অসীম শীল

বেশ ঝামেলায় পড়লাম তো! শীতকালে কুয়াশা হয়, তা বলে এত ঘন? কিছুই প্রায় দেখা যাচ্ছে না। বাসন্তী এক্সপ্রেসওয়েতে এমনিতেই দুর্ঘটনা ঘটে। তার উপর চারদিক প্রায় অন্ধকার। যা হোক আস্তে আস্তে চলা যাক। এরপর নদীতে কী অপেক্ষা করে আছে কে জানে! ধামাখালি পৌঁছতে পৌঁছতে বেলা হয়ে যাবে, আশা করি কুয়াশা ততক্ষণে কেটে যাবে।

—সমীর, কোথায় টিফিন করা যায় বল তো? কতক্ষণে পৌঁছব তা তো জানি না। সাহেবদের পছন্দের মতো খাবারই বা এখানে কি পাব? কে জানে! তবে এ দু’টো আদাড়ে বাদাড়ে ঘোরা সাহেব।
—ঘটকপুকুর তো ছাড়ালাম, চলুন মালঞ্চ পর্যন্ত যাই, ওখানে কিছু দোকান আছে।

একটু পরিচয় দিই আমার সঙ্গীদের। ব্রায়ান আর রজার দু’জনেই বিখ্যাত ফটোগ্রাফার, একটি জনপ্রিয় আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমের প্রতিনিধি। বছর তিনেক হল আমার সাথে পরিচয়। কী ভাবে তা হলো, সে কথা থাক। আচমকা একদিন বলে ফেলল, তোমাকে নিয়ে একটা ছবি তুলতে চাই। সম্মতি দিতে হবে।
—আমি? তোমাদের আগ্রহ তো জানি জানোয়ারদের নিয়ে। আমার মধ্যে কি দেখতে পেলে হে? অসম্ভব, আমি অনুমতি দিতে পারছি না, দুঃখিত। এই মোটা লোকটার কী ছবি তুলবে তোমরা?
—না না, আমরা শুধু জন্তুদের ছবি তুলি না। স্বাস্থ্য, মানবাধিকারও আমাদের ছবি তোলার অন্যতম বিষয়। তোমাকে ‘হ্যাঁ’ বলতেই হবে।
—আগে বিষয়টা বুঝি— তবে তো।
—তুমি যে চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন প্রান্তে ছুটে যাও, অন্তত গত তিন বছরে যা দেখেছি— সেটাই আমরা ধরতে চাই।
—বুঝলাম। কিন্তু ওরকম নির্লজ্জ ভাবে কি নিজের ছবি তোলানো যায়? বরং যে মানুষগুলো আমাদের দেশে না দেখতে পেয়ে অকারণ কষ্ট পায়— তাদের হয়ে কিছু বল, সেখানে ডাক্তার হিসেবে আমি পাশে থাকব। এটুকু সম্মতি দিতে পারি।
—ঠিক আছে। সেরকম দু-তিন জন চরিত্র বেছে রেখো। সময় করে আসব।

এসব কথা বছরখানেক আগে হয়তো মিটে গেছে। এবার যে সত্যি সত্যিই এসে পড়েছে। গাড়ির অর্ধেকটা ওদের নানান যন্ত্রপাতিতে বোঝাই।
—স্যার, এখানে দাঁড়াবেন? সমীর প্রস্তাব দিল।
—মনজুর, কী বলিস রে? কি খাওয়াবি সাহেবদের?
—মনে হয় কচুরি পাওয়া যাবে।
—ওসব তেলেভাজা খাবে না, চল দেখি আর কি আছে?

পথের ধারের ছোট একটা খাবারের দোকান, রেষ্টোরেন্টও বলা চলে না। পরোটা ভাজছে, সাথে ঘুঘনি আর চা পাওয়া যাবে। ব্রায়ান আর রজারের দৃষ্টি গেল ডিমসেদ্ধর হাঁড়ির দিকে। দু’জনে গোটা চারেক করে গরম গরম সিদ্ধ ডিম গপাগপ্ মুখে পুরে দিল। ব্যাস, ব্রেকফাস্ট শেষ। বরং আমাদেরই ঘুঘনি-মুড়ি খেতে সময় লাগল। চা খেতে খেতে ব্রায়ানের কাছে আমার চিন্তাটা প্রকাশ করলাম।
—বুঝলে ব্রায়ান, এই এলাকায় মাঝে মাঝে এমন ঘন কুয়াশা আসে আর টানা কয়েকদিন ধরে চলে যে সকালে সূর্যই দেখা যায় না। তোমরা ছবি তোলার জন্য ভালো আলো পাবে কি না— সন্দেহ আছে।
—This is perfect. Don’t worry, fog goes very well with blindness.
কুয়াশার সাথে অন্ধত্ব ভালো মানায়— বেশ! শিল্পীর দৃষ্টি— আমিও চিন্তামুক্ত। এমনিতে তো ডিসেম্বর ঝলমলে রৌদ্রের দিন। যা হোক, ওদের প্রয়োজন মিটলেই ভাল।

প্রায় দুপুর হয়ে গেল খামাখালির ঘাটে পৌঁছতে। একটা মাত্রই হোটেল আছে ওখানে। মালপত্র রেখে নারায়ণপুরের দিকে যাওয়া হল নৌকা নিয়ে। ওখানেই একটা পরিবারের ছবি তোলা হবে। বড় কষ্টে আছে আসমা, শহিদুলের পরিবার। অল্প বয়সেই ছানি পড়ে এদের চোখ অন্ধ হয়ে যায়। গরিব মানুষ, বিশেষ কোথাও যেতে পারে না— কোন রকমে জীবন চলে যায়। শহিদুল সামান্য দেখতে পায়, নদীর বাঁধের উপর দিয়ে সেই অল্প নজর নিয়েই সাইকেল চালায়। অসভ্য কিছু ছেলে-পিলে পিছন থেকে হঠাৎ ডাক দেয়। নিজেকে সামলাতে না পেরে শহিদুল মাঝে মাঝে মাটিতে পড়ে গিয়ে আঘাত পায়, আর সবাই মজা দেখে।

ফটোগ্রাফাররা নানা ভাবে ছবি তুলতে থাকে। ঘরের মধ্যে, উঠোনে, নদীর ধারে। শেষ পর্যন্ত সূর্য ডোবার সাথে সাথে ছবি তোলা শেষ হয়। ততক্ষণে আবার কুয়াশা জমতে শুরু করেছে। কুহেলির অপেক্ষাতেই ছিল ওঁরা— সূর্যাস্ত, কুয়াশা আর মানুষ একসাথে মিলাবে কোনও দৃশ্যের প্রয়োজনে।

পরের দিন ভোরে বেরিয়ে আমি আবার হাসপাতালে চলে এলাম। মনজুর ওদের নিয়ে অন্যান্য দৃশ্যের ছবি তোলাবে। আরও দু’টো পরিবারকে বলা ছিল যে ফটো তোলার জন্য বিদেশ থেকে লোক আসতে পারে। ধামাখালির থেকে পরের দিন ওরা ঝড়খালি চলে যাবে।

আবার তিনদিন পর সন্ধ্যার কাছাকাছি আমি ঝড়খালি পৌঁছলাম। মনজুর আমার জন্য অপেক্ষা
করছিল।
—চা খাবেন তো স্যার?
—তা আর বলতে? ঠান্ডা পড়েছে। একটু কড়া করে বড় কাপে দিতে বল।
—রাতের খাবার কি অর্ডার দেব? একবারেই বলে আসি।
—গরম গরম ভাতে ধোঁয়া উড়বে, তার সঙ্গে আলু দিয়ে পাতলা মুরগির ঝোল। আহ! ভাল হবে না বল?
—দারুণ! আর কী বলব?
—আর কি? একটু চাটনি থাকলে ভাল। খেয়ে টানা ঘুম দিতে হবে। হাসপাতাল থেকেই দৌঁড়েছি, বাসে
আসতেও সময় লাগল।
রেস্টোরেন্টে খাবার অর্ডার দিয়ে ভগ্নদূত মনজুর ফিরে এল।
—স্যার, সহেবরা এখনই ডিনারে বসে গেছে, আপনাকে ডাকছে।
—হ্যাঁ? ছটাও তো বাজেনি। এখনই কি খাবে?
বাধ্য হয়ে ফটোগ্রাফারদের সাথে দেখা করতে রেস্তোরাঁয় যেতে হল।

ব্রায়ান বলে, ‘এসো এসো, কালকের পরিকল্পনাটা একটু করা যাক।’ মন বেজার করে বসলাম।
—How was your journey today?
—ঠিকই ছিল, একটু ক্লান্ত লাগছে।
—ডক্টর, তোমাকে একটু সমস্যা দেবো, যদিও জানি তুমি আজ অনেক পথ পার করে এসেছ।
—সমস্যা ভাবলেই সমস্যা, বলে ফেল।
—কাল সকালে যখন তোমাকে নিয়ে আমরা ছবি তুলব নদীর মধ্যে— তখন কুয়াশা চাই, তাই কষ্ট হলেও তোমাকে ভোরে উঠতে হবে।
যাঃ! বহু কাঙ্ক্ষিত শীতের রাতের লম্বা ঘুমের পরিকল্পনা বাতিল?
—ঠিক আছে। দৃশ্যের প্রয়োজনে ভোরবেলা উঠে পড়ব।

ঘরে এসে মনজুরের সাথে চা খাব বলে টেবিল ছেড়ে উঠতে যাচ্ছি তখন সাহেব বলে,
—আরে যাচ্ছ কোথায়? তোমার ডিনারও আমদের সাথে দিতে বলেছি।
আবার সমস্যা! রাতে মাংস-ভাতের জন্য মুখিয়ে আছি যে। কী আর করা? পড়েছি যবনের হাতে খানা খেতে হবে সাথে। এল কয়েক বাটি স্যুপ, বয়েল্ড চিকেন আর আলু ভাজা। সত্যিই মানুষ ভাবে এক, হয় আর এক। যা ভাগ্যে আছে তাই হবে। সুন্দরবনে বসে স্রেফ জলে সেদ্ধ সাদা সাদা মুরগির ঠ্যাংয়ের উপর গোলমরিচ ছড়িয়ে, নুন দিয়ে শীতের সন্ধ্যা উপভোগ করো। যত্তোসব!

রাতের ঘুমটা ক্লান্তির কারণে ভালোই হল, পেটে মাংস-ভাত পড়লে আরও জমে যেত। যাক, যা হয়নি তা নিয়ে আফশোস করে কী হবে? গরম জামা কাপড় পরে হালকা অন্ধকার থাকতে থাকতেই ঝড়খালির ঘাটে পৌঁছলাম। কুয়াশার মধ্য দিয়ে সূর্যকে তখন চাঁদের মতন দেখাচ্ছে। পাড়ের কাছে জেলেরা মাছ ধরছে। কয়েকজন মিলে এক এক করে ছোট ছোট নৌকা ঠেলে নদীতে নামাচ্ছে। আমার নিজের ক্যামেরাতে সে সব সুন্দর দৃশ্য ধরে রাখার চেষ্টা করছি। এমন সময় মনজুর এসে বলে যে নৌকা পাওয়া যাবে না। যেহেতু বিদেশি লোক— তাই। সজনেখানি গিয়ে অফিস খুললে অনুমতি জোগাড় করে তবে নৌকা চড়তে হবে। সে তো অনেক দূর। অত সব সারতে সারতে তো দুপুর হয়ে যাবে। মরণ! আমার ঘুমও গেল, কুয়াশাও গেল। এবার উপায়? মুশকিল আসান করতে একজন চলে এলেন— শ্রীযুক্ত অতিরিক্তের কৃপায় একটা ভালো নৌকাই জুটে গেল।

নৌকায় আমার স্থান নির্ধারিত হল গোলুই এর উপর। জামার তলায়, কোমরের বেল্টে নানান তার বাঁধা। বেশ খানিকটা জলের মধ্যে গিয়ে একটা নিঃশব্দ জায়গায় নৌকা নোঙর করা হল। একের পর এক ছোট ছোট নৌকায় জেলেরা দেখি দাঁড় বাইতে বাইতে দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে। বড় বড় অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ি বসিয়ে পুরুষ, মহিলারা সমানতালে বৈঠা টেনে চলেছেন, গাছের ফাঁক দিয়ে আসা ভোরের সূর্যের আলোতে পাত্রগুলো মাঝে মাঝে চকচক করে উঠছে। এমন দৃশ্য আর কোনওদিন দেখতে পাব কি না জানিনা, কিন্তু আমার আর ছবি তোলার ক্ষমতা নেই— আমি এখন তারের ফাঁদে বন্দি। নৌকার অবস্থান নদীর এমন ধার ঘেঁষে যে শুধু মনে হতে থাকল— এই বুঝি দক্ষিণরায় লাফিয়ে পড়বে। যা হোক, আমাকে প্রায় ঘণ্টা দু’য়েক বকিয়ে কখনও একই কথা কয়েকবার বলিয়ে সাহেবরা ক্ষান্ত হল। ততক্ষণে কুয়াশা কেটে গেছে।

দুপুরের আহার ঝাড়খালিতেই— এবেলা মাছ ভাত। খাবার আগেই সাহেবদের ধন্যবাদের চোটে পেট অর্ধেক ভরে গেল। ওদেশের লোকেরা যে কোন মানুষকেই ধন্যবাদ জ্ঞাপনের বিষয়ে বেশ সচেতন— এরা একটু বেশিই দিচ্ছে। যাকগে, আমি তাকিয়ে আছি কখন ফুলকপি দিয়ে ভেটকি মাছের ঝোল আসবে। হঠাৎ ব্রায়ান বললো, ‘’ডক্টর, তোমাকে একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করতে পারি, of course if you are not too hungry and don’t mind answering.’’
—নিশ্চয়, কি বল?
—আমরা বিভিন্ন ডাক্তার বা পেশাদার লোকেদের সাধারণত দেখতে অভ্যন্ত যে তাঁরা সময় কী ভাবে ব্য়য় করবে —তার একটা পরিকল্পনা থাকে। তোমার সেরকম কিছু আছে বলে তো মনে হয় না।
—মানে!
—যেমন কিছুটা সময় ডাক্তারির জন্য, কিছুটা পরিবারের জনা, কিছুটা নিজের শখের জন্য, কিছুটা অন্যান্য কাজের জন্য ইত্যাদি। এই ছকের বাইরে ওরা যায় না।
—ও বুঝলাম। আমি ওরকম কোনওদিন ভাবিনি, শিখিওনি।
—তাই আমাদেরও মনে হয়। আমরা দু’জনে আলোচনা করছিলাম, You are enjoying your work, your travel, talking to people happily without any hurry.
—সত্যিই তো এমন রুটিনে বাধা জীবন আমার নয়।
—তাহলে তুমি কী পাও এরকম জীবন থেকে?
—বড় দামি প্রশ্ন করলে হে। কী উত্তর দিই। বরং একটা ঘটনা তোমাদের বলি।

তোমরা আসার মাসখানেক আগেই আমি বিহারের সারণ জেলায় ক’দিন কাজ করে ফিরলাম। ওখানকার কিছু স্বাস্থ্যকর্মীদের নিয়ে গ্রামে গ্রামে যেতে হয়েছিল। একদিন সকালে একটা মহল্লার কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে কাজকর্ম তদারক করছি— এক বৃদ্ধ আমার দিকে এগিয়ে এলেন। মাথায় ফেটকি, ঘাড়ে গামছা আর হাতে খৈনী। সরাসরি প্রশ্ন,
—আপনি কি বঙালি?
—হ্যাঁ, কিন্তু আপনি কি করে বুঝলেন?
—জিন্দেগি ভর বঙ্গালমে ট্রাক চালায়া। মেরা নাম রামনরেশ যাদব।
—বাংলায় কোথায় চালাতেন?
—পুরা বঙ্গাল, আপ বোলিয়ে না আপকা ঘর কঁহা হ্যায়?
—গোবরডাঙ্গা।
—জানি, ওইখান দিয়েই পাঁচপোতা, বেড়ি-গোপালপুর যেতে হয়।
—একদম ঠিক কথা।
—আপনার স্কুল কোথায় ছিল?
—দক্ষিণ চাতরা। চেনেন?
—হ্যাঁ হ্যাঁ, তেঁতুলিয়ার রাস্তায়। স্কুলের সামনে একটা বড় হাট ছিল না?
—তাই তো।
—আপনার গাঁও আমি চিনি তাহলে, ওখানে মেজদার মিঠাই দোকান ছিল। ডাক্তারখানার মোড়ে মানিকের চায়ের দোকানে আমরা চা খেতাম।
—মেজদা, মানিকমামা সব তো আমাদের চেনা লোক। কেউ আর বেঁচে নেই।
—মানিক বহুত আচ্ছা আদমি থা।
—হ্যাঁ, ওঁকে সবাই খুব ভালোবাসত। আচ্ছা আপনি কী নিয়ে যেতেন ওই দিকে?
—ইছামতীর ধারে যত ইটভাটা ছিল, ওখানে রানিগঞ্জ, আসানসোল থেকে কয়লা নিয়ে যেতাম। তাই আমি বসিরহাট, ইটিন্ডা, টাকি, বনগাঁ সব চিনি।

রামনরেশের কথায় কথায় আমি যেন আবার এক শিশু হয়ে গেলাম। আমার চেনা নদী, চেনা রাস্তা, চেনা প্রিয় মানুষ যেন চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে এসে দাঁড়ালো। ভুলে গেলাম আমি অনেক দূরে অন্য কাজে এসেছি।

—দেখো ব্রায়ান, কোথায় বিহার আর কোথায় বাংলার ইছামতীর তীর, করতে গেলাম এক কাজ, উপরি পেলাম এমন আর এক হৃদয়স্পর্শী উপহার যা আমার কাছে একান্তই অপ্রত্যাশিত। না চাইতেই পৌঁছে গেলাম আমার শৈশবে, আমার কৈশোরে— কোনও এক অচেনা বন্ধু আমার হাত ধরে নিয়ে গেল আমার ভালবাসার ভূমিতে, এক নিমেষে সরিয়ে দিল সময়ের কুয়াশা। বলতে পার এমনটাই আমি পাই জীবনে, অনেকটা না চাইতেই— এটাই আমার উপার্জন।
—Incredible! No more question.

——————————————-

অলংকরণ- রাতুল চন্দরায়

2 COMMENTS

Comments are closed.