সুখেন্দু হীরা

(আইপিএস সুখেন্দু হীরা বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল (নিরাপত্তা)। প্রতারণার নানা কাহিনি ধারাবাহিক ভাবে তিনি তুলে ধরছেন বালিহাঁস-এর পাতায়।)

একদিন সাধারণ ডাকে বাবার নামে একটা পোস্টকার্ড এলো। কোথা থেকে এলো বা কে পাঠালো, কিছু বোঝা যাচ্ছে না। চিঠির বিষয়বস্তু এই যে, পোস্টকার্ডে পাওয়া মাত্রই অনুরূপ দশটি পোস্টকার্ড লিখে আপনার পরিচিতি ১০ জনকে পাঠাবেন। পাঠালে ১০ দিনের মধ্যে আপনার মনবাঞ্ছা পূর্ণ হবে। না পাঠালে ১০ দিনের মধ্যে আপনার এই এই ক্ষতি হবে। শেষে লেখা “জয় সন্তোষী মা”।

সেই সময় ‘জয় সন্তোষী মা’ সিনেমা বের হবার পর চতুর্দিকে সন্তোষী মায়ের প্রচুর ভক্ত ছিল। মহিলা ভক্তরা শুক্রবার দিন সন্তোষী মায়ের ব্রত পালন করতেন। গরুকে ছোলা ও আখের গুড় খাওয়াতেন। হাতে করে ছোলা ও আখের গুড় নিয়ে গরু খুঁজে বেড়াতেন।

এই চিঠি পাওয়ার ঘটনা যখন, তখন আমি ইস্কুলে পড়ি। চিঠি পেয়ে আমি দশটা পোস্ট কার্ড লিখতে উদ্যত হলাম। আমার বাবা সন্তোষী মায়ের ভক্ত ছিলেন না, তিনি ছিলেন মা দুর্গার ভক্ত। তিনি চিঠির নির্দেশ উপেক্ষা করলেন। আমি ১৫ দিন পর্যন্ত বিপদের আশঙ্কায় ভয়ে ভয়ে থাকলাম।

খুব কম লোক এরকম নির্দেশ উপেক্ষা করতে পারতেন। তার ওপর ভাবতেন মাত্র দশটা পোস্ট কার্ড, কত আর দাম। তখন ১৫ পয়সার পোস্ট কার্ড পাওয়া যেত। পরবর্তীকালে আমি নিজে নামেও “কালীমাতার” নামে পোস্টকার্ড পেয়েছি। ততদিনে এরকম হুমকি উপেক্ষা করার সাহস জুগিয়ে ফেলেছি।

কারা এগুলো শুরু করেছিলেন, এর পিছনে কী স্বার্থ আছে বুঝতে পারিনি। প্রথমে মনে হয়েছিল পোস্ট অফিসের কোনও ভূমিকা আছে। এতে তাদের পোস্টকার্ড বিক্রি বাড়বে। কিন্তু পরে জানলাম পোস্টকার্ড ব্যবস্থাপনা ডাক দফতর ভর্তুকি দিয়ে চালায়। শুধুমাত্র গরিব মানুষের কথা ভেবে ডাক দফতর পোস্টকার্ডের মতো খোলা চিঠির ব্যবস্থা রেখেছেন।

মানসজগতে একটা ‘থিয়োরি’ কাজ করে— অন্যের ক্ষতি মানে আমার লাভ। আবার আর একটা ‘থিয়োরি’ আছে আমার যখন অর্থদণ্ড হয়েছে অন্যেরও হোক। আমাদের বন্ধুদের মধ্যে দেখেছি, কেউ একটা সিনেমা দেখে এসেছে, ছবিটা একদম ভালো হয়নি, কিন্তু তার পয়সা গচ্ছা গেছে, সে এসে বলেছে দারুন সিনেমা হয়েছে। শুনে আরো চারজন পয়সা গচ্ছা দিয়ে এলো। সেই নিয়মেই হয়তো এই প্রক্রিয়াটা বজায় থাকত।

এই বদ প্রক্রিয়াটি চিঠিপত্র ছেড়ে বিস্তার লাভ করেছিল লিফলেট পর্যন্ত। একই বার্তা প্রচার পুস্তিকায় লেখা থাকতো আর বলা হতো, আপনি ৫০ বা ১০০ টা লিফলেট ছাপিয়ে বিলি করুন। চিঠিতে বেশি খরচ না হলেও লিফলেট ছাপাতে কিন্তু বেশ খরচ হতো। তার উপর সেগুলো বিলি করার ঝামেলা।

বিষয়টা ‘পঞ্জি স্কিম’-এর মত চলতো, এক থেকে দশ, দশ থেকে একশো। কিন্তু এতে কোনও স্কিম অপারেটরের খোঁজ পাওয়া যায়নি। শুধু তাই নয়, এর মধ্যে পোস্টকার্ড কেনার দাম, কালি কলমের দাম, সময়ের দাম এবং মানসিক উদ্বেগ ছাড়া আর কোনও ক্ষতি চোখে পড়েনি। পরবর্তীকালে আমি যখন পুলিশের চাকরিতে যোগদান করি, তখনও কোনও থানা-ফাঁড়িতে এ নিয়ে অভিযোগ দাখিল হয়েছে বলেও শুনিনি।

মোবাইল ফোন সর্বজনীন হওয়ার পর চিঠিপত্র আদান-প্রদান কমতে থাকল। হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক জনপ্রিয় হওয়ার পর ব্যক্তিগত চিঠি লেখা বন্ধ হয়ে গেল। তখন কোনও বিশেষ বার্তা বা নাম মাহাত্ম্য প্রচারের প্রক্রিয়াটা পোস্টকার্ড বা চিঠি ছেড়ে মোবাইলে সিঁধোলো। ২০০৩ সালে যখন মোবাইলে বি.এস.এন.এল-এর সংযোগ ছিল একচেটিয়া। অন্যান্য নেটওয়ার্ক সংযোগ ছিল বটে, তবে যে কয়েকজন মোবাইলে ফোন ব্যবহার করতেন, তাঁদের বেশির ভাগ ভারতীয় সঞ্চার নিগম লিমিটেডের সিম ব্যবহার করতেন।

তখন একদিন সকালে এক পরিচিতের কাছ থেকে মোবাইলে মেসেজে ঢুকল— আজ বিএসএনএলের জন্মদিন। এই মেসেজটা আপনি পাঁচজনকে ফরওয়ার্ড করুন আর পেয়ে যান ৭৫ টাকা রিচার্জ। ভাবছি মেসেজটা ফরওয়ার্ড করবো কি না? তার মধ্যেই আর এক পরিচিতের কাছ থেকে একই মেসেজ পেলাম। বুঝে গেলাম আমার অনেক সহকর্মীই সাতসকালে এত সুন্দর অফার পেয়ে মেসেজ করতে শুরু করে দিয়েছেন। আর আমার বুঝতে দেরি হলো না, এটা সেই পঞ্জি পোস্টকার্ডের মতো পঞ্জি মেসেজ। এতে অবশ্য মেসেজ পাঠানোর খরচ ও ফরওয়ার্ড করার সময় অপব্যয় ছাড়া গ্রাহকের বিশেষ কিছু ক্ষতি হয় না।

আমি এটা এখনও বুঝে উঠতে পারিনি, এই প্রক্রিয়াতে কার লাভ? তারপর যখন হোয়াটসঅ্যাপ এলো, তখন ছবি পাঠানো সহজ হল। তখন ঠাকুর দেবতার ছবি-সহ চিঠির বয়ানে মেসেজ ঢুকতে শুরু করল। এক্ষেত্রে যে ব্যয়টা যুক্ত হ’ল, তা হ’ল নেটের খরচ। আর একটা বিড়ম্বনা বাড়ল, সেটা হ’ল মোবাইলে অবাঞ্ছিত বার্তার ভিড়।

ফেসবুকের ক্ষেত্রে মেসেঞ্জারে বা ফেসবুক দেয়ালে একই ভাবে ছবি-সহ প্রস্তাব আসে। এই ছবিটি দশজনকে বা ১০টি গ্রুপে শেয়ার করলে তাহলে আপনার এই লাভ, আর এই ক্ষতি।

বিষয়টিতে বড় কোনও ক্ষতি হচ্ছে না বলে, কেউ প্রতারণার চক্র খুঁজতে বা ভাঙতে উদ্যোগী হয় না। যিনি প্রথমেই বুঝতে পারছেন এটা একটা প্রতারণা, তিনি স্রেফ উপেক্ষা করছেন।

এই সব ক্ষেত্রে বড়সড় আর্থিক ক্ষতি না হলেও মানুষের সরল বিশ্বাস নিয়ে খেলা করা হচ্ছে। অহেতুক তাদের আরাধ্য দেবতার প্রসঙ্গ এনে ভয় দেখানো হচ্ছে। এগুলো তো একপ্রকার প্রতারণা বটে। প্রতারণাটা যখন হচ্ছে তখন কোনও না কোনও প্রতারক আছেন। এক্ষেত্রে যিনি প্রথমে প্রতারিত হচ্ছেন, তিনি পর মুহূর্তে প্রতারকের ভূমিকা পালন করছেন। প্রকৃত প্রতারক বা মূল প্রতারক খুঁজে পাওয়া মুশকিল।

(ক্রমশ)

অলংকরণ-রাতুল চন্দরায়