বিদ্যুৎ চক্রবর্তী

গুয়াহাটিতে অসম গ্রন্থমেলার ভিড়ে কমলা রঙের রোদ গায়ে মেখে সদ্য যৌবনে পা রাখা হাফলঙের তন্বী শ্রাবন্তী বয়ফ্রেন্ডদের সঙ্গে হইহই করতে করতে সোশ্যাল মিডিয়ায় স্টেটাস আপডেট দিচ্ছিল। তার চোখে তখন স্বপ্ন খেলা করছিল তিন সপ্তাহ পরে আসন্ন কলকাতা বইমেলাকে ঘিরে। গতবার সম্ভব হয়নি। তবে এবার তার সুযোগ এসেছে কলকাতায় বইমেলা দেখার।

কলকাতা বইমেলাকে (Kolkata book fair) ঘিরে শ্রাবন্তীর মতো যুবতীর এমন আবেগ বিচ্ছিন্ন কোনও ঘটনা নয়। বস্তুত, ব্রহ্মপুত্রের ঢেউ ছাপিয়ে ধনশিরি-দেওপানি-আমরেং পেরিয়ে বরাক-কুশিয়ারা হয়ে মনু-গোমতী নদীপারের শতসহস্র বাংলা সাহিত্যপ্রেমীর ভালোবাসা, আশা আর স্বপ্নের কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠেছে কলকাতা বইমেলা। আর সে কারণেই উত্তর-পূর্বাঞ্চলের গেটওয়ে গুয়াহাটি-সহ অসমের বিভিন্ন প্রান্তে আয়োজিত গ্রন্থমেলা ও প্রতিবেশী রাজ্য ত্রিপুরা, মেঘালয়ের একাধিক নিয়মিত বইমেলার শীতের দুপুর-বিকেলগুলো মুখিয়ে থাকে কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলার দিকে।

কলকাতা বইমেলাকে (Kolkata book fair) ঘিরে উত্তর-পূর্ব ভারতের লেখক-পাঠকদের আবেগ এবছরও চোখে পড়েছে। বইমেলার মাঠে হাজির হয়েছেন উত্তর-পূর্বের বহু লেখক, সাহিত্যপ্রেমী মানুষ। আর কলকাতা পৌঁছনোর অনেক আগে থেকেই সমাজমাধ্যমে অসম-ত্রিপুরা-মেঘালয়ের বাংলা ভাষার লেখকদের অনেকেই জানিয়ে এসেছেন এ বছর তাঁদের নতুন বই প্রকাশের খবর। কেউ আবার মেলার মাঠের পৌঁছে বন্ধুদের জানিয়েছেন নতুন সৃষ্টির কথা।

বইমেলায় উত্তরপূর্ব

২০২৪ -এর কলকাতা বইমেলা (Kolkata book fair) শেষ হয়ে গেল। এখন থেকেই ‘আসছে বছর আবার… ‘ -এর প্রতীক্ষা। এবারের মেলা-ময়দানে বরাবরের মতো প্রায় প্রতিদিন লিটল ম্যাগাজিনের প্যাভিলিয়নের বিভিন্ন টেবিলে একদিকে যেমন উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কাগজ ও পত্র পত্রিকার সমাহার অতিরিক্ত শোভা বাড়িয়েছে তেমনি অগুনতি লেখক-কবি-শিল্পীর আড্ডা, হইচই মেলাপ্রাঙ্গণকে প্রাণোচ্ছল ও উজ্জ্বল করে তুলেছিল। পূর্ব পরিকল্পনা মতো গত কয়েকদিনে কলকাতার বিভিন্ন প্রকাশনার উদ্যোগে উত্তর-পূর্বের লেখকদের বেশ কিছু বইয়ের আনুষ্ঠানিক প্রকাশ হয়েছে। যেমন, গুয়াহাটির রুমী লস্কর বরার অসমিয়া উপন্যাসের এই প্রতিবেদক কৃত বাংলা অনুবাদ ‘আগুন’ (ভাষা সংসদ), গুয়াহাটির মধুমিতা দত্তের প্রবন্ধ সংকলন ‘লেগুন'(নীরব আলো), অমল গুপ্তের ‘সাংবাদিক জীবন’ (দেশভাবনা) ইত্যাদি বইগুলি পাঠকের সামনে তুলে ধরা সম্ভব হয়েছে। এছাড়াও প্রকাশিত হয়েছে শতদল আচার্যের কাব্যগ্রন্থ ‘মায়াময় সময়’, বিপ্লব গোস্বামীর কবিতার বই ‘তোমাকেই চাই’, রত্নদীপ দেবের কাব্যগ্রন্থ ‘অনর্থক কাটাকুটি’, কল্লোল চৌধুরীর ইংরিজি কাব্যগ্রন্থ ‘Buddha On Planchette’। সুজাতা চৌধুরী ও নীলাক্ষ চৌধুরী সম্পাদিত ‘অনিবার্য’ পত্রিকার ২০২৪ বইমেলা সংখ্যাটিও পাঠকের সামনে নিয়ে আসা হয়েছে।

অসমের ব্রহ্মপুত্র, বরাক উপত্যকা ছাড়াও মেঘালয়, ত্রিপুরার কবি-সাহিত্যিকদের একাংশ যাঁরা কলকাতা বইমেলাকে প্রাণবন্ত করে তুলেছিলেন, তাঁদের অন্যতম হলেন— বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক ও চিন্তাবিদ, আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য তপোধীর ভট্টাচার্য, লেখক রুমী লস্কর বরা, সাংবাদিক অমল গুপ্ত, কবি তাপস পাল, বাচিক শিল্পী রাজশ্রী দাস, কবি ও অনুবাদক সত্যজিৎ চৌধুরী, কবি বিশ্বজিৎ নাগ ,দেবব্রত দেব, অভীককুমার দে, জহর দেবনাথ, অমিতাভ সেনগুপ্ত। পাশাপাশি মেলায় পৌঁছে গিয়েছেন রণবীর পুরকায়স্থ, নন্দিতা ভট্টাচার্য, শান্তনু গঙ্গারিডি, শ্যামল ভট্টাচার্যের মতো পশ্চিমবঙ্গে পাকাপাকি ভাবে থিতু হওয়া বুদ্ধিজীবী লেখক-সম্পাদকেরাও। উত্তর-পূর্ব ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসেছেন আরও অনেকে। বইমেলার স্টলে ময়দানে আড্ডা দিয়েছেন দিনভর। নির্ভেজাল আড্ডা ও আলোচনায় উত্তর-পূর্বের অনেককেই দেখা গিয়েছে বিহার বাঙালি সমিতির স্টলে।

উত্তর-পূর্বের মানুষ ও প্রকৃতির মতোই সাহিত্য জগৎ বৈচিত্র্যে ভরপুর। এ প্রসঙ্গে সাহিত্যমানের কথাও উঠে আসে আলোচনায়। কেউ কেউ বলেন, যে সব বই প্রকাশিত হচ্ছে, তার শতকরা তিরিশ ভাগ উৎকৃষ্ট, তিরিশ ভাগ মাঝারি মানের আর চল্লিশ ভাগ নিম্নমানের। তবে যোগাযোগ ও পঠনের অভাবজনিত সমস্যায় উত্তর-পূর্বের সাহিত্যিক এবং সাহিত্যের পরিচিতি পশ্চিমবঙ্গে অনেক কম। একটা সময় ছিল যখন এরকম একটা ভ্রুকুঞ্চিত প্রশ্ন উঠে আসতো— ওখানেও বাঙালিরা লেখালেখি করেন? আজ পরিস্থিতি অনেকটাই পাল্টেছে। ডিজিটাল দুনিয়ায় অনেকটাই কাছে এসেছেন উভয় অঞ্চলের পাঠকেরা। উত্তর-পূর্বের বহু বই ছাপাও হচ্ছে কলকাতায়। প্রদর্শিত হচ্ছে কলকাতা বইমেলায় যদিও বিক্রির ক্ষেত্রটি গড়ে উঠতে আরও সময় লাগবে।

এবারের কলকাতা বইমেলায় (Kolkata book fair) উত্তর-পূর্ব ভারতের লেখকদের বই প্রকাশিত, উন্মোচিত ও প্রদর্শিত হয়েছে। এটা আশার কথা নিঃসন্দেহে। তবে গুয়াহাটি বইমেলায় হাতে গোনা বাংলা বইয়ের প্রকাশকদের উপস্থিতি বাঙালি পাঠক মনে তেমন উৎসাহের সঞ্চার করতে পারেনি। যদিও ওই বইমেলায় বরাবরের মতো কলকাতার চক্রবর্তী ও চ্যাটার্জী-র স্টলে বাংলা বই কিনতে ভিড় করেছেন বাঙালিদের পাশাপাশি অসমিয়ারাও। গুয়াহাটির বাইরে বরাক উপত্যকায় অনুষ্ঠিত বইমেলাতে বাংলা বইয়ের বিক্রি হয়েছে ঠিকই। তবে আশাব্যঞ্জক নয় সেই চিত্র। আর কলকাতা বইমেলায় দিন দিন বেড়ে চলেছে ভিড়। তবুও এই বই উৎসবের আড়ালে স্তূপীকৃত হয়ে আছে বহু কথা। বইমেলা উৎসব শেষ হয়ে গেলে সারা বছর সেই চিন্তাগুলিই ভাবাবে লেখক-কবিদের।

পাঠককে কথা বাদ দিলে বই জগতে যুযুধান যে দু’টি পক্ষ— তার একদিকে রয়েছে প্রকাশক, অন্যদিকে লেখক, কবিরা। কেমন খেলা চলে এই বাজারে? সারা বছর জুড়ে এবং বিশেষ করে বইমেলার আগে সবাই যেন কোমর কষে নেমে পড়েন বইবাজারে। প্রথমে আসা যাক কবি লেখকদের কথায়। হাতে গোনা কিছু সফল কবি সাহিত্যিকের বাইরে গ্যাঁটের কড়ি খরচ করে বই ছাপিয়ে বিনামূল্যে বিতরণের বাইরে গত্যন্তর নেই। উত্তরণের মরিয়া প্রচেষ্টা। আর এই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়েই প্রকাশক আর ছাপাখানার রমরমা। এ-ও তাঁদের ব্যবসা। ব্যবসায় সততা থাকলে কিছু বলার নেই। কিন্তু বহু ক্ষেত্রে এখানেই সমস্যা।

কলকাতা বইমেলা শেষ। অপেক্ষা আরও একটি বছরের। এই সময়ের মধ্যে নামী লেখকের লেখা ছেপে ব্যবসা বাড়াতে চাইবেন প্রকাশক। আর কবি সাহিত্যিকেরা নিজের বই প্রকাশ করতে ছুটবেন প্রকাশকদের দরজায়। আর বইবাজারের সাদা-কালোর সেই খেলা চলতে চলতে কেটে যাবে একটা বছর। চলে আসবে আরেকটা বইমেলা।

অলংকরণ-রাতুল চন্দরায়