নির্মল হালদার
————————

সেই ছিল এক মেলা। বইমেলা।
বইকে ঘিরে উন্মাদনা ছিল দেখার মতো। আজও হয়তো আছে। কিন্তু কতটুকু?
আমাদের বইমেলা ছিল ময়দানে।
আমাদের যৌবনে।
নিজেদের ছিল লিটল ম্যাগাজিনের স্টল। বাগর্থ। তার আগে ছাতিমতলা থেকেও আমরা স্টল করেছি ।
পত্রপত্রিকা ও বই বিক্রি করেছি অনেক। শুধু বিক্রি-বাটা নয়, দূরের মানুষ কাছে এসেছে। কাছের মানুষ আমাদের জন্য নিয়ে এসেছে টিফিন।
বেলা বারোটা থেকে সামলাচ্ছি স্টল, মেলাতে খাবারের যা দাম, টাকা পয়সার অভাবে, খাবারের স্টলে যেতেও ভয়।
শুভাকাঙ্ক্ষীদের কেউ কেউ খাবার নিয়ে এসে আমাদের পেট ভরিয়ে দেয় মন ভরিয়ে দেয়। কেউ কেউ লম্বা সিগারেট নিয়ে আসে।
আমি তো একটা স্টল থেকে আরেকটা স্টলের দিকে যাই, বোতল ভর্তি রঙিন পানীয় আমাকে জোগায় উদ্দীপনা।
বন্ধুতা আসে।
হঠাৎ দেখতে পাই, আমাদের স্টলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন শঙ্খবাবু। একদিন এলেন, গীতা চট্টোপাধ্যায়।
প্রতুল মুখোপাধ্যায় এসে গান করলেন। কোনও যন্ত্র ছাড়াই। বইমেলা যে নিজেই একটি বাজনা। একটি তরঙ্গ।
কোনও বন্ধুর কাছে আব্দার করি, অমুক বই তমুক বই কিনে দে। অমুক বই তমুক বই আমার পড়া হয়নি।
বইমেলাতে এসে ” মানুষ ” পড়েও থাকে কেউ কেউ।
“মহীনের ঘোড়াগুলি” এসে মাঠ জুড়ে গান করে। আমরা শুনতে শুনতে আকাশের দিকে তাকাই।
দেখি, নক্ষত্র স্থির। অস্থির হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে হাওয়া। চঞ্চল হয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে শিশুরা।
ঘরে তো আর মাঠ নেই।
পিছনে পিছনে ছুটছে মা— শিশুকে ধরতে হবে। তার হাতেও ধরাতে হবে একটি বই।
সেই তো আমাদের ভবিষ্যৎ।
বইমেলাতে আগুন লাগলো একবার। আমার নতুন বই “তমোঘ্ন” ছাই হয়ে গেল। গান বাধলেন প্রতুল দা।
সেই মন খারাপের সেই আনন্দের সেই বইয়ের এবং বন্ধুত্বের দিনগুলির কথা কত আর
লিখবো!
ভালোবাসাও ছিল নিঃশব্দ।
অনির্বাণ দাস থেকে দীপেন্দু ঘোষ, গায়ত্রী থেকে উন্মনা— সবাই তো ছিল। ছিল সৈকত থেকে কল্লোল। শুকতারা ঠুমরী।
ঝুপ্পি। প্রসূণ-নন্দিনী। গৌ চৌ।
অনির্বাণ থেকে অমিতাভ মন্ডল।
হেমন্তের নীরব হাসি।
উত্তর থেকে দক্ষিণ।
অদ্রীশ -মৌ।
বজবজ থেকে অশোকনগর। বনগাঁ। অপূর্ব সাহা থেকে কৌশিক চক্রবর্তী। অহর্নিশ থেকে থিরবিজুরি।
চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।
বারো মাসের তেরো পার্বণ থেকে
আরেক পার্বণ বইমেলা চলছে তো চলছেই। আজও।
আমি না থেকেও প্রতিদিন মেলাতে হেঁটে বেড়াই। একা একা।
নিঃশব্দ।

অলংকরণ-রাতুল চন্দরায়