তহমীনা খাতুন

(কখনও তিনি নিজে লিখেছেন, কখনও তাঁকে নিয়েই হয়েছে খবর। সেই সমাজকর্মী ও লেখিকা তহমীনা খাতুনের মৃত্যু হয়েছে কয়েকদিন আগেই। তবে দেহদানের মধ্য দিয়ে এবার তিনি বেঁচে থাকবেন অনেকের মধ্যে। তহমীনা বেঁচে থাকবেন লেখালেখির জগতেও। বর্তমান লেখাটি তাঁর ‘পথিকৃৎ বাঙালি নারী’ বইটি থেকে নেওয়া।)

 

ভারতের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে পুরুষের পাশাপাশি বহু নারীর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অংশগ্রহণই আন্দোলনকে অনেক বেশি শক্তিশালী করে তুলেছিল। সে আন্দোলন কখনও সরাসরি ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে কখনও বা ব্রিটিশ সামাজ্যবাদ দ্বারা পুষ্ট দেশীয় ভূ-স্বামী ও রাজাদের বিরুদ্ধে। তেমনি এক অগ্নিকন্যা বীরভূমের রানিগঞ্জ সিয়াকোশালের দুকড়িবালা দেবী।

দুকড়িবালা দেবী ২৯ জুলাই ১৮৮৭ সালে ব্রাহ্মণী নদীর তীরে ঝাউপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা ফণীভূষণ চক্রবর্তী। তাঁর কথা বলতে গেলে বীরভূমের স্বাধীনতা সংগ্রামের চিত্রটা তুলে ধরাই শ্রেয়। বিশেষত ১৯০৫ সাল থেকেই বীরভূমের বুকে স্বাধীনতা সংগ্রামের বীজ পোঁতা হচ্ছিল। দানা বাঁধছিল স্বদেশী আন্দোলন। কখনও হেতমপুর কলেজের ছাত্ররা সরকারের নির্দেশ অমান্য করে কলেজ বর্জন করছে, কখনও বোলপুরে স্বরাজ আশ্রম গঠিত হচ্ছে।

হাইস্কুলের শিক্ষক নিবারণ ঘটক অনেক পরিশ্রম করে বিভিন্ন জায়গায় যুগান্তর দল গঠন করছেন। তিনিই দুকড়িবালা দেবীকে দেশের কাজে উৎসাহিত করেন। দুকড়িবালা ছিলেন সম্পর্কে তাঁর মাসিমা। দুকড়িবালার মধ্যে ছিল দেশপ্রেম ও সাহসী মন। বিপ্লবী দলে সবার ‘মাসিমা’ বলে অচিরেই পরিচিত হলেন দুকড়িবালা। তখন তিনি সন্তানের জননী।

বিপ্লবী বিপিনবিহারী গাঙ্গুলির নির্দেশে ১৯১৪ সালে কলকাতায় রডা কোম্পানির মাউজার পিস্তল ও কার্তুজের ৫০টি বাক্স লুঠ হয়। তার মধ্য থেকে বেশ কিছু নিবারণ ঘটকের কাছে আসে। তাঁর দেওয়া সাতটি মাউজার পিস্তল ও কার্তুজ দুকড়িবালা নিজের কাছে রাখেন। এরপর পুলিশ খোঁজ পেয়ে তাঁর বাড়ি তল্লাসি করে। রডা কোম্পানির মাউজার পিস্তল ও কার্তুজ ভর্তি ট্রাঙ্ক পেয়ে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে। দৃঢ়চেতা সাহসী দুকড়িবালা জেলে চলে যান কোলের সন্তান ফেলে। এই মাউজার পিস্তল বিপ্লবীদের কাছে পৌঁছাতে সাহায্য করেছিলেন ননীবালা। যাঁকে সবাই ‘মেজো পিসি’ বলে জানতেন। বিপ্লবী ননীবালাকেও পুলিশ গ্রেপ্তার করে অনেক নির্যাতন করলেও তিনি একবারের জন্যও মুখ খোলেননি।

সিউড়ি স্পেশাল ট্রাইবুনালে দুকড়িবালা ও নিবারণ ঘটকের বিচার হয়। নিবারণ ঘটকের ৫ বছর ও দুকড়িবালার ২ বছর কারাদণ্ড হয়। ১৯১৮ সালে দুকড়িবালা দেবী মুক্তি পান এবং ১৯৭০ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। স্বাধীনতার পর আমরা তাঁকে কতটা সম্মান জানিয়েছি সে প্রশ্নও তোলা প্রয়োজন।

অলংকরণ-রাতুল চন্দরায়