সঞ্জয় গুপ্ত

ওড়িশার বালাসোর জেলায় রসগোবিন্দপুর বলে একটা গ্রাম আছে। তার পাশেই ছিল বিমানবাহিনীর একটা পরিত্যক্ত বিমানবন্দর। সেই বিমানবন্দরে জমা হয়ে ছিল বিমানের প্রচুর স্ক্র্যাপ। সেগুলি যাতে কেউ চুরি করে নিয়ে যেতে না পারে, তা দেখার জন্য প্রতিরক্ষা দফতরের ইঞ্জিনিয়ার, সেখানে দিবাকর আর গোবিন্দ নামের দু’জনকে চৌকিদার হিসেবে রেখেছিলেন।

১৯৫৮ সালের এপ্রিল। কলকাতার চ্যাটার্জি ব্রাদার্স নামের একটি প্রতিষ্ঠান থেকে জগৎবন্ধু চ্যাটার্জি এলেন রসগোবিন্দপুরে এই স্ক্র্যাপগুলি কিনতে। তাঁর সঙ্গে এসেছিলেন নেপালি কর্মচারী রামবাহাদুর থাপা। দু’জনে ওখানকার চায়ের দোকানি, কৃষ্ণচন্দ্র পাত্রের বাড়িতে ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করলেন।

পরিত্যক্ত বিমানবন্দরের চারপাশ ঘিরে আদিবাসীদের গ্রাম। সাঁওতাল আর মানঝিঁ— এই দুই ধরনের সম্প্রদায়ের বসবাস। বিমানবন্দরের মাঝখান দিয়ে পায়ে চলা পথ ধরে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যাওয়া যায়। তবে ভূতের ভয়ের কথা ছড়িয়ে রয়েছে সেই পরিত্যক্ত বিমানবন্দরটাকে ঘিরে। ভয়ে এলাকার অনেকেই রাতে বাড়ির বাইরে বার হতে সাহস করেন না।

সেদিন ১৯৫৮ সালের ২০ মে।

তেলকুন্ডি গ্রামের চন্দ্র মানঝিঁ , রাত নটা নাগাদ এসে দাঁড়ালেন কৃষ্ণচন্দ্র পাত্রের চায়ের দোকানের সামনে। ভূতের ভয়ে, আজ রাতটা তিনি ওখানেই থাকতে চান।

শহুরে মানুষ জগৎবন্ধু চ্যাটার্জি আর তাঁর নেপালি কর্মচারী রামবাহাদুর থাপাও ছিলেন সেখানে। তাঁদের খুব ইচ্ছে ভূত দেখার। তাঁরা রাতদুপুরে, চন্দ্র মানঝিঁকে ঘুম থেকে উঠিয়ে তেলকুন্ডি অবধি পৌঁছে দেওয়ার আশ্বাস দিলেন। কৃষ্ণচন্দ্র পাত্রকেও দলে নিয়ে রাতে বেরিয়ে পড়লেন ওঁরা।

যাওয়ার পথে বিশেষ কিছুই ঘটলো না। নির্বিঘ্নে মানঝিঁকে তেলমুন্ডি গ্রামে পৌঁছে দিয়ে, তাঁরা বিমানবন্দরের মাঝখান দিয়ে পায়ে হাঁটা পথ ধরে ফিরতে শুরু করলেন।

কিছুটা আসার পর, হঠাৎ নজরে পড়ল, পথের থেকে প্রায় ৪০০ মিটার দূরে কিছু আলো যেন নেচে বেড়াচ্ছে। খুব জোরে হাওয়াও বইছিল। কিছু ছায়াও যেন সেই আলোর পাশে পাশে দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে প্রেতেরা আলোর চারপাশে ঘুরে ঘুরে নাচছে।

ভয় পাওয়ার বদলে, প্রবল কৌতূহলে তিনজনেই দৌড়ে গেলেন সেই আলোর সন্ধানে। সবচেয়ে প্রথম সেই আধো আলোছায়ার কাছে পৌঁছলেন রামবাহাদুর থাপা। পরিষ্কার কিছুই দেখা যাচ্ছে না। এই সময়ে রামবাহাদুর একটা কাণ্ড করে বসলেন। নেপালিদের কাছে সব সময়েই বাঁকা ছুরি বা কুকরি থাকে। অন্ধকারের মধ্যে সেখানে পৌঁছেই তাঁর কুকরি দিয়ে এলোপাথাড়ি ভাবে ভূতেদের কোপাতে শুরু করে দিলেন রামবাহাদুর।

কৃষ্ণচন্দ্র পাত্র পৌঁছেছিলেন একটু পরে। রামবাহাদুর সে সব খেয়াল করেননি। পাগলের মতো কুকরিটাকে চালাচ্ছিলেন তিনি। একসময় কুকরি লেগে গেল কৃষ্ণচন্দ্র পাত্রের গায়ে। পাত্রের আর্তনাদে থাপার হুঁশ ফিরলো। আর সেই সময়েই শোনা গেল আরও কিছু জখম মানুষের আর্তনাদ।

আসলে সেই রাতে মানঝিঁ সম্প্রদায়ের কয়েকজন মহিলা এসেছিলেন সেখানে। একটি মহুয়া গাছের নীচে, হ্যারিকেন নিয়ে এসেছিলেন তাঁরা সেই রাতে—মহুয়া ফুল তোলার জন্য। রামবাহাদুর ভূত ভেবে তাঁদের কয়েকজনকে কুপিয়ে দিয়েছেন।

সেই রাতে, রামবাহাদুরের কুকরির আঘাতে গেলথি মানঝিঁ নামে একজন মহিলা মারা যান। গঙ্গা মাঝিয়ানী আর সউনরী মাঝিয়ানী নামের দু’জন গুরুতর আহত হন। এছাড়া, কৃষ্ণচন্দ্র পাত্রের আঘাতও অনেক বেশি।

গেলথি মানঝিঁকে খুনের জন্য ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের ৩০২ ধারা এবং বাকিদের গুরুতর ভাবে জখম করার জন্য ৩২৬ এবং ৩২৪ ধারায় মামলা রুজু হলো রামবাহাদুর থাপার বিরুদ্ধে।

তবে এই খুনের ঘটনার বিচার নাটকীয় মোড় নিল। কারণ, সেশন কোর্ট বিচার করতে গিয়ে বললেন, রামবাহাদুর সেই সব মানুষকে আঘাত করেছিলেন এই বিশ্বাসে, যে তাঁরা সব ভূত— মানুষ নয়। জগৎবন্ধু চ্যাটার্জি আর রামবাহাদুর থাপা ওখানকার স্থানীয় বাসিন্দা ছিলেন না। তাঁরা শুনে এসেছিলেন, পরিত্যক্ত ওই বিমানবন্দরে ভূত আছে। বিশেষ করে মঙ্গল আর শনিবারে নাকি তারা বের হয়।
সেই রাতে যে চারজন যাত্রা শুরু করেছিলেন, তাঁদের প্রত্যেকেরই ধারণা ছিল ভূত আছে। সেজন্যই যে মুহূর্তে তাঁরা আলো দেখেছেন, ছায়া নড়তে দেখেছেন, তাঁদের বদ্ধমূল ধারণা হয়েছে যে ওখানে শুধু ভূতেরাই ঘোরাঘুরি করছে। সেই ধারণার বশবর্তী হয়েই রামবাহাদুর, যিনি ভূতের অস্তিত্বে ঘোরতর ভাবে বিশ্বাসী, ছুটে গিয়ে কুকরি দিয়ে কোপাতে শুরু করে দিয়েছিলেন।

ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের একটি ধারা হচ্ছে সেকশন ৭৯। এই ধারা অনুযায়ী যদি কেউ— ভুল করে হলেও, নিছক সত্যি ভেবে কিছু করেন, তাহলে সেই কাজের জন্য আইনি সুরক্ষা পেতে পারেন। (79. Act done by a person justified, or by mistake of fact believing himself justified, by law— Nothing is an offence which is done by any person who is justified by law, or who by reason of a mistake of fact and not by reason of a mistake of law in good faith, believes himself to be justified by law, in doing it.)

রামবাহাদুর তাঁর হাতে থাকা টর্চটাকে যদি জ্বালাতেন, তাহলে হয়তো বুঝতে পারতেন মানুষেরাই চলাফেরা করছিলেন সেখানে। কিন্তু তাঁর বদ্ধমূল ধারণার বশে তিনি টর্চ জ্বালাননি। সঙ্গের দু’জনও সেই বুদ্ধি তাঁকে দেননি।

আদালত সবকিছু বিচার করে শেষটায় সিদ্ধান্তে এলেন— রামবাহাদুর যা কিছু করেছেন, সব কিছু ভূতের বিরুদ্ধে লড়ছেন ভেবেই করেছেন। সেই হিসেবে, সেকশন ৭৯ অনুযায়ী সুরক্ষা তাঁর প্রাপ্য এবং সেই আইনের ধারায় তাঁর বিরুদ্ধে খুনের মামলা দাঁড়ায় না।

ময়ূরভঞ্জ সেশন কোর্টের এই রায়ের বিরুদ্ধে ওড়িশা সরকার হাইকোর্টে আপিল করেছিল। কিন্তু ১৯৫৯ সালের ৯ নভেম্বরে হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ নিম্ন আদালতের রায়কেই বহাল রাখেন।

ভূতে বিশ্বাস থাকার জন্যে, খুনের অভিযোগ থেকে মুক্তি পাওয়ার এই মামলাটি সেই কারণেই আইনি মহলে বিখ্যাত হয়ে রয়েছে।

অলংকরণ-রাতুল চন্দরায়