সুখেন্দু হীরা

(আইপিএস সুখেন্দু হীরা বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল (নিরাপত্তা)। প্রতারণার নানা কাহিনি ধারাবাহিক ভাবে তিনি তুলে ধরছেন বালিহাঁস-এর পাতায়।)

অসিতের বাড়িতে আছে বাবা আর স্ত্রী। মা মারা গেছেন অনেক দিন। তাই একপ্রকার বাধ্য হয়ে বিয়ে করতে হল। গ্রামের বাড়িতে প্রচুর কাজ থাকে। ঘরে একজন লক্ষ্মী বা মহিলা না থাকলে চলে না। তখন তো সবার অনুরোধে অসিত বিয়ে করে নিয়েছে। কিন্তু সেরকম কোনও উপার্জন নেই। এই কারণে বিয়ের পর একটু অস্বস্তিতেই আছে অসিত।‌ তাই অসিত প্রায় রামপুরহাটে এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জে যেত। সেখানে দেখতো এক ‘ঝকঝকে বাবু’ সবার সঙ্গে কথা বলছে। অফিসারদের ঘরে ঢুকছে। এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জে কিছু মুহুরির মতো লোকজন থাকে। যারা ফর্ম ফিলাপ করে দেয় কিছু পয়সার বিনিময়ে।

আমার মনে আছে, মাধ্যমিক পরীক্ষার পর যখন ব্যারাকপুর এক্সচেঞ্জে গিয়েছিলাম এক বন্ধুর সঙ্গে ‘এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ কার্ড’ করাতে; তখন এদের দেখেছিলাম। শ্রম দপ্তরের অধীন এই এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ থেকে যে কার্ড দিত তাতে অবশ্য লেখা থাকত ‘Identity Card’। মুহুরির মতো ব্যক্তিরা ফর্ম ও কার্ড ফিলাপ করে দিচ্ছিলেন ২ টাকার বিনিময়ে। তখন অবশ্য দু’টাকা দাম অনেক ছিল।

এইরকম মুহুরিরা বলাবলি করত, ‘ঝকঝকে বাবু’ পারেন চাকরি করে দিতে। এখন অসিত বোঝে, সেই সব মুহুরিদের অর্থ দিয়ে পুষে রেখেছিল ঝকঝকে বাবু। ঝকঝকে বাবু যে এক্সচেঞ্জ অফিসে যখন তখন ঢুকে যেত, অফিসারদের সঙ্গে কথা বলে আসত। এসব চাকরি বুভুক্ষু ছেলেদের দেখানোর জন্য। হয়তো ঝকঝকে বাবু অফিসে ঢুকে কোনও বিষয়ে জানতে চাইত, খোঁজখবর নিত। কিন্তু বাইরের অপেক্ষমান কার্ড করতে আসা ছেলেমেয়েরা ভাবতো ক্ষমতাশালী ব্যক্তি বটে ‘ঝকঝকে বাবু’।

অসিত তখন বেকারত্বের জ্বালায় জ্বলছে। বিয়ে করে ফেলেছে, চাকরি একান্তই দরকার। বাধ্য হয়ে যেচে আলাপ করে ঝকঝকে বাবুর সঙ্গে। ৫০,০০০ টাকা নেয় ঝকঝকে বাবু, সঙ্গে জমা নেয় অসিতের বিভিন্ন পরীক্ষার মার্কশীট, সার্টিফিকেট ইত্যাদি। এ সব অবশ্য ২০০৮/২০০৯ সালের ঘটনা।

টাকা তো আটকে গেছেই সেই সঙ্গে পার্সোনাল ডকুমেন্টসগুলো আটকে রেখেছে ঝকঝকে বাবু। ফলে অসিত অন্য কিছু আর করতে পারছে না। কেউ যদি জোরাজুরি করে, কান্নাকাটি করে কাগজপত্র ফেরত নিয়ে গেলে তাকে জমা দেওয়া অর্থের মায়া ত্যাগ করতে হত।

অসিতের অভিযোগের ভিত্তিতে ঝকঝকে বাবুর বাড়িতে রেড হ’ল। বাড়িতে পাওয়া গেল অনেক মার্কসীট, অ্যাডমিট কার্ড, সার্টিফিকেট। সেই সঙ্গে বিভিন্ন সরকারি অফিসের রাবার স্ট্যাম্প। এই রকম রাবার স্টাম্প অবশ্য যে কোনও স্ট্যাম্প বানানোর দোকানে গেলে বানিয়ে দেয়। জানা গেল, এইসব জাল রাবার স্ট্যাম্প দিয়ে সে বিভিন্ন সার্টিফিকেটের জেরক্স কপি অ্যাটেস্টেড করত। চাকরিপ্রার্থীকে সেই সব অ্যাটেস্টেড জেরক্স কপি দেখাতো। চাকরিপ্রাপ্তি ভাবতো সত্যিই তার সঙ্গে কত বড় বড় অফিসারের চেনাশোনা।

অসিত টাকা ফেরত পেল বটে, কিন্তু কোনও চাকরি পেল না। অসিতের মতো অসংখ্য ছেলেরা প্রতিনিয়ত প্রতারিত হচ্ছে। কারোর সরকারি চাকরি করার বাসনা, কারোর বাড়িতে অভাব, কারোর বাগদত্তা অপেক্ষা করছে, কেউ হয়তো বিয়ে করে নিতে বাধ্য হয়েছে, এখন সংসার ধর্ম রক্ষা করা দায় হয়ে পড়েছে। এইসব সমস্যার সহজ সমাধান একটা সরকারি চাকরি। কিন্তু সরকারি চাকরি পাওয়া সহজ নয়। জনমানসে আবার সহজ সরল ধারণা, যোগাযোগ থাকলে চাকরি পাওয়া সহজ। আর ঠিকমতো জায়গায় টাকা দিলেও চাকরি কেনা যায়।

এই সরল বিশ্বাসে ভর করে দেবব্রত টাকা দিয়েছিল এক গোঁসাইকে। গোঁসাই বলেছিলেন, তার আশ্রম কৃষ্ণনগরের দিকে। মালদা জেলার হবিবপুর ব্লকে অনেক ভক্ত বানিয়েছিলেন। ভক্তদের বাড়িতে এসে উনি উঠতেন, ভক্তদের সেবা নিতেন, ভালো-মন্দ আহার করতেন। কথাবার্তার মাঝে উল্লেখ করতেন তার সব নামকরা ভক্তদের কথা। কেউ রেলের বড় অফিসার, কেউ খাদ্য দপ্তরের নিয়ন্ত্রক, কেউ স্বাস্থ্য দপ্তরের মাথা। এদের কলমের ডগার চাকরি বাঁধা।

একে তো গোঁসাই মানুষ, তার ওপর এমন সব প্রভাবশালী শিষ্য। গোস্বামী বাবা নিশ্চয়ই পারবেন একটা চাকরির হিল্লে করতে। ভক্ত তো এক নয়— অনেক। তাই অনেকে অর্থ নিয়ে হত্যে দিলেন গোঁসাইবাবার চরণে। সবার কাছ থেকে টাকাগুলো সংগ্রহ করে, একদিন চলে এলেন কৃষ্ণনগর। কলকাতায় গিয়ে যোগাযোগগুলো সেরে ফেলতে হবে।

তারপর গোঁসাইবাবার মোবাইল সুইচড অফ। কৃষ্ণনগরে আশ্রম খুঁজে পাওয়া গেল না।

টাকা দেওয়ার আগে দেবব্রত তার এক পরিচিত বন্ধুর সঙ্গে কথা বলেছিল, টাকা দেবে কিনা জানতে চেয়েছিল। সেই বন্ধু বলেছিল, “দ্যাখ, টাকা দিয়ে যতজনের চাকরি হয়, টাকা দিয়ে চাকরি হয় না তার থেকে বেশি জনের। আমি বলব টাকা দিস না। তবে তোর পাশের বাড়ি ছেলেটা টাকা দিয়ে চাকরি পেয়ে গেলে তখন বলবি, তোমার কথা শুনে টাকা দিলাম না, দিলে রেলের চাকরিটা হয়ে যেত। এজন্য এই ব্যাপারে তোকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আর একটা কথা বলতে পারি, যে লোকটাকে টাকা দিবি, সে কি তোদের চেনাশোনা? যদি চেনাশোনা হয়, ভেবে দেখতে পারিস। কারণ, চাকরি না হলে টাকা আদায়ের সুযোগ থাকবে। এছাড়া সত্যি কি এর আগে কেউ ওর মাধ্যমে চাকরি পেয়েছে? সেরকম হলে তার সঙ্গে কথা বলতে পারিস। সে হয়তো স্বীকার না-ও করতে পারে। তবুও একটা আন্দাজ পাওয়া যাবে।”

কিন্তু লোভাতুর মন এত যুক্তি মানেনি। দেবব্রতর রেলের চাকরিও হয়নি। মাঝখান দিয়ে কয়েক লক্ষ টাকা গোঁসাইয়ের ভোগে গেছে। গোঁসাই যে কোথায় ভেগেছে, তার এখনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। কিন্তু যে ক্ষেত্রে খোঁজ পাওয়া যায় বা পরিচিত লোকই চাকরি দেওয়ার নাম করে টাকা নেন; তার কাছ থেকেও টাকা আদায় করা সহজ নয়। বেশি তাগাদা দিলে তিনি উল্টে তাগাদাকারীদের বিরুদ্ধে মামলাও ঠুকে দেন। এরকমই এক প্রতারকের গল্প পরের পর্বে বলি।

(ক্রমশ)

অলংকরণ-রাতুল চন্দরায়

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here