সুখেন্দু হীরা

(আইপিএস সুখেন্দু হীরা বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল (নিরাপত্তা)। প্রতারণার নানা কাহিনি ধারাবাহিক ভাবে তিনি তুলে ধরছেন বালিহাঁস-এর পাতায়।)

ছেলেবেলায় প্রতারণার একটি কৌশল দেখেছিলাম। ছেলেবেলা না বলে সেটা কিশোরবেলা বলা ভালো। কিশোরবেলায় আমরা যেখানে থাকতাম সেখানে একটা টাকা বিনিয়োগ করার প্রকল্প এল। কোম্পানির নাম মনে নেই। আপনাকে ২৫ টাকা দিয়ে সদস্যপদ নিতে হবে। তারপর আপনাকে চারজন সদস্য জোগাড় করতে হবে। ওই চারজনও ২৫ টাকা দিয়ে সদস্য হবেন। চারজন সদস্য হলেই চারজনের কাছ থেকে পাঁচ টাকা করে কমিশন অর্থাৎ কুড়ি টাকা পেয়ে যাবেন।

ওই চারজন যখন আরও চারজন করে ষোলজন যোগাড় করবে তখন ষোলজনের কাছ থেকে এক টাকা করে কমিশন অর্থাৎ ষোলটাকা পাব। আগের কুড়ি টাকা আর এই ১৬ টাকা যোগ করলে মোট ৩৬ টাকা পেয়ে গেলাম। অর্থাৎ ২৫ টাকা লাগিয়ে ৩৬ টাকা প্রাপ্তি; মানে ১১ টাকা লাভ। আবার যখন ওই ১৬ জন আরও চারজন করে মোট ৬৪ জন জোগাড় করবে তখন আমি পেয়ে যাব ৬৪ টাকা বা কোনও একটা ভগ্নাংশ টাকা। সেটাও কম নয় এবং সেটা পুরোটাই আমার লাভ। এই স্কিমের সর্বোচ্চ শিখরে যিনি বসে আছেন, তিনি কত টাকা মুনাফা করছেন।

আপাতদৃষ্টিতে এটা খুব লাভজনক বিনিয়োগ। কিন্তু আমার ক্ষুদ্র মাথায় একটা প্রশ্ন এল, এ ভাবে কতদিন চলবে? এ ভাবে চার গুণিতক করে এগিয়ে চললে একসময় তো আর ২৫ টাকা দিয়ে সদস্য হবার লোক পাওয়া যাবে না। আমার এক বন্ধু, যার বাবা এই স্কিমটা আমাদের পাড়ায় নিয়ে এসেছিলেন, সে বলল, “ভারতবর্ষের লোক সংখ্যা আশি কোটির বেশি। তার উপর দিন দিন লোক সংখ্যা বাড়ছে। তাই লোকের অভাব হবে না”।

কিন্তু আমার বার বার মনে হচ্ছিল শেষের ধাপের লোকেরা লোক পাবে কোথায়? তার ওপর টাকাটা কোনও শিল্পে বা ব্যবসায় বিনিয়োগ হচ্ছে না, একজনের কাছ থেকে অন্য জনকে দেওয়া হচ্ছে। আমার আশঙ্কাই সত্যি বলে প্রমাণিত হল। কিছুদিন পর স্কিমটা বন্ধ হয়ে গেল। কারণ, নতুন করে আর সদস্য পাওয়া যাচ্ছে না। মাঝখান থেকে যাঁরা প্রথম দিকে এই প্রকল্পে নাম লিখিয়েছিলেন তাঁরা বেশ মুনাফা করলেন। আর যাঁরা শেষ দিকে সদস্য হলেন, তাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হলেন। অনেকের পুরো ২৫ টাকা মার গেল। এর মধ্যে আমার পিতৃদেবও ছিলেন।

বাবাকে বাবার এক বন্ধু সদস্য করিয়েছিলেন। পিতা আর কাউকে সদস্য করাতে পারেননি। বাবা সেই সদস্য পত্রটি বিছানার নীচে লুকিয়ে রেখেছিলেন। আমার গোয়েন্দাগিরিতে সেটা প্রকাশিত হয়। আমি বাহাদুরি নিতে মায়ের কানে কথাটা তুলি। ব্যস! বাড়িতে তুলকালাম। সেদিন বাবার করুণ, নিশ্চুপ মুখের কথা মনে পড়লে, আমার অনুশোচনা হয়। আমি না বললেই পারতাম।

পরে জেনেছি এই স্কিমের নাম— পঞ্জি স্কিম। এটা হল এক ধরনের প্রতারণা, যা বিনিয়োগকারীদের প্রলুব্ধ করে এবং নতুন বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে তহবিল নিয়ে আগের বিনিয়োগকারীদের মুনাফা প্রদান করা হয়। ইতালীয় ব্যবসায়ী চার্লস পঞ্জির নাম অনুসারে এই প্রতারণা ধরনের নাম হয়েছে পঞ্জি স্কিম। ১৯২০-র দশকে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে এই স্কিমটি চার্লস পঞ্জি চালান। তিনি এত বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেছিলেন যে, তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সুপরিচিত হয়ে ওঠেন।

যখন নতুন বিনিয়োগকারী জোগাড় করা কঠিন হয়ে পড়ে তখন এই স্কিমটি ভেঙে যায়। স্কিমের অপারেটর ফান্ডের টাকা নিয়ে গা ঢাকা দেয়। যাঁরা পরের দিকে বিনিয়োগ করেন তাঁরা পুরো বা আংশিক বিনিয়োগের অর্থ হারান। অনেক ক্ষেত্রে ক্ষতির পরিমাণ সামান্য টাকা হওয়ার জন্য বিনিয়োগকারীরা অভিযোগ জানান না। অভিযোগ জানালে কোথায় জানাবেন, সেটাও বুঝে উঠতে পারেন না। স্কিম পরিচালকদের অফিসও হাওয়া হয়ে যায় স্কিম উঠে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে।

পরবর্তীকালে দেখেছি এই স্কিম ভিন্ন ভিন্ন রূপে এসেছে। তার মধ্যে একটা হল, কোনও কোম্পানির প্রোডাক্ট বিক্রি করা। একটা ন্যূনতম মূল্যের সেই উৎপাদকের দ্রব্য কিনে আমায় সদস্য হতে হবে। তারপর আমাকে চার থেকে ছয় জন গ্রহীতা তথা বিনিয়োগকারী জোগাড় করতে হবে। তাঁরাও এই ন্যূনতম অর্থ বিনিয়োগ করে প্রোডাক্ট কিনবেন। এই চার বা ছয়জনের কাছ থেকে পাঁচ শতাংশ হারে মুনাফা পাবো। এক্ষেত্রে একটা সুবিধা আছে বিনিয়োগকারীরা যদি নতুন সদস্য জোগাড় করতে না-ও পারেন, তাহলেও তিনি যদি প্রতি মাসে কোম্পানির দ্রব্যগুলি কেনেন তা হলে তাঁর নিয়োগকারী মুনাফা পেতে থাকবেন। আর প্রত্যেক পরিবারে নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্য তো লাগেই, সেই জিনিসগুলো এই স্কিমের মাধ্যমে কেনা যায় বলে, সহজে লোকে এই স্কিমে আকৃষ্ট হন।

অনেকে বলবেন, এর মধ্যে প্রতারণা কোথায়? এক কোম্পানি প্রথমে তার শর্ত জানিয়ে দিয়েছেন, পছন্দ না হলে আপনি সদস্য হবেন না। তার ওপর এ ক্ষেত্রে শুধু টাকা নেওয়া হচ্ছে না; তার বিনিময়ে পণ্য দেওয়া হচ্ছে। তবে এ ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীর নিয়োগ পদ্ধতিটা পঞ্জি স্কিমের মতো। আর সংজ্ঞা অনুযায়ী পঞ্জি স্কিম একটা প্রতারণা, যারা এই স্কিম পরিচালনা করেন, তারা অবশ্যই প্রতারক। বাকিটা বিনিয়োগকারীদের বিবেচনার বিষয়।
এই স্কিমের মাধ্যমে প্রতারিত হলে The Chit Funds Act,1982 বা প্রচলিত দণ্ডবিধির প্রতারণা ধারায় মামলা করা যেতে পারে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতির বিষয়টি অর্থাৎ বিনিয়োগের রিটার্ন নিয়ে ধোঁয়াশা থাকায় যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া একটু কঠিন হয়ে যায়। তাছাড়া, সব ক্ষেত্রে যথার্থ সার্টিফিকেট না থাকায় প্রতারণা প্রমাণ করা শক্ত। ফলে আইনের এই ফাঁক গলে চার্লস পঞ্জির মতো লোকজন সহজে পার পেয়ে যায়।

(ক্রমশ)

অলংকরণ-রাতুল চন্দরায়