আবহাওয়ার মেজাজ-মর্জিতে চিরকালই মানুষ জেরবার। কখন কি খেল দেখাবে দেবা ন জানন্তি। আর ইদানিং তো অবস্থা আরও করুণ। একটা সময় ছিল যখন আলিপুর আবহাওয়া অফিসের প্রচারিত পূর্বাভাস লোকের কাছে প্রায়শই হয়ে উঠতো হাসি-মস্করার খোরাক। তাদের ভবিষ্যদ্বাণী কখনওই  মেলে না– এবম্বিধ বদনাম তাদের ললাটে সেঁটে গিয়েছিল। এমনকি এই নিয়ে নানান চুটকি জাতীয় গল্পও বাজারে চালু হয়েছিল। একটি গল্প ছিল এরকম: আবহাওয়ার পূর্বাভাস মেলাতে না পেরে হয়রান এ রাজ্যের আবহাওয়া অফিসের বাবুরা খেয়াল করেন যে পড়শি রাজ্য ওড়িশার আবহাওয়া অফিস নিয়মিত নিখুঁত পূর্বাভাস দিয়ে থাকে। তড়িঘড়ি সেই অফিসে হাজির হয়ে তাঁরা তাজ্জব হয়ে যান এই দেখে যে সেখানে কোনও যন্ত্রপাতি দূরঅস্ত, সামান্য একটি ট্র্যানসিসটর রেডিও ছাড়া আর কিছুই নেই। অবাক বিস্ময়ে তাঁরা ওড়িশা অফিসের কাছে জানতে চান কোনও যন্ত্রপাতি ছাড়াই কীভাবে তাঁরা সঠিক পূর্বাভাস দিয়ে থাকেন। উত্তরে ওড়িশা অফিসের কর্মীরা জানান, যে তাঁরা রেডিওতে মনোযোগ দিয়ে শোনেন কলকাতা অফিসের আবহবার্তা। সেখানে যা প্রচারিত হয়, তাঁরা নিজেদের রাজ্যে তার ঠিক উল্টোটাই প্রচার করেন এবং তা যথারীতি মিলে যায়। এ নির্জলা গল্পই। কিন্তু দিন বদলেছে।

ঠান্ডা-গরম, ঝড়জলের আতিশয্যে জেরবার আমাদের নজর ইদানিং সদাই সেঁটে রয়েছে আবহাওয়া দপ্তরের দিকে। আমরা জানি চাষ-আবাদের মতো প্রাচীন পেশায় আবহাওয়ার ব্যাপারটি কত জরুরি। কৃষকের ভাগ্যের কারিগর সে। ভাঙাগড়া তারই কব্জায়। প্রযুক্তির সৌজন্যে আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনার হদ্দহদিশ নিয়ে আজকের চাষীদের পক্ষে সতর্ক হওয়া অনেকটাই সহজ হয়েছে। কিন্তু চিরকাল তো এই সুবিধে ছিল না। তাহলে আগেকার যুগের চাষিরা আবহাওয়ার আগাম খবর যোগাড় করতো কীভাবে? নাকি কপালে হাত রেখে আকাশের দিকে চেয়ে থাকাই ছিল তার বিধিলিপি। মোটেই তা নয়। তাদেরও করায়ত্ত ছিল এক অতীব চমকপ্রদ লোকায়ত প্রকৌশল, যার সাহায্যে বছরের গোড়াতেই স্থানীয় আবহাওয়ার আগাম খবর চলে আসতো তাদের মুঠোয়। তারা বিলক্ষণ ওয়াকিবহাল হতে পারতো সারা বছরে আবহাওয়ার ভাবগতিক কখন কীরকম হবে সে বিষয়ে। কী সে পদ্ধতি?

বিলুপ্ত প্রজাতির চাষিদের একজন-খগেন্দ্রনাথ বর্মণ

চৈত্রসংক্রান্তির দিন সূর্যাস্তের আগে বাড়ির কাছাকাছি কোনও কচুবনে গিয়ে পরিস্কার দেখে এক একটি কচু পাতা মুড়ে ভালো করে বেঁধে রাখতে হবে। এরকম প্রতিটি কচুপাতার পুঁটুলি এক একটি বাংলামাসের উদ্দেশ্যে সমর্পিত। বারো মাসের জন্য বারোটি পাতাকে আলাদা আলাদা করে ভালো করে লম্বালম্বি কিংবা আড়াআড়ি বেঁধে রাখতে হবে এমনভাবে যাতে বাইরের কিছু ভেতরে ঢুকতে এবং ভেতর থেকে কিছু বাইরে বেরোতে না পারে। কোন পাতাটি কোন মাসের উদ্দেশ্যে সমর্পিত হল তা সতর্কতার সঙ্গে খেয়াল রাখতে হবে যাতে গুলিয়ে না যায়। পরদিন অর্থাৎ পয়লা বৈশাখ সূর্যোদয়ের পর সেখানে গিয়ে এক এক করে প্রথম মাস অর্থাৎ বৈশাখ থেকে চৈত্র অবধি নির্দিষ্ট প্রতিটি কচুপাতার বাঁধন আস্তে আস্তে খুলে দেখতে হবে ভেতরে কী রয়েছে। দেখা যাবে কোনও পাতায় টলটল করছে অনেকটা জল, কোনওটিতে খড়কুটো, কোনওটিতে শিশির বিন্দু আবার কোনওটি একদম ফাঁকা, কিছুই নেই। চৈত্রের শুকনো খটখটে রাতে শক্ত করে বেঁধে রাখা কচুপাতাগুলোর ভেতরে জল, খড়কুটো ইত্যাদি কোন জাদুবলে প্রবেশ করলো, এটাই পরম বিস্ময়ের। যাই হোক, পাতার বাঁধনের মধ্যে আবিস্কৃত বস্তুগুলির অস্তিত্ব চাষিকে নববর্ষের দিনেই স্পষ্ট জানান দেয় সারা বছর স্থানীয় আবহাওয়া কোন মাসে কেমন থাকবে।

অনেকটা জল থাকার অর্থ হল সেই মাসে প্রবল বৃষ্টিপাত। শিশিরবিন্দু থাকলে সেই মাসে শীতের প্রাবল্য। আবার যে পাতায় খড়কুটো সেই মাসে ঝড়বৃষ্টি। আর কিছুই না থাকা, বেমালুম ফাঁকা পাতার মানে হল শুকনো খটখটে খরার মাস। এই প্রতীকি বস্তুগুলিই মাসের হিসেবে স্থানীয় আবহাওয়ার গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে আগাম বার্তা যুগিয়ে দেয় চাষিদের। তবে আজকের চাষিরা বেশিরভাগই এই ট্র্যাডিশনের খবর রাখেন না বললেই চলে। রাখার প্রয়োজন বোধ করেন না। এই প্রায় বিলুপ্ত প্রজাতির চাষিদের একজন– খগেন্দ্রনাথ বর্মণ। কুচবিহার জেলার শীতলখুচি ব্লকের নগরলাল বাজার গ্রামের সত্তরোর্ধ এই কিষাণ এখনও এই লোকায়ত ঐতিহ্যে আস্থাশীল। পিতৃপুরুষের কাছ থেকে অর্জিত এই বিদ্যে তিনি দীর্ঘদিন ধরে প্রয়োগ করে চলেছেন নিজের পেশায়। আধুনিক বিজ্ঞান নিয়ে তাঁর মাথাব্যথা নেই। তিনি এই পদ্ধতি শিখে নিয়েছিলেন কিশোরবেলায়, তাঁর পিতৃদেবের কাছ থেকে। আগ্রহী প্রতিবেশীদের মধ্যে কেউ কেউ শিখেও নিয়েছেন তাঁর কাছ থেকে এই প্রাচীন বিদ্যে। হাতেনাতে পেয়েছেন ফলও।

এই ১৪২৯-এর বর্ষারম্ভেও তিনি যথারীতি সেই দেশজ পদ্ধতি মেনে জেনে নিয়েছেন আবহাওয়ার বছরভ’র মতিগতি। এ বছরের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভিত্তিতে তাঁর স্থানীয় পূর্বাভাষ এরকম:

বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ: জোরালো ঝড়বৃষ্টি হবে।

আষাঢ়-শ্রাবণ: প্রথম দিকে সামান্য বৃষ্টি হবে, তারপর কিছুটা বেড়ে যাবে।

ভাদ্র-আশ্বিন: এই দুমাসেও বৃষ্টি হবে।

কার্তিক-অগ্রহায়ণ: প্রথমার্ধে বৃষ্টি থাকবে।

পৌষ-মাঘ: শীতের স্বাভাবিক প্রকোপ যেমন হয়।

ফালগুন-চৈত্র: সামান্য বৃষ্টি হবে। তবে বেশিরভাগটাই শুকনো।

গ্রীষ্মঋতু সম্পর্কে তাঁর পূর্বাভাস এখনও অবধি নিশ্চিতভাবেই অভ্রান্ত। এবার নজর রাখা যাক সারা বছরের দিকে – প্রাচীনের মহিমা অটুট থাকে কিনা সেটাই দেখার।