে, নতুন রূপে, রক্তবীজের ঝাড়ের মতো ছড়িয়ে পড়ল। গত শতাব্দীতে আটের, নয়ের দশকে যা প্রধানত ব্যাঙ্কিং পরিষেবার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, একবিংশ শতাব্দীর প্রথম ও দ্বিতীয় দশকে শুধু ব্যাঙ্কিং নয় প্লাটেশন, এগ্রিকালচার, রিয়েল স্টেট, হোটেল, ট্যুরিজম, এন্টারটেনমেন্ট ইত্যাদি নানা ‘ফিল্ড’-এ তাদের ব্যবসা ছড়িয়ে পড়ল। বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের বিনিয়োগ দেখে সাধারণ মানুষ প্রলুব্ধ হল।
হবে নাই বা কেন! তাদের ঝা চকচকে অফিস, বিভিন্ন জায়গায় রিসর্ট, বিঘার পর বিঘা জমিতে ফলের বাগান, বিভিন্ন অ্যাগ্ৰো প্রোডাক্ট উৎপাদন, হোটেল, ব্লকবাস্টার ছবি প্রযোজনা, বিভিন্ন প্রভাবশালী নেতাদের নিজেদের অনুষ্ঠানে নিয়ে আসা, বিভিন্ন অনুষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতা করা। সাধারণ মানুষ তাদের স্থায়িত্ব ও আশ্বাস নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ প্রকাশ করল না।
যেখানেই বিনিয়োগ করা হোক না কেন, তা তো একটা ব্যবসা। সেখানে লাভ-ক্ষতি আছে। সব সময় মুনাফা ঘরে আসে না। তা ছাড়া সহজে কাঁচা পয়সা হস্তগত হওয়ার দরুন এইসব কোম্পানির অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ও মেনটেন্যান্স খরচ অনেক বেশি ছিল। নানা জায়গায় ডোনেশন, বিভিন্ন স্বনামধন্য ব্যাক্তিদের কোম্পানিতে পদ দিয়ে রাখা; এই সব ক্ষেত্রে কত পয়সা খরচ হতো তার কোনও হিসাব ছিল না।
ফল যা হবার তাই হল। দু’হাতে টাকা তুলেছিল। যখন টাকা ফেরত দেওয়ার সময় এল তখন তাদের গা ঢাকা দিতে হল। অবশেষে প্রশাসনকে হস্তক্ষেপ করতে হ’ল। রাজ্য ও রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ তদন্তকারী সংস্থাকেও নিয়োগ করতে হল; সিআইডি, ইডি, সিবিআই, ইত্যাদি। সেবি (SEBI) অর্থাৎ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্চ বোর্ড অব ইন্ডিয়া বিভিন্ন সময় নিয়ম ভঙ্গকারী চিটফান্ডগুলোর তালিকা বার করল। তার মধ্যে পরিচিত কোম্পানিগুলো হল – সাহারা, বেসিল, অ্যালকেমিস্ট, ভিবজিত্তর, রামেল, আইকোর, ফ্যালকন ইত্যাদি।
পশ্চিমবঙ্গে যে তিনটি কোম্পানি গোটা রাজ্যকে আলোড়িত করেছিল সেগুলি হল— সারদা, রোজভ্যালি, এমপিএস। রোজভ্যালি হোটেল শিল্প ও চলচ্চিত্র শিল্পে সাফল্য দেখলেও শেষ পর্যন্ত প্রতারণার দায়ে পড়তে হয়তাদের । এমপিএস অ্যাগ্ৰো প্রোডাক্ট বাজারে বিশেষ নাম করেছিল। তবুও শেষ রক্ষা হয়নি। এর মধ্যে সবচেয়ে চর্চিত সারদা। বিভিন্ন প্রজেক্টে দৃষ্টান্ত মূলক বিনিয়োগ করেছিল সারদা। তবুও কোম্পানির কর্ণধারদের কাশ্মীর পালিয়ে যেতে হয়। তাদের ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের নামে টাকা তোলার ফলে এত বেশি প্রান্তিক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল যে রাজ্য সরকার সেই সব ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে ক্ষতিপূরণ দিয়েছিল।
মানুষের ক্ষুদ্র আমানত সংগ্রহকারী সংস্থাগুলি বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রচুর এজেন্ট বেকার হল। অনেকে লজ্জায়, অপমানে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়। অনেক সংবাদপত্র বন্ধ হয়ে যায় বা আর্থিক সংকটে পড়ে। আমানতকারীদের অনেকে অবসরের পর তাঁদের পাওনাগণ্ডা পুরোটা অধিক সুদের লোভে এইসব সংস্থায় রেখেছিলেন। ডামাডলের সময় অনেকে টাকা তুলতে গেলে তাঁরা শুধু মূলধন টাই ফেরত পেয়েছিলেন। কোনও সুদ দেওয়া হয়নি। অনেকের আসল তোলার সুযোগ হয়নি।
প্রশাসন সব ক্ষেত্রেই কড়া ব্যবস্থা নিয়েছিল। এই কোম্পানির কর্তব্যত্তিরা প্রায় সকলেই গ্রেফতার হয়েছিল, সুবিধাভোগীরা অনেকেই অ্যারেস্ট হয়েছিল। প্রতারিত মানুষরা সকলে সুবিচার পাননি। অধিকাংশ কেস অবশ্য এখনও বিচারাধীন। মানুষ যখন প্রতারিত হয়েছে, তখন প্রতারক তো ছিলই।

অলংকরণ-রাতুল চন্দরায়