অনিন্দিতা দাশগুপ্ত

রূপকথার ঊষর মরুরাজ্য লাদাখ। দশ হাজার ফুটের উপর বরফ-পাথর ও বালিতে ঘেরা স্তব্ধতার মায়াপুরী। পাথরের রং যেখানে চোখ ধাঁধিয়ে দেয় আর শুষ্কতার ছোবল প্রাণ শুকিয়ে দেয়। হাড় কাঁপানো শুকনো হাওয়ার সঙ্গে সহবাসের অভিজ্ঞতায় অভ্যস্ত হতে গিয়ে যখন নিজেকে ভেঙে –গড়ে নিতে হয়, শস্যশ্যামলা দেশের মানুষ যখন এই হরিৎশূন্য রংবাহারি পাথরের নেশায় বুঁদ হয়ে যায়, তখনও সে ভাবে না, তার বিস্ময়ের আরও বাকি আছে। এই রুক্ষ পাথুরে পথের শেষে কি আছে ঘুমিয়ে থাকা রাজকন্যার গ্রাম? সোনার কাঠি–রূপোর কাঠি ছোঁয়ালেই কি সে জেগে উঠবে? আর রাজকন্যা হেসে উঠলেই এই রুক্ষ পাথরে সবুজের ছোঁয়া লাগবে? হ্যাঁ। সেই ঘুম থেকে জেগে ওঠা রাজকন্যার গ্রামের নাম তুরতুক।

তুরতুক, এখন ভ্রমণবিলাসীদের কাছে একটি পরিচিত নাম। লাদাখ ভ্রমণ কালে ভ্রমণ-আয়োজকদের লিস্টে তুরতুকের নাম থাকছে দীর্ঘদিন ধরেই। লাদাখের বিখ্যাত নুব্র্যা ভ্যালি থেকে তুরতুক গিয়ে ফিরে আসছেন অনেকেই। কিন্তু তুরতুকের আনাচে-কানাচে লুকিয়ে রয়েছে প্রকৃতির যে বিস্ময়, পাথুরে গলিতে লুকিয়ে থাকে যে ইতিহাস আর সংস্কৃতি, তার সুলুক সন্ধান পেতে গেলে অবশ্যই তুরতুকে থাকতে হবে, ঘ্রাণ নিতে হবে এখানকার মাটি–পাহাড়-মানুষের। খুঁড়ে দেখতে হবে এর প্রাচীন ইতিহাস। লেহ শহর থেকে ২০৫ কিলোমিটার দূরে, ভারত-পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণরেখার মাত্র ৬ কিলোমিটারের ব্যবধানে নুব্রা তহসিলের মধ্যে সায়ক নদীর ধারে অবস্থিত এই তুরতুক গ্রাম। স্থানীয় ভাষায় ‘ দুগদুগ’ শব্দের অর্থ সুন্দর বা পছন্দের স্থান। সম্ভবত তারই অপভ্রংশ হল ‘তুরতুক’।
একদিকে হিমালয়, অন্যদিকে কারাকোরাম পর্বতশ্রেণীর মধ্যে অবস্থিত এই গ্রাম। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে সায়ক নদী। এখানে পরিষ্কার , নীল কাঁচের মতো আকাশের প্রেক্ষাপটে দেখা যায় কারাকোরামের পাক -অধিকৃত পর্বতশৃঙ্গগুলি। সিয়াচেন হিমবাহ যাবার একটি পথও শুরু হয় এখান থেকে। এই চোখ ধাঁধানো স্বচ্ছ প্রকৃতির মধ্যে এসে পড়ে বিস্মিত ও মুগ্ধ দৃষ্টি ভাবতে ভুলে যায়, এই গিরিশৃঙ্গের মধ্যেই কোথাও রয়েছে মানবসৃষ্ট কাঁটাতারের বেড়া।

ইসলাম ও বৌদ্ধ— উভয় সংস্কৃতির মানুষেরই বসবাস এখানে। তুরতুকের মানুষেরা প্রাচীনকালে ছিলেন ‘বন’ ধর্মাবলম্বী। এখানকার স্থাপত্যেও এর ছাপ দেখতে পাওয়া যায়। ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতাব্দীতে এখানে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে । এখানে ইসলামের ব্যাপক প্রভাবের কারণ সুফি সাধক ও কবি সৈয়দ আলি শাহ হামদানি, যার নামানুসারে, সৈয়দ মহম্মদ নূরবক্স , বাল্টিস্তানের মানুষ সুফি নূরবক্সিয়া ধর্মমত অনুসরণ করত । অষ্টম শতাব্দী থেকে এখানে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব দেখতে পাওয়া যায়। তাই মসজিদ ও মঠ— দুইই দেখা যায় এখানে। প্রাচীন সিল্ক রুটের ব্যবসার কারণে বহু দেশি -বিদেশি শাসক এই অঞ্চলের দখল নিতে চেয়েছিলেন। তবে এখানকার সংস্কৃতি প্রধানত বালটিক । ভাষা বাল্টিক/ উর্দু। হাজার চারেক মানুষের বাস এখানে। ইন্দো-পাক সংস্কৃতির মেলবন্ধন স্পষ্ট । আমরা ছিলাম সলমন ভাইয়ের বাড়িতে। সলমন ভাই সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিয়েছেন। একে সীমান্তবর্তী এলাকা,তার সঙ্গে রয়েছে যুদ্ধের ইতিহাস । তাই পুরো এলাকাটাই সেনায় মোড়া। তৈরি হয়েছে সেনা স্কুলও। সলমন ভাইয়ের তিন ছেলেমেয়েই সেনা স্কুলে পড়ে। বড়টি হস্টেলে থাকে। পরিচয় হল, ছোট ওয়াসিম আর শালিমার সাথে। ওয়াসিম ক্লাস এইটে পড়ে। হিন্দি – ইংরেজি ভালই বোঝে, টুকটাক দিব্যি বলতে পারে। শালিমা সবে ক্লাস ফোর । উর্দু ছাড়া কিছু বলতে বা বুঝতে পারে না, অন্য ভাষাগুলো সবে শিখছে। ওর লাজুক হাসি অবশ্য ভাষার সব ব্যবধান ঘুচিয়ে দেয়।

ভোরবেলা বেরোলাম ওয়াসিমের সাথে গ্রাম ঘুরতে। ও বলল, আমাদের শর্টকাটে নিয়ে যাবে ওপরে, চাষের ক্ষেতে। কারাকোরাম পর্বতমালার কোলে বড় হয়েছে যে ছেলে, সে রাস্তা ছেড়ে পাহাড় টপকে যাবে— সেই তো তার চলার পথ। সেই পথ, আমাদের মতো সমতলের লোকেরা, যারা প্রতিদিন ট্র্যাফিকের জঙ্গলের মাঝে ট্রেক করতে করতে যায়, ভাঙা রাস্তা– জমে থাকা জল, লোহা-লক্কড়, স্টোন চিপসে হোঁচট খেতে খেতে জুতোর শুকতলা খোয়াতে থাকে , তাদের কাছে ওয়াসিমের উঁচু পাথরের দেওয়াল বেয়ে শর্ট কাট রাস্তাটি নেহাত সুবিধের নয়। কিন্তু পাথরের দেওয়াল বেয়ে সারা গায়ে কারাকোরামের ধুলো মেখে যখন ওপরে উঠলাম, তখনই চিচিং ফাঁক। সামনে খুলে গেল এক অপার্থিব জগৎ। রুক্ষ, কঠিন কারাকোরামের পাদদেশে এক শস্য শ্যামল উপত্যকা। এক প্রান্তর জোড়া সবুজ গমের ক্ষেত। কোথাও বা সর্ষে। কারাকোরামের হলুদ-নীল পর্বতমালা, নীচে ঘন সবুজ গমের ক্ষেত, তার মাঝে মাঝে সর্ষে ফুলের হলুদ আলপনা, তার ওপর কালো ভ্রমর আর রঙিন প্রজাপতিদের খুনসুটি , ক্ষেতের ধারে ধারে ফুটে আছে পাহাড়ি গোলাপ। ওপরে নিদাগ নীল আকাশ , আমাদের দৃষ্টি স্তব্ধ করে দিল। তুরতুকের এই বিস্ময়কর সৌন্দর্য আমাদের চোখের ক্যামেরায় চিরস্থায়ী জায়গা নিল আর আমাদের মনের মণিকোঠায় অমূল্য রত্ন হয়ে রয়ে গেল।


ওয়াসিমকে ছেড়ে দিতে হল, ওর স্কুলের দেরি হয়ে যাচ্ছিল। তাই আমরা নিজেরাই তুরতুকের রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকলাম। চলতে চলতে পাশে তাকালেই দেখা যায়, আমার পাশেই কলকল করে হাসতে হাসতে, লাফাতে লাফাতে চলেছে দুই বেণী ঝোলানো কিশোরীর মতো উচ্ছল সায়ক নদী। পাহাড়ের ওপর থেকে বয়ে আসা বরফ গলা জলই সায়কের এই উচ্ছ্বাসের কারণ। আবার চারপাশ যখন ঘন বরফে ঢেকে যায়, তখন snow leopard রা নেমে আসে পাহাড়ের নীচে, শিকারের খোঁজে।
সায়কের ওপর একটি পায়ে চলা সেতু। পাথরের ওপর চঞ্চল সায়ক আর তার ওপর পায়ে চলা ব্রিজটি যেন শিল্পীর তুলিতে আঁকা কোনও ছবি। এই সেতুটিই তুরতুকের উপর ও নীচের দুটি অংশ— ‘ফারোল ও ‘ইয়ুল’ এর মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করে। চারপাশে পাথরের বাড়িঘর। দারিদ্র্যের ছাপ সর্বত্র স্পষ্ট। যারা একটু অবস্থাপন্ন , তারা নিজেদের বাড়িঘর সাজিয়ে পর্যটকদের জন্য খুলে দিচ্ছে। কৃষি ছাড়া এটাই রোজকারের বিকল্প উপায়। এছাড়া আছে প্রাকৃতিক ভাবে তৈরি হওয়া অ্যাপ্রিকটের জঙ্গল। তাই যাদের পুঁজি আছে, তারা অ্যাপ্রিকটের ব্যবসায় মন দিয়েছে। সমগ্র লাদাখ এবং নুব্রার ধূসর-রুক্ষ-শীতল মরুভূমিতে তুরতুক এক উজ্জ্বল বিস্ময়। কারণ, তুরতুকের আবহাওয়া অন্যান্য জায়গার মতো চরমভাবাপন্ন নয়। বরফের সময়টুকু বাদ দিলে এখানে আবহাওয়া বড়ই মনোরম। শীতল মরুভূমিতে সবুজের চিহ্ন খুবই সামান্য, অথচ তুরতুক এক উর্বর ভূমিক্ষেত্র। ক্ষেত ভরা শস্যের সাথে সাথে চারিদিকে ফলের গাছ ঘিরে রয়েছে গ্রামটিকে। অ্যাপ্রিকট তো আছেই, তার সঙ্গে চেরি, মালবেরি , কলা, আপেল— সর্বত্রই প্রকৃতির অকৃপণ হস্ত।কারণ, এখানে জলের কোনও অভাব নেই। বরফগলা জল , এই গ্রামটিকে অফুরন্ত প্রাণশক্তিতে ঘিরে রেখেছে।

গ্রাম ভ্রমণ সেরে ফিরে এসে প্রাতরাশ। আপ্রিকটের জঙ্গল দিয়ে ঘেরা খোলা বারান্দায় সলমন ভাই সাজিয়ে দিলেন বিশুদ্ধ লাদাখি প্রাতরাশ। বাকুইটের রুটি, খাম্বীর, সঙ্গে পেয়াজ-রসুন-লঙ্কা দেওয়া জিভে জল আনা সর্ষে শাক আর ঘরে পাতা দই। সঙ্গে ছিল বাড়ির টবে লাগানো শাকের আচার। আর অবশ্যই দুধ-মাখন-নুন দেওয়া লাদাখি চা। রসনা ও হৃদয় লাদাখি স্বাদে ও আতিথেয়তায় টইটম্বুর হয়ে গেল। ওয়াসিম ও শালিমার জন্য দিলাম মুঠো ভর্তি চকলেট। উপহার পেলাম ব্যাগ ভর্তি শুকনো অ্যাপ্রিকট, যেটা আমাদের পরবর্তী পুরো লাদাখ ভ্রমণে খিদে-তেষ্টায় কাজ দিয়েছে; তা-ও শেষ করতে পারিনি। কলকাতায় এসে বন্ধুদের খাইয়েছি।

তুরতুকের রাজা-রাজড়াদের ইতিহাস শুধু বইয়ের পাতায় লুকিয়ে আছে মনে করলে ভুল হবে। তুরতুকের রাজবাড়ি আজও বহাল তবিয়তে দাঁড়িয়ে রয়েছে তার রাজামশাইকে নিয়ে। জানতে গেলে যেতে হবে তুরতুকের রাজমহলে। তবে রাজবাড়িতে যেতে হলে আপনি যদি রাজপথ খোঁজেন, তাহলে মস্ত ভুল করবেন, বা হয়ত একসময় তা রাজপথ থাকতেও পারে, আজ আপনাকে যেতে হবে তুরতুকের মূল রাস্তা থেকে পাথুরে গলিপথ দিয়ে। এই পথগুলি অনেকটা আমাদের উত্তর কলকাতার দুই বাড়ির উঠোনের মাঝখানের গলির মতো। মূলত হাঁটা পথ, দুপাশে গায়ে গায়ে লাগা পাথরের বাড়ি। ছোট ছোট দরজা-জানলা। বাচ্চারা খেলে বেড়াচ্ছে, মহিলারা দরজা দিয়ে বেরিয়ে হাসিমুখে আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছে। হেলে দুলে হেঁটে যাচ্ছে গ্রামেরই কারও পোষা গাধা। পুরো গ্রামটাই পাহাড়ের গায়ে। তাই গ্রামের পথে যেতে হলে বেশ চড়াই রাস্তায় হেঁটে গিয়ে তবে রাজবাড়ি পৌঁছতে হবে। বর্তমানে সেই রাজবাড়ি পর্যটকদের দর্শনীয় স্থান, ব্যক্তিপিছু একশো টাকার টিকিট কেটে আপনি ঢুকে যেতে পারেন বালটি সাম্রাজ্যের অন্দরমহলে, যেখানে ইয়াবগো সাম্রাজ্য রাজত্ব করেছে ১০০০ বছর। সেই সাম্রাজ্যেরই রাজা তুরাব খান ১৫০০ শতাব্দীতে এই রাজমহল নির্মাণ করেন। প্রধানত গরমের সময়ই তিনি এই রাজমহলে বাস করতেন, বাকি সময় থাকতেন খাপুল রাজবাড়িতে। তুরতুকে বাড়ি বানাবার প্রধান কারণ, গরমে এর মনোরম আবহাওয়া এবং এর অবস্থানগত সুবিধা।

তুরতুক থেকে সিল্ক রুট দিয়ে চিন এবং কার্গিল, শ্রীনগর অথবা লেহ, যে কোনও জায়গাতেই খুব সহজে যাতায়াত করা যায়। এছাড়া এটি ছিল আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের একটি গুরুত্বর্পূণ জায়গা। ফলে এখানে বহু মানুষের আগমন ঘটত ব্যবসার উদ্দেশ্যে। তাদের কাছ থেকে কর আদায়ই ছিল রাজার প্রধান উদ্দেশ্য। যে তরুণটি আমাদের রাজবাড়ি ঘুরিয়ে দেখাল, এসবই তার কাছে শোনা। ১৮৩৪ এ জম্মুর রাজা গুলাব সিং এই অঞ্চলটি অধিকার করেন, তখন ইয়াবগো আব্দুল্লাহ খান তাঁদের পারিবারিক পদবির সাথে ‘কাচো’ শব্দটি যুক্ত করেন, যার অর্থ ‘হালকা’। যদিও এখনও এই পরিবারটি যথেষ্ট সম্পদ ও ক্ষমতাশালী।

রাজপ্রাসাদে ঢুকেই প্রশস্ত জায়গা। একদিকে পাথরের সিঁড়ি ওপরে উঠে গেছে। ওপরে উঠে চারপাশ জুড়ে ঘর, মাঝখানটা খোলা। অন্য বাড়িগুলির মতোই রাজবাড়িরও দরজা জানলা ছোট ছোট। ঠান্ডায় ঘর গরম রাখার জন্যই দরজা-জানলা ছোট করা হয়। সিঁড়ি দিয়ে উঠে দোতলায় বাইরের দিকে প্রশস্ত ঝুলন্ত বারান্দা। সেখানেই তাকিয়া-সহ বসে সপার্ষদ প্রজাদের অভিবাদন গ্রহণ করতেন। কলকাতা শহরের বেশ কিছু পুরনো দিনের বাড়িতে এখনও এরকম ঝুল বারান্দার দেখা মেলে। এছাড়া আছে জেনানা মহল, একই রকমের প্রশস্ত বারান্দা , কিন্তু বাড়ির ভিতরের দিকে। রানিমা সেখানে বসে রাজার কথোপকথন শুনতেন। প্রাসাদের বিভিন্ন ঘরে সংরক্ষিত রয়েছে রাজাদের ব্যবহৃত জিনিসপত্র। বিভিন্ন স্থান থেকে আসা রাজ-অভ্যাগতরা যে সব উপহার দিয়েছিলেন রাজাকে, তা-ও রাখা আছে সেখানে। তার মধ্যে রয়েছে ফুলদানি, থালা বাসন, কলসি ইত্যাদি। বিভিন্ন স্থানের ধাতু, তার ওপর ভিন্ন ভিন্ন কারুকাজ বিস্ময় সৃষ্টি করে। সমগ্র প্রাসাদটি পাথর নির্মিত হলেও প্রাসাদের মূল দরজা থেকে শুরু করে বারান্দার ওপরের অংশ, ছাদ, দরজা-জানলা সবই কাঠ দিয়ে কারুকাজ করা। সেগুলির মধ্যে একই সঙ্গে হিন্দু- বৌদ্ধ ও ইসলামিক কারুকাজ লক্ষ্য করা যায়। ইসলামি স্থাপত্যের মধ্যে স্বস্তিক চিহ্ন সম্বলিত কাঠের কারুকাজ করা প্যানেল চোখে পড়ে। বিশেষ ভাবে নির্মিত রান্নাঘর ও রান্নার বিবিধ আকার ও প্রকারের সরঞ্জামও খুব কৌতুহলদ্দীপক। লক্ষ্য করার বিষয় , রান্নাঘর বা অন্যান্য ঘর, যেখানে মহিলারা থাকে বা কাজ করে , সেই ঘরগুলোর জানলাগুলি ছোট ছোট । আর পুরুষদের কাজের বা থাকার ঘরগুলোর জানলা বড় বড়। ছোট জানলা দিয়ে আলো কম আসবে, ঘরের মধ্যে অন্ধকার থাকবে , ফলে ঘরের মহিলাদের বাইরে থেকে দেখা যাবে না। এই উদ্দেশ্যেই এই ভিন্নতা।

সমস্ত রাজপ্রাসাদ ঘুরে শেষে জুতো খুলে আমাদের ঢুকতে হল রাজার ঘরে। গালিচায় মোড়া বিরাট ঘর। একদিকের দেওয়ালে রাজাদের বংশতালিকা। তার চারপাশে তাঁদের ছবি। আধুনিক কালের অনেকগুলি ফটোগ্রাফও চোখে পড়ে সেখানে। বিশাল snow-leopard-এর ছবির নীচে একটি বিরাট গদি-আটা সিংহাসনে বসে আছেন রাজামাশাই। পরনে রাজকীয় পোশাক। মাথার টুপিটি মুকুট সদৃশ। হাতে সুদৃশ্য কারুকাজ করা পেতলের লাঠি। লাঠিটি রাজদণ্ডেরই অনুরূপ। বসার ভঙ্গিটিও রাজকীয় বটে । উনি আমাদের বুঝিয়ে দিলেন ইয়াবগো রাজবংশের ইতিহাস। রাজা ইয়াবগো তুং এই রাজত্বের স্থাপনা করেন। সেই থেকে ২৬তম রাজা ছিলেন পার্শী। শাহ আজম খান ইরান থেকে আগত সাধকের প্রভাবে তিনি ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হন। ইয়াবগো সিকিমের স্ত্রী চেয়েছিলেন, তাঁর তিন পুত্রই রাজা হোক। তাই রাজ্যকে তিন ভাগে ভাগ করা হয় । তখন তুরতুকের রাজা হন ইয়াবগো তুরুপ খান। তুরুপ খানেরই বংশধর তিনি— এই রাজবংশের বর্তমান রাজা , যিনি আমাদের এই ইতিহাস জানালেন, ইয়াবগো মহম্মদ খান কাচো। তাঁর জন্ম ১৯৫৮ তে। রাজা এখন নিজেদের জমিতে কৃষিকাজ করান এবং অ্যাপ্রিকটের ব্যবসা ও অন্যান্য নানা ব্যবসার সাথে যুক্ত রয়েছেন। উনি ঘুরিয়ে দেখালেন রাজপরিবারের ব্যবহৃত অস্ত্রশস্ত্র, তরোয়াল, তির ধনুক, রাজার পতাকা, রাজা-রানি, এমনকি তাঁদের ঘোড়ার অলঙ্কারাদি, আধুনিক বন্দুক এবং তাঁদের পরিবারের চিহ্ন ঈগলের পা-টি।

তুরতুক গ্রাম ভ্রমণকালে সাক্ষাৎ হল অসংখ্য নারীপুরুষের সাথে। মেয়েরা সবাই খুব পরিশ্রমী ও সুন্দর চেহারার অধিকারী। কিন্তু তাঁদের ছবি তোলার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আছে। ছবি তোলার প্রস্তাবে সবাই না করে দিয়েছে, বাচ্চা মেয়েরা ব্যতিক্রম। পরবর্তীকালে এই অভিজ্ঞতা অন্যত্রও হয়েছে। বুঝলাম এখানে নারীদের নির্দিষ্ট বিধানের মধ্যে বাস করতে হয়। নিজেকে ভাগ্যবান মনে হতে লাগল। রাস্তার ধারে দেখলাম ‘মিউজিয়াম’ লেখা বোর্ড, তিরচিহ্ন দেওয়া রয়েছে। গ্রামের ভিতরের পাথরের বাড়ির মাঝখানের সরু রাস্তা দিয়ে খুঁজতে লাগলাম মিউজিয়ামের রাস্তা। এ-গলি, সে-গলি ঘুরে , চড়াই-উতরাই ভেঙে, বহু মানুষকে জিজ্ঞাসা করেও খুঁজে পেলাম না। সাহায্য নিলাম গুগল ম্যাপের। সবাই রাজার বাড়ি দেখিয়ে দেয়। অবশেষে অনেক খুঁজে শীর্ণ এক গলির মধ্যে ততোধিক শীর্ণ ও জীর্ণ বাড়ির সামনে দেখলাম বোর্ড লাগানো আছে। বোর্ডটি দেখে বিস্ময়ের সীমা রইল না। সেখানে লেখা রয়েছে— “ TURTUK HERITAGE HOUSE AND MUSEUM BY WOMEN WELFAIR SOCIETY, TURTUK” তুরতুকের এই ছোট্ট গ্রামে ‘ ওমেন ওয়েলফেয়ার সোসাইটি’ ? সামাজিক বিধি- নিষেধের মধ্যেও তাহলে সংগঠিত হচ্ছে মেয়েরা? বিস্ময়ের আরও বাকি ছিল। প্রায় ভেঙে পড়া শীর্ণ, ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেলাম দোতলায়। আমাদের স্বাগত জানালেন মাঝবয়সি ও বয়স্ক তিন নারী। মাথাপিছু পঞ্চাশ টাকা করে টিকিট। মাথা নিচু করে ঢুকলাম ভাঙা-চোরা একটি ঘরের মধ্যে। ততক্ষণে ভাবতে বসেছি, এত পরিশ্রম করে এই ভাঙা বাড়িতে সময় নষ্ট করতে না এলেই ভালো হত। ঘরের ভেতরে ঢুকে অবাক হয়ে গেলাম। যে ঘরে একটি লম্বা মানুষ সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না, সেরকম ঘরেই একটু উঁচু জায়গা করে সাজানো রয়েছে অসংখ্য জিনিস। কি সেসব জিনিস? কয়েকশো বা কয়েক হাজার বছর ধরে বালটিস্থানের মেয়েরা যে ভাবে জীবনযাপন করে এসেছে, তারই দলিল। কেমন ছিল তাঁদের জীবন? ছোট্ট-ছোট্ট জানলা দেওয়া নিচু ঘরের মধ্যে গৃহস্থালির কাজ করতে করতেই দিন কেটে যেত তাঁদের। কিন্তু হলই বা তা জাঁকজমক-হীন সাদামাটা হেঁসেল-জীবন? শুধু যুদ্ধবিগ্রহই কি ইতিহাস ? রাজাদের ঐশ্বর্যময় জীবনই কি শুধু স্থান পাবে ইতিহাসের পাতায়? আর যাঁরা তাঁদের শ্রমে টিকিয়ে রাখল এই সংসার ও সমাজ জীবন? সেই জীবনকে ধরে রাখবে কে? তাই এগিয়ে এসেছে মেয়েরাই। সংগ্রহ করেছে প্রাচীন কাল থেকে মেয়েদের ব্যবহার্য অসংখ্য জিনিস। আগে তারা যে ধরণের জুতো বা জামা ব্যবহার করত, যে ধরণের বাসনপত্রে রান্না করত, পুরনো দিনের হাঁড়ি-কলসি , চা বানাবার কেটলি, জল গরম রাখার সরঞ্জাম, পাথর ভেঙে বানানো শিলনোড়া, এমনকি পাথরের উনুন পর্যন্ত। তার সঙ্গে সাজানো আছে পুরনো দিনের সময় থেকে নানা ধাতুতে তৈরি তাঁদের শখের গয়না। বহু যুগ ধরে ঘরের কাজের সাথে সাথে তাদের চাষের কাজেও হাত লাগাতে হতো। তাই তারা নিজেদের সুবিধার জন্য বানিয়ে নিয়েছে কম ওজনের, কিন্তু শক্তপোক্ত কাঠের তৈরি জমিতে কাজ করার বিভিন্ন জিনিস। এছাড়া, অনেক জামাকাপড় একসঙ্গে কাচার জন্য মোটা গাছের গুড়ি দিয়ে তৈরি বড় ড্রাম সদৃশ পাত্র, যেখানে আরেকটি মোটা গাছের গুড়ি দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কাপড় কাঁচা হতো। পদ্ধতিটি অনেকটা আজকের washing machine এর মতো । আর সবচেয়ে আকর্ষনীয় বস্তুটি হল প্রাচীন কালে ব্যবহৃত বিয়ের পোশাক। পোশাকটি চটের তৈরি, ঠান্ডা থেকে বাঁচার জন্য, মাথায় রূপোলী ধাতুর তৈরি গয়না আর উজ্জ্বল গোলাপি রঙের জরির মতো কাজ করা ওড়না। যে মহিলারা আমাদের ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিলেন, তারা আমাকে বিয়ের পোশাকটি পরিয়ে দেখিয়ে দিলেন ক কী ভাবে পরতে হয়। তার সঙ্গে মাথায় দিলেন ভারি ধাতুর গয়না। আমাকে পোশাকটি পরানোর পর নিজেদের মধ্যে বালটিক ভাষায় কী বলাবলি করছিলেন তারা। জিজ্ঞেস করতে বললেন, বিয়ের পোশাকে আমাকে নাকি এক্কেবারে বাল্টিক রমণীর মত লাগছে। ওই প্রাচীন ভাঙাচোরা বাড়ির সামনে প্রাচীন বাল্টিক বিবাহ সাজে সজ্জিত হয়ে ক্ষণকালের জন্য কোনও এক অশ্বারোহী বাল্টিক বীরকে যে কল্পনা করিনি , তা নয়। আমাদের বিদায় দিলেন ওই বাড়িরই গাছের অ্যাপ্রিকট ফল উপহার দিয়ে।
লাদাখের এক সীমান্তবর্তী গ্রামে যেখানে রাজরাজড়াদের যুদ্ধজয়ের ইতিহাস কিংবা দুই রাষ্ট্রের সংঘাতের কাহিনি মুখে মুখে ফেরে, সেখানে নিঃশব্দে গড়ে উঠেছে নারীর নিজস্ব বয়ানের ইতিকথা । প্রখর প্রতিবাদ নয়, সমান্তরাল ইতিহাস রচনায় নারীদের নিজস্ব স্বরকে ক্রমশ প্রোথিত করার প্রয়াস নির্মাণ করছে ইতিহাসের আধুনিক আখ্যান।

অলংকরণ- রাতুল চন্দরায়