ঝড়েশ্বর চট্টোপাধ্যায়

তখন উনিশশো আশির দশক। বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনে বেশ কিছু গল্প লেখালেখির সূত্রে আলাপ গল্পকার রাধানাথ মণ্ডলের সঙ্গে। সাহিত্য কর্মকাণ্ডে উদ্যোগী তরুণ। গড়ে তুললেন ‘সংবাদ’প্রকাশন। ৫৭/২ডি,কলেজ স্ট্রীট , কলকাতা-৭৩। সে বছর বইমেলা ১৯৮২ তে ‘সংবাদ’থেকে প্রথম প্রকাশ পেল শ্রদ্ধেয় রমাপদ চৌধুরী সম্পাদিত চমৎকার গল্প সংকলন ‘প্রেম’। সৈয়দ মুজতবা আলী থেকে শুরু করে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়— প্রায় বত্রিশজনের মুল্যবান লেখায় সমৃদ্ধ। ভূমিকায় সম্পাদক লিখেছিলেন ‘দীর্ঘকাল আগে বিশিষ্ট লেখক লেখিকাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম, প্রেমকে তাঁরা কী দৃষ্টিতে দেখেন, তা জানতে।এগুলি তখন প্রকাশিত হয়েছিল রবিবাসরীয় আনন্দবাজারে। এতদিনে এক প্রকাশক সেগুলি গ্রন্থবদ্ধ করার উৎসাহ দেখালেন। প্রকাশিত রচনাগুলির সঙ্গে কিছু অপ্রকাশিত এলো। আশা করি, সেদিনের পাঠকদের মতো এদিনের পাঠকেরও ভালো লাগবে। কারণ,প্রেম কখনো পুরনো হয় না।’

সংকলনটি প্রকাশিত হয়েছিল যখন, সেই সময় বইমেলা হ’ত ভিক্টোরিয়ার মাঠের দিকটায়। জেলাগুলি থেকে সকাল সকাল উদ্যোগী লিটল ম্যাগাজিনপ্রেমী তরুণ তরুণীরা জড়ো হয়। প্রকাশকদের স্টলে স্টলে পছন্দের বই সংগ্রহে মফস্বলের অনুরাগী পাঠকপাঠিকার পাশাপাশি হাজার হাজার পুস্তক প্রিয় শহরবাসীর আবেগময় ভিড়ে বইমেলা জমজমাট। আলাদা এক পার্বণ এ বঙ্গ ছাড়িয়ে পড়শি রাষ্ট্রের প্রকাশকদের অংশগ্রহণে। এই ভিড়ে আমি ও দু-একজন সদ্যলেখক ওই বন্ধুর স্টলে পাঠক-ক্রেতাদের হাতে বই তুলে দিচ্ছিলাম। অতি উৎসাহী তরুণ বন্ধু চলমান পাঠক-ক্রেতার মনোযোগ আকর্ষণ করতে উচ্চকন্ঠে চিৎকার করতো— ‘প্রেম’ ‘প্রেম’… অসাধারণ প্রেমের গল্প… প্রেম পুরনো হয় না… মাত্র চোদ্দ টাকা…।’

কী ভিড়… হু-হু করে বই বিক্রি হয়ে যেত। পরদিন বাঁধাই প্যাকেট ফুরিয়ে খালি। নিজের চোখে দেখছি— কত তরুণ-তরুণীর হাতে হাতে সে বই…! তখন লিটল ম্যাগাজিন ছাড়াও বহুল প্রচারিত দৈনিকে রবিবারের পাতায় দু-চারখানা গল্প প্রকাশিত হচ্ছে আমার ও সহলেখকদের। মনে জাগে, ‘আমার যদি একটা দুটো বই থাকতো এই স্টলে…! কেউ কেউ নেড়ে চেড়ে দেখতো তো…।’

বছরের পর বছর যায়। বইমেলাও পার হয়। পত্রপত্রিকায় লেখালিখি এগোয়। অনেক বন্ধু লেখকদের দু-এক খানা করে গল্প সংকলন বেরুচ্ছে। কিন্তু আমার তো নেই…! সে সময় নতুন সরকার গ্রামবাংলার লেখকদের কাছে পাণ্ডুলিপি আহ্বান করলো। মনোনীত হলে সরকার আংশিক খরচ দিয়েছে কিছু বছর। আমিও এগারোখানা ছোটগল্পের পাণ্ডুলিপি পাঠাই। একদিন মনোনয়নের সরকারি চিঠি পেলাম। সেই চিঠি দেখাই উদ্যমী লেখক বন্ধু প্রকাশক রাধানাথ মণ্ডলকে। তাঁর আন্তরিক ব্যবস্থাপনায় কোজাগরী পূর্ণিমা ১৩৯৪, ইং ৭ই অক্টোবর ১৯৮৭ আমার স্বরচিত গল্প সংকলন প্রকাশিত হল। জীবনের প্রথম বই তা কলেজ স্ট্রীট, কলকাতা থেকে।

আবার তো বইমেলা আসে। সে বছর সম্ভবত জনপ্রিয় লেখক শ্রদ্ধেয় সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের ‘জনার্দনের জর্দার কৌটো’ সংবাদ থেকে প্রকাশিত হয়। সংবাদ প্রকাশন বহুল প্রচারিত দৈনিকে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল— এই স্টলে বিকেলে উপস্থিত থাকবেন লেখক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, সঙ্গে কী কী বই প্রকাশি্ত হয়েছে— তার তালিকা। এসেছিলেন সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়। রাধানাথের যুবক কন্ঠে চিৎকার ‘আমাদের স্টলে সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় আছেন। অনুরাগী পাঠক তাঁর স্বাক্ষরিত বই… হাত থেকে নিয়ে… নিজ সংগ্রহে রাখুন। দুর্লভ সুযোগ… বিরল মুহূর্ত…।’
এক বৃদ্ধা সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের কাছে এসে বলেন , ‘আমি আপনার লেখা পেলেই পড়ি…’ কথায় যে কী আবেগ ঝরে পড়ছিল তাঁর গলা থেকে। বিহ্বল লেখক প্রার্থনা করলেন , ‘আশীর্বাদ করুন…।’

বৃদ্ধা মায়াময় উচ্চারণে লেখকের মাথায় হাত ছুঁইয়ে যে কী বলেছিলেন তিনি ও মহাব্রহ্ম জানেন…!
সংবাদ স্টলে ভিড়ে ভিড়। আমি ও আমার দু-একজন বন্ধু আর সংবাদের কর্মী সত্যবান কাউন্টারের এপারে দাঁড়িয়ে ক্রেতাদের হাতে বই দিচ্ছি। ওই ভিড় কাটিয়ে এক সদ্য তরুণ এসে বলে, ‘যাত্রীনিবাস’ আছে?
আমি ভীষণ আগ্রহে বইটি এগিয়ে দিই । সামান্য পৃষ্ঠা উলটে পালটে তরুণ বলে, ‘দিন বইটা ‘।
তখন প্রকাশনের কর্মী সত্যবান কার্বন লাগিয়ে স্লিপ কেটে বইটা এগিয়ে দেয়। আমাকে দেখিয়ে ক্রেতাকে বলে, ‘যাত্রীনিবাস’-এর লেখক ইনি…।’
‘ও… ‘ হাত জোড় করে নমস্কার জানায়। পরক্ষণে কন্ঠে অনুরোধ , ‘একটু সই করে দেবেন স্যার ?’
‘স্যার কেন ভাই…? সে তো স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটিতে…আর…’ ততক্ষণে নাম লিখে ফেলি। বইটি নিয়ে তরুণ পাঠক চলে যায়। কলেজ স্ট্রীটে প্রকাশনের কাউন্টারে মাঝে মাঝে ‘যাত্রীনিবাস’ দু-এক কপি বিক্রি হছে সত্যবানের মুখে শুনছি। কিন্তু এই তরুণ যে আমার ‘যাত্রীনিবাস’-এর গল্পের পাঠক— সেটা চাক্ষুষ করলাম। নিজের উপর বিশ্বাস মজবুত হ’তে সাহায্য করল আরও একবার। পাঠকের প্রতি ভালোবাসাও জন্ম নেয়। সেটা তো পুরনো হয় না ।

সেই ‘সংবাদ’ প্রকাশন আজ আর নেই। বন্ধু-লেখক রাধানাথ মণ্ডলও নেই…! বড্ড আশা জাগে সেই অজ্ঞাত ‘তরুণ পাঠক’ এ মাতৃভাষায় কোথাও না কোথাও সশরীরে আছো বা আছেন। যদি চোখে এই লেখাটি পড়ে— একবার যোগাযোগ করবেন ভাই। কারণ ‘তুমি যে আমার প্রথম পাঠক-প্রেম…।
ভালো থেকো…।

অলংকরণ- রাতুল চন্দরায়