সৈয়দ রেজাউল করিম

সামনে বসে থাকা মহিলাটির গলার হারটা দেখে আমার মনে হল— এমনই একটা মনিহার আমি আমার বন্ধুর বিয়ে উপলক্ষে তার ভাবী স্ত্রীকে উপহার হিসেবে দিয়ে এসেছিলাম।

সুচরিতাদিকে বললাম, একই দোকান থেকে তোমার হারটাও এবার কিনে নিয়ে এসেছি। তোমার হারটাতে তোমার নামের প্রথম অক্ষর ‘এস’ লিখে এনেছি, তেমনি বন্ধুর স্ত্রীর হারেও খোদাই করে দিয়েছিলাম ‘এম’ শব্দটা। কিন্তু হারটা একটু দেখি, বলে মৌয়ের কাছে চাইতে লজ্জা বোধ হল আমার। কি মনে করবে মেয়েটা? তাকে মৌমিতা বলে ডাকতে গিয়েও থমকে গেলাম আমি। অবরুদ্ধ হয়ে গেল আমার গলা। সেইসময় একটা অন্য ভাবনা হঠাৎ আমার মাথার মধ্যে ঢুকে সবকিছু তালগোল পাকিয়ে দিল। মনে হল, আমার বন্ধুর স্ত্রী মৌমিতা এখানে কী করতে আসবে? কোথায় কলকাতা আর কতদূরে জলপাইগুড়ি! প্রায় সাতশ’ কিলোমিটারের পথ। সেই পথ ভেঙে কোন প্রয়োজনে সে আসবে? তাছাড়া যদিও হারের গায়ে ‘এম’ লেখা থাকে, সেরকম হার তো বাজারে হাজারটা কিনতে পাওয়া যায়। এই হারটা যে সেই হার, একথা ভাবছি কোন প্রমাণের উপর নির্ভর করে? ব্যাপারটা আর একটু ভালো করে তলিয়ে বোঝার জন্য মহিলাকে বললাম— আপনার নাম, পরিচয় বলুন। কোথা থেকে আপনি আসছেন?
মহিলা বললেন— আমার নাম মৌ রায়। বাবা সুশান্ত রায়। বাড়ি বেহালার পর্ণশ্রীতে। স্বামীর সাথে বেড়াতে যাচ্ছিলাম ভুটানে। কলকাতা ভুটান বাসে করে। পথে বাসটা অ্যাক্সিডেন্ট করল। আমাকে তো বাস থেকে বার করে হাসপাতালে নিয়ে গেল। কিন্তু আমার স্বামীকে কোথাও খুঁজে পেলাম না। সে কি থানায় এসেছিল? তার খোঁজ নিতে এখানে এসেছি।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম— আপনার স্বামীর নাম কি?
মহিলা বললেন— অনুপ কার্জী।
সে কথা শুনে কিছুটা নিশ্চিন্ত হলাম আমি। এ মৌ তাহলে আমার বন্ধুর স্ত্রী মৌমিতা নয়। কারণ, আমার বন্ধুর নাম শ্যামল বসু। কিন্তু মৌ রায় ও অনুপ কার্জী নাম দু’টো আবার ভাবিয়ে তুলল আমাকে। আমি থানার ডিউটি অফিসারের কাছে খোঁজখবর নিয়ে মৌকে বললাম— না, অনুপ কার্জী বলে কেউ থানায় আসেনি। তার কোন খবর আমাদের কাছে নেই।
আর ঠিক তখনই আমার ঘোর কাটল। হঠাৎ মনে পড়ে গেল কথাটা। আমি মৌকে তখনই বললাম, গতকাল ভুটান বাস অ্যাক্সিডেন্টে দু’জন মারা গেছে। একজন মহিলা ও একজন পুরুষ। সেই লাশ দু’টো রাখা আছে থানার বাইরে। এখনও আইডেন্টিফাই হয়নি তাদের দেহ। আপনি লাশ দুটো দেখতে পারেন।
সেকথা শুনে অজানা আশঙ্কায় মৌয়ের বুকটা যেন কেঁপে উঠল। চোখ মুখ হয়ে উঠল বিবর্ণ। তবুও চোয়াল শক্ত করে অস্ফুট স্বরে বলল— চলুন স্যার! দেখে নেওয়া যাক।
সম্মতি পেয়ে মৌকে নিয়ে চেম্বার ছেড়ে থানার মাঠে গেলাম। মাঠে একটা ঠেলাগাড়ির উপর লাশ দু’টো শুইয়ে রাখা ছিল। ঢাকা দেওয়া ছিল দু’টো সাদা কাপড়ে। লাশের কাছে আমাদের দেখে সুইপার সেখানে চলে এলো। ইশারা করে তাকে বললাম লাশের মুখে ঢাকা কাপড়টা একটু সরাতে। সে বিন্দুমাত্র বিলম্ব না করে কাপড়টা সরিয়ে দিল। আর সাথে সাথে লাশ দু’টোর মুখ পরিস্ফুট হল সবার চোখের সামনে। তা দেখে মৌ চিৎকার করে কান্না জুড়ে দিলেন।
—আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে গো। আমি এখন কি নিয়ে বাঁচব?
তার সেই উথালপাথাল ক্রন্দনরোল আমার বুকে গভীর ভাবে বেজে উঠল। অল্প বয়সে স্বামীহারা হলে একটা মেয়েকে যে কতটা দুর্বিষহ যন্ত্রনার মধ্যে পড়তে হয়, সেই অভিজ্ঞতার ঝুলি আমার পূর্ণ হয়েছে দিনের পর দিন। আমি বুঝতে পারলাম মৌয়ের স্বামী অনুপ কার্জী গত হয়েছে গতকাল বাস অ্যাক্সিডেন্টে। এখন সুরতহাল রিপোর্ট, ডেডবডি চালান এসব কাজ শেষ করে লাশ পাঠাতে হবে জলপাইগুড়ি সদর হাসপাতালে। পোস্টমর্টেমের জন্য। তাতে সই-সাবুদ লাগবে মৃতের আত্মীয়-স্বজনদের। তাই মৌকে সান্ত্বনা দিয়ে নিয়ে গেলাম আমার চেম্বারে। সকালে কিছু খেয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করে জলখাবারের ব্যবস্থা করলাম। একরকম বকাঝকা করে তা খেতে বাধ্য করলাম।
খাওয়া শেষ হলে কথা প্রসঙ্গে আমি মৌকে বললাম— পোস্টমর্টেম শেষ হওয়ার পর আপনার স্বামীর লাশ থানায় পৌঁছতে সন্ধে হয়ে যাবে। তারপর লাশ নিয়ে কোথায় যাবেন, কোথায় সৎকার করাবেন, সে বিষয়ে কিছু ভেবেছেন?
আমার কথা শুনে যেন আকাশ থেকে পড়ল মৌ। তার চোখ মুখ দেখে বুঝতে পারলাম,ব্যাপারটা নিয়ে কোন চিন্তা ভাবনা তার মাথায় ছিল না। বাধ্য হয়ে আমি প্রশ্ন করলাম— আপনার শ্বশুরবাড়ি কোথায়? অনুপের বাবা মা, ভাই-বোন সবাই বেঁচে আছে তো?
মৌ আঁচল দিয়ে তার চোখ দুটো মুছে বললেন— আমি কিছু জানি না স্যার!
বিস্ময়ে আমার চোখদুটো ছানাবড়া হয়ে গেল। সাথে সাথে বললাম— এ কী কথা বলছেন আপনি? কোথায় বিয়ে হয়েছে, আপনার পরিবারে কে কে আছেন— এসব সম্বন্ধে আপনি কিছুই জানেন না, একথা আমাকে বিশ্বাস করতে হবে?
মৌ কাঁদতে কাঁদতে বললেন— আমি একবর্ণও মিথ্যা কথা বলছি না স্যার! আসলে অনুপ ছিল অনাথ। শিলিগুড়ির অনাথ আশ্রমে মানুষ হয়েছে সে। ওর সঙ্গে আমার আলাপ পরিচয় হয়েছিল দার্জিলিংয়ের কনভেন্ট স্কুলে পড়ার সময়।
আমি নিজেকে সামলাতে না পেরে ক্ষোভের সঙ্গে বলে ফেললাম— তারপর ভালোবাসা করে বিয়ে? সত্যি কথা বলতে কি, আপনারা মেয়েরা…।
—সব মেয়েদের দোষ দেবেন না স্যার! প্রতিবাদ করে মৌ বললেন— আমি স্বচক্ষে দেখেছি, অনাথ ছেলে বলে অনুপকে কী রকম অত্যাচার, অবিচার, সহ্য করতে হয়েছে। কী ভাবে তাকে হেনস্থা হতে হয়েছে সবসময়। আমাদের মতো ভদ্রঘরের সন্তানদের হাতে কতটা না অসহায় ছিল সে। এখনকার ভাষায় আমরা যাকে র্্যাগিং বলি, তার চেয়েও অনেক বেশি ভয়ানক ছিল সে যাতনা, সে নির্যাতন। কিন্তু কী দোষ করেছিল অনুপ? সে তো অনাথ হয়ে জন্ম নেয়নি। নিজেদের মান সম্মান বাঁচাতে, বদনাম এড়াতে আমাদের এই সমাজের পরিচিত কেউ তাকে অনাথ করে ফেলে দিয়ে গেছে আস্তাকুড়ে। আর আমরা তাকে অবজ্ঞা, অবহেলার, কাঁটার মালা পরাবার ব্রত নিয়েছি। ব্যাপারটা আমার মনে প্রচন্ড আঘাত হেনেছিল। তাই আমি মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবেসে ফেললাম অনুপকে। তার মনের সব দুঃখ কষ্ট দূর করার ব্রত নিয়ে ফেললাম। এমনকি তাকে জীবনসাথী বানাবার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। কিন্তু ভগবান আমাকে…বলে আবার কান্নায় ভেঙে পড়লেন মৌ।

পুলিশের চাকরি করতে গিয়ে নানারকম ঘটনা প্রবাহের আবর্তে পড়ে আমি আমার অনুভূতি প্রবণ মনটা হারিয়ে বসেছি অনেকদিন আগে। কিন্তু প্রচুর মাত্রায় বেড়ে গিয়েছিল কৌতূহল আর সন্দেহ। কারণ আমার চাকরির শুরুতেই বালুরঘাট থানার আই.সি. যোগেশ দত্ত সাহেব আমাকে শিখিয়েছেন—প্রকৃত পুলিশ হতে গেলে সকলকে সন্দেহের তালিকায় রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, কেউ সন্দেহের উর্ধ্বে নয়। সেই কথাটা এতদিন দেববাক্য বলে মেনে চলছি। তাই মৌয়ের ভাষণে বিগলিত না হয়ে সমস্যা সমাধান করার কথা ভেবে জিজ্ঞাসা করলাম— আপনি কি তাহলে আপনার স্বামীর লাশ সৎকারের জন্য বাড়িতে নিয়ে যেতে চাইছেন না?
— আমি কোথায় নিয়ে যাব স্যার? আপনারা একটা ব্যবস্থা করে দিন।
আমি ভাবনাচিন্তা করে বললাম— ঠিক আছে। সরকারি ভাবে যাতে মৃতদেহ সৎকার করা যায় তার জন্য আপনি একটা কাগজে আবেদন করুন। আমি দেখছি কী ব্যবস্থা করা যায়।
মৌ আবেদনপত্র লিখতে শুরু করলেন। ঠিক সেই সময় একজন হোমগার্ড এসে ঢুকল আমার চেম্বারে। আমার হাতে একটা হার তুলে দিয়ে বলল— স্যার! এই হারটা লাশটার কাছে পাওয়া গেছে।

(ক্রমশ)

অলংকরণ- রাতুল চন্দরায়