সুখেন্দু হীরা

(আইপিএস সুখেন্দু হীরা বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল (নিরাপত্তা)। প্রতারণার নানা কাহিনি ধারাবাহিক ভাবে তিনি তুলে ধরছেন বালিহাঁস-এর পাতায়।)

স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে সবে কলেজে ঢুকেছি। একদিন পাড়ার এক বন্ধুর দিদি আমাকে পাকড়াও করলেন। বন্ধুর দিদি একটি অর্থলগ্নি সংস্থার এজেন্ট হয়ে কাজ করতেন। আমাদের ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে বলতাম দিদি অমুক ব্যাঙ্কের এজেন্ট। তিনি একটা ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের কথা বোঝালেন। প্রতিমাসে সামান্য কিছু টাকা করে দিলে কয়েক বছর বাদে একটা ভালো পরিমাণ টাকা ফেরত পাওয়া যাবে। এদের দৈনিক জমা স্কিমও আছে অর্থাৎ প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা জমা দেওয়া যায়। তাতেও ভালো আয়।

দৈনিক টাকা জমা রাখবে এমন বড়লোক কে আছেন? কেন বাজারের ছোটো দোকানদারেরা, খেটে খাওয়া ‘দিন আনি দিন খাই’ মানুষেরা। কারণ, এদের প্রতিদিন সামান্য হলেও একটা আয় আছে। সেই আয়ের সামান্য অংশ তাঁরা রোজ এইসব এজেন্টদের কাছে জমা দেন। যাঃ বাবা, যাঁদের আমরা তথাকথিত গরিব লোক ভাবি, তাঁরাই এই কোম্পানিগুলির পুষ্টি সাধন করছে!

তখনও চিটফান্ড নিয়ে ধারণা ছিল না। কোম্পানির ‘পেডিগ্রি’ বা ‘গুডউইল’ কিছুই বুঝতাম না। শুধু বন্ধুর দিদি বলেছেন, অনুরোধ ফেলতে পারলাম না। এই সামান্য টাকা আমার পকেট মানি থেকে ম্যানেজ করতে পারবো। তাছাড়া, উচ্চমাধ্যমিকের পর টিউশনি পড়িয়ে সামান্য কিছু উপার্জন করি।

কয়েক মাস টাকা দেওয়ার পর, দিদি আর টাকা জমা নিলেন না। বললেন, ‘‘আমি কাজ ছেড়ে দিয়েছি। এত লোকের বাড়ি ঘুরে ঘুরে টাকা আদায় করি অথচ ঠিকমতো কমিশন দেয় না। তোর টাকা মার যাবে না। তোর তো তিন বছরের স্কিম। তুই তিন বছর বাদে কোম্পানিতে গিয়ে কাগজপত্র দেখালে টাকা ফেরত পেয়ে যাবি। তুই যদি টাকা জমাতে চাস, তাহলে ওদের অফিসে গিয়ে জমা দিয়ে আসতে পারিস।’’ পাড়ার দিদি অনুরোধ ফেলতে পারিনি বলে রাজি হয়েছিলাম। কোম্পানির উপকার করব বলে তো নয়! তাছাড়া তিন-চার মাসে সামান্য টাকা গেছে। অতএব আমিও ক্ষুদ্র সঞ্চয়ে দাড়ি টানলাম। তিন বছর বাদে সেই কোম্পানির খোঁজ নিতে গিয়ে দেখি কোম্পানি উঠে গেছে। আমার ক্ষুদ্রসঞ্চয়ও উবে গেছে।

কলেজ জীবন শেষ করে জীবন সংঘর্ষে লিপ্ত। স্কুল-কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে কদাচিৎ দেখা হয়। সবাই যে যার মতো করে লড়াই করছে। এমন সময় একদিন পাশের পাড়ার বন্ধুর সঙ্গে দেখা। বলল, একদিন তোদের বাড়িতে যাব। যেচে আসতে চাইলে আমন্ত্রণ জানাতেই হয়। একদিন বন্ধু ও তাঁর সঙ্গে এক ব্যক্তি এলেন আমাদের বাড়িতে। বন্ধুটি এক বিখ্যাত সংস্থার অর্থ সংগ্রহ করার এজেন্ট হয়েছে। সঙ্গের ব্যক্তিটি বন্ধুর সিনিয়র, তিনিও একই কাজ করেন। তাঁরা অবশ্য আমায় অর্থ লগ্নি করতে বললেন না। বললেন এজেন্ট হতে। এজেন্টদের লোভনীয় কমিশন। আমার সেই দিদির কথা মনে পড়ে গেল।

সে কথা তুলতেই সিনিয়র এজেন্ট কোম্পানির ‘কুলজি’ ও ‘নাম’-এর কথা বললেন। কিন্তু এত টাকা কমিশন দিলে কোম্পানি কত টাকা বিনিয়োগ করবে? কতদিন এই হারে কমিশন দিতে পারবে? এই দুইয়ের মধ্যে সমতা রক্ষা করাটা আমার বিশ্বাসযোগ্য হ’ল না। আমি বললাম, আমি এখন টিউশন পড়াচ্ছি, তাছাড়া চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছি, আমি সময় পাবো না।

উনি বললেন, টিউশনি পড়ালে তো বেশি সুবিধা। আপনি ছাত্রের বাড়ির লোককে সহজে বোঝাতে পারবেন, আর এই কাজ করলে আপনার পড়াশোনার বিশেষ ক্ষতি হবে না। মাঝখান দিয়ে কিছু ইনকাম হয়ে যাবে।
উনি ঠিকই বলেছেন, আমি দেখতাম গৃহশিক্ষকরাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জীবনবীমা বা অন্যান্য অর্থলগ্নি সংস্থার এজেন্ট হতেন। কারণ তাঁরা শিক্ষক হিসেবে ছাত্রদের বাড়িতে প্রাধান্য পেতেন। সহজেই লোকজনকে বিশ্বাস করাতে (Convince) পারতেন। যাই হোক, আমি বিনয়ের সঙ্গে তাঁদের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করি।
বেশ কিছুদিন বাদে সেই বন্ধুর সঙ্গে দেখা। সে তখন অন্য একটা কোম্পানিতে কাজ করছে। কারণ সেই বিখ্যাত কোম্পানি, সেই উচ্চহারে কমিশন দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। প্রচুর এজেন্ট ছাঁটাই করা হয়েছে। অনেক এজেন্টরা অন্য কোথাও কাজ খুঁজে নিয়েছেন। কিন্তু মাঝখান দিয়ে যে সব প্রান্তিক মানুষেরা এজেন্টের মুখ চেয়ে সঞ্চয় করেছিলেন, তাঁরা তাঁদের লগ্নিকৃত অর্থ কোথা থেকে পাবেন— সে পথ খুঁজে পাননি।

এজেন্টরা লগ্নিকারীদের কোম্পানির পথ দেখিয়েছেন। কোম্পানি কোনও যথোপযুক্ত প্রমাণ, নথি ইত্যাদি চেয়েছে। সেগুলো তাঁরা দিতে পারেননি। অনেকে অতদূর পর্যন্ত পৌঁছতে পারেননি। তাই তাঁদের টাকা কোম্পানির তহবিলের মেদ বৃদ্ধি করেছে। সংবাদপত্রে পড়েছিলাম, সেই কোম্পানির তহবিলে কয়েকশো কোটি টাকা দাবিহীন হিসাবে পড়ে আছে। সেই কোম্পানি ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের মাধ্যমে সংগৃহীত অর্থ বিভিন্ন শিল্পে বিনিয়োগ করে তাদের কোম্পানির নাম, যশ, খ্যাতি বৃদ্ধি করেছেন।

আটের-নয়ের দশকে ব্যাঙের ছাতার মতো অসংখ্য এরকম ক্ষুদ্রসঞ্চয় প্রকল্পের অর্থলগ্নি সংস্থা গজিয়ে উঠেছিল। যে গুলির নাম মনে আছে, সে গুলি হল ক্যাসিয়ন, সঞ্চয়নী, ফেবারিট, ওভারল্যান্ড ইত্যাদি। কেউ কেউ সংবাদপত্রও বার করতে শুরু করেছিল। তবে ব্যাঙ্কিং সিস্টেমের বাইরে বেরিয়ে ‘রিয়েলস্টেট’ বা অন্যান্য ক্ষেত্রে এদের বিনিয়োগের বিশেষ খবর পাইনি, শুধু সেই বিখ্যাত কোম্পানিটি ছাড়া।

এইসব কোম্পানির টার্গেট ছিল সমাজের প্রান্তিক মানুষেরা। যারা ব্যাঙ্কে যাওয়ার সময় ও সাহস পেতেন না। তাঁদের বাড়ি থেকে টাকা নিয়ে যাচ্ছেন এজেন্ট, যে তাঁর খুবই পরিচিত। এর থেকে আরামদায়ক ও নিশ্চিত ব্যবস্থাপনা আর কি হতে পারে? কিন্তু দালালদের দুস্তুরি কমিয়ে দেওয়া, বাদ দিয়ে দেওয়া এবং দালালদের কাজ ছেড়ে দেওয়া ইত্যাদির ফলে প্রান্তিক বিনিয়োগকারীর সঙ্গে লগ্নি সংগ্রহকারী সংস্থার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ইংরাজি Agent শব্দের বাংলা দালাল। দালাল শব্দটি বাংলায় প্রায় অপশব্দের মতো। তাই এজেন্ট শব্দটি ব্যবহার করেছি, যাতে শুনতে খারাপ না লাগে।

ইতিমধ্যে সেই টাকা কোম্পানি অন্যত্র সরিয়ে ফেলেছে, অথবা কোম্পানির হর্তা-কর্তারা হাতিয়ে নিয়েছে, কিংবা কোম্পানি অন্য কোনও ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করে ফুলেফেঁপে উঠেছে। মাঝখান দিয়ে প্রান্তিক বিনিয়োগকারীরা বঞ্চিত হয়েছেন। তাঁরা অনেক ক্ষেত্রে স্থায়ী এজেন্টদের চেপে ধরেছেন। এজেন্টদের প্রতারকের তকমা পেতে হয়েছে। অনেক এজেন্ট লজ্জায়, অপমানে আত্মহত্যা করেছেন। কোম্পানিগুলোর কর্তা-ব্যক্তিদের নাম বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সামনে আসেনি, তাই তারা ‘প্রতারক’ তকমা না পেলেও অসংখ্য সাধারণ মানুষ প্রতারিত হয়েছেন।

অলংকরণ-রাতুল চন্দরায়