শুধু জল, জল আর জল। যেদিকে তাকাই কোনও প্রান্তর খালি নেই। সহস্র-লক্ষ অসহায় মানুষের আর্তনাদ ও হাহাকার । পাশাপাশি আশ্রয়হীন অসংখ্য গবাদি পশু ও বন্য জীবজন্তু জানোয়ারের বিপন্ন বিস্ময় । তাদেরই মাঝে চারপাশে নিঃশব্দে বোবার মতো দাঁড়িয়ে গাছগাছালি আর ঝাপসা আকাশ… দূর-দূরান্তে মেঘবৃষ্টিভরা গুরুগম্ভীর পাহাড়।

বিগত দু’সপ্তাহ কিংবা তারও বেশি সময় ধরে অসম জুড়ে এমনই ছবি প্রকৃতিতে। এ-বছর মরসুমের আগেই লাগাতার ব্যাপক বর্ষণের ফলে ব্রহ্মপুত্র-সহ অন্যান্য শাখানদীর জলস্তর বৃদ্ধির ফলে নামনি ও উজান অসম প্লাবিত। গত কয়েক দিনে বন্যা পরিস্থিতি জটিল থেকে জটিলতর হয়ে পড়ায় বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের দুর্গতি ও দুর্দশা চরমে উঠেছে। সহায় সম্বলহীন অসংখ্য মানুষ জীবনরক্ষা করতে আশপাশের উঁচু জায়গায়, জাতীয় সড়কের উপরে, খোলা আকাশের নীচে আশ্রয় নিয়েছেন।
প্রশাসন ব্যবস্থা নিতে নিতে বন্যা পরিস্থিতি আরও গুরুতর আকার ধারণ করেছে। প্রবল বর্ষণের জেরে পাহাড়ে ধস, নদীর ভাঙন আর একাধিক নদীবাঁধ ভেঙে জলপ্রলয় ঘটায় আমজনতা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। জেলা ও মহকুমা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কিছু কিছু জায়গায় অস্থায়ী আশ্রয় শিবির খুলে দেওয়া হয়েছে ঠিকই। তবে সেখানে সিংহভাগের আশ্রয় মেলেনি। স্বাভাবিক ভাবেই অসংখ্য মানুষ জলবন্দি হয়ে আর্ধাহার, অনাহারে বিদ্যুৎসংযোগহীন অবস্থায় অন্ধকারে দিন কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন।
অসমে এই মুহূর্তে ২৫টি জেলার ২৯ লক্ষ মানুষ বন্যার কবলে। ৫৫১টি ত্রাণশিবিরে ৩,০৫,৫৬৫ জন মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। প্রায় ৭৬ লক্ষ হেক্টর কৃষিজমি এখনও জলের তলায়। সাড়ে চার হাজারেরও বেশি গবাদি পশু ভেসে গিয়েছে। একাধিক জাতীয় সড়ক-সহ অন্ততপক্ষে দেড়শো মূল সড়ক ও ৫টি সেতু বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে । বন্যা ও ভূমিস্খলনে এপর্যন্ত ১৫৯ জনের প্রাণহানি ঘটেছে।

অসমে প্রতিবছরই বন্যার কবলে পড়েন স্থানীয় বাসিন্দারা— বিশেষত গ্রামাঞ্চল, নদীতীরবর্তী ও চর অঞ্চলের মানুষজন। বৃষ্টি,ভাঙন,পাহাড়ে ধস এখানে নতুন নয়। বছর বছর প্রকৃতির এই তাণ্ডবের শিকারও হন লক্ষ লক্ষ মানুষ। তবে স্বাধীনতা -পরবর্তীকালে অসম এত বড় বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে বলে মনে হয় না। বিশেষত কাছাড় জেলার শিলচর শহরে যে বিপর্যয় ঘটেছে, তা নজিরবিহীন। ১২ দিন যাবৎ গোটা শিলচর বন্যায় ভাসছে। বেতুকান্দিতে দুষ্কৃতীদের বাঁধ কাটার ফলে ২০ জুন রাত থেকেই শহরে দুর্বার গতিতে জল ঢুকতে শুরু করে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই অপ্রতিরোধ্য জলস্রোতে রাতারাতি ডুবে যায় রাঙিরখাড়ি, বিলপার, সুভাষ নগর, চার্চ রোড, পাবলিক স্কুল রোড, এন এস এভিনিউ,চেঙকুড়ি,আশ্রম রোড, মেহেরপুর, ইটখোলা, মালুগ্রাম,তারাপুর,অম্বিকাপট্টি, প্রেমতলা, রংপুর রোড, বিবেকানন্দ রোড-সহ আশপাশের বিস্তীর্ণ এলাকা। জলপ্লাবণের এমন আগ্রাসী রূপ এলাকাবাসী আগে কখনও দেখেননি। দিশেহারা লোকজন বিকল্প কিছু চিন্তা করার আগেই বারো, চব্বিশ, আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে জলস্রোত গ্রাস করে বাজার, অলিগলি, একতলা ঘরবাড়ি। বিদ্যুৎ,টেলিফোন ও সার্বিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন। পুরো শিলচরে কোথাও হাঁটু, কোথাও কোমর ছাড়িয়ে বুক অবধি জল । একটু দেরিতে হলেও পরিস্থিতি সামাল দিতে এনডিআরএফ, এসডিআরএফ কর্মীরা উদ্ধারে নেমে পড়েছেন । তাদের পাশাপাশি ঐক্যবদ্ধ ভাবে ত্রাণকার্যে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন স্থানীয় সাহসী উদ্যোগী লোকেরাও। কোনও কোনও এলাকায় দু-তলা, তিনতলা বাড়ি কিংবা ফ্ল্যাটের ভিতরে আটকে বহু আবাসিক। অবর্ণনীয় কষ্টের মধ্যে দিন কাটছে তাঁদের। অসুস্থ ও পীড়িত মানুষদেরও অনিশ্চিত অবস্থায় জলবন্দি কাটাতে হচ্ছে। ওই সময় যাদের মৃত্যু হয়েছে ,তাদের অনেকেরই অন্তিম সৎকার করার জায়গা পর্যন্ত মেলেনি। দুর্গত শিশু, মহিলা ও প্রবীণ নাগরিকদের অনেককে জানালা ভেঙে, ধরাধরি করে বের করেন উদ্ধারকর্মীরা। এমনই একজন লিংক রোডের অন্নদাচরণ চক্রবর্তী (৯২)। যে ভাবে তাকে একাধিকবার শিফটকরে নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দেওয়া হয় তাতে তিনি যেন নতুন জীবন ফিরে পান। তাঁর পারিবারিক সূত্রে এ খবর জানা গিয়েছে।

বিপর্যয় সামলাতে স্থানীয় একধিক ক্লাব, এনজিও ও যুব সংগঠনের ভূমিকা সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশ্যে এসেছে। শিলচরে বন্যার্তদের সেবায় বিরামহীন ভাবে
সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে রামকৃষ্ণ মিশন, ভারত সেবাশ্রম-সহ অযাচক আশ্রম, শিব সংঘ, নেতাজি যুব ছাত্র সংস্থা, মারোয়ারি মহিলা সংগঠন, বিবেকানন্দ পাট মন্দির, জেমস সোসাইটি, খালসা গ্রুপ,মানবকুসুম বিতান ট্রাস্ট, বুলেট ক্লাব, রাইডিং ক্লাব, খোঁজ-এর মতো ৫০টিরও বেশি সংগঠন। প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতাকে ঠেলে সরিয়ে প্রতিবেশী রাজ্য ত্রিপুরার ধর্মনগর থেকে পাঁচ যুবকের একটি দল ছ ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে শিলচরে পৌঁছে ৩০০টি খাবারের প্যাকেট ও ১১০০ লিটার পানীয় জল বিতরণ করেছেন । স্থানীয় মিজো সগঠনের কর্মীদেরও ত্রাণকার্যে সক্রিয় অংশ নিতে দেখা যাচ্ছে। অন্যদিকে, নবগঠিত বাংলা সাহিত্য সভা,অসম-এর উদ্যোগে সভার শিলচর শাখা ইচ্ছেডানা ক্লাবের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে ৩ জুলাই শহরে এক স্বাস্থ্য পরীক্ষা শিবিরের আয়োজন করতে চলেছে। শুক্রবার সভার সদস্যরা নাগরিকদের মধ্যে ফিনাইল ও ব্লিচিং পাউডার বিতরণ করেন।

বরাক উপত্যকার অন্য দুটি জেলা করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দিও বন্যায় বিপর্যস্ত। ওই অঞ্চলেরও হাজার হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। কুশিয়ারার জল এখনও বিপদসীমার উপর দিয়ে বইছে। মুখ্যমন্ত্রী হিমন্তবিশ্ব শর্মা শুক্রবার তৃতীয়বার বরাকের বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শন করে পরিস্থিতি খতিয়ে দেখেছেন। করিমগঞ্জে দু’টি আশ্রয় শিবিরেও যান তিনি।
এর আগে শিলচর সফরে এসে হিমন্ত নজিরবিহীন বন্যার নেপথ্যে জড়িত ষড়যন্ত্রকারী দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন। দুষ্কৃতীদের হাতে বেতুকান্দির কাটা বাঁধ মেরামতির কাজ ইতিমধ্যে জোরকদমে এগিয়ে চলেছে জেলাশাসকের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে।

শিলচর শহরে কিছু এলাকায় জমা জল সামান্য কমতে শুরু করলেও বেশিরভাগ রাস্তা, অলিগলি ডুবে রয়েছে। কোথাও বা জল নেমে গেলেও জমে থাকা কাদামাটি ও দুর্গন্ধময় আবর্জনায় রোগ সংক্রমণ শুরু হয়ে গিয়েছে। সরকার স্বীকার করেছে , এবারের বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত জেলা হল কাছাড়। ক্ষতিগ্রস্তদের প্রায় অর্ধেক মানুষই এই জেলার বাসিন্দা। মোট ১৪,৩১,৬৫২ জন। পরবর্তী স্থানে আছে নগাও (৫,১৯,৪৬৩)। তালিকায় তৃতীয় স্থানে রয়েছে বরপেটা (৪,০০,৫৯২)।