পর্ব ১২

(আইপিএস সুখেন্দু হীরা বর্তমানে কলকাতা পুলিশের ডেপুটি কমিশনার (DCP)। নারী পাচার নিয়ে ধারাবাহিক ভাবে লিখছেন বালিহাঁস-এর পাতায়।)

           বৈদিক যুগে শাস্ত্রচর্চা, ধর্মানুষ্ঠান ইত্যাদিতে পুরুষের সঙ্গে সঙ্গে নারীর সমান অধিকার ছিল। কিন্তু সম্পত্তিতে অধিকারের ব্যাপারে পরিষ্কার করে কোথাও বলা নেই। তবে এটা ঠিক আর্থিক স্বাধীনতা সবচেয়ে বড় স্বাধীনতা। যেহেতু বৈদিক যুগে নারীরা অনেক স্বাধীন ছিলেন বা বলা যেতে পারে স্বাধীন ভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন, তাই ধরা যেতে পারে তাদের আর্থিক স্বাধীনতা ছিল। আর্থিক স্বাধীনতা আসে দুই ভাবে। এক, সম্পত্তির আয় থেকে অথবা নিজে উপার্জনশীল হলে। আর সম্পত্তি থেকে আয় আসবে সম্পত্তির ওপর অধিকার থাকলে।

         স্মৃতির যুগে তো মহিলাদের সম্পত্তির অধিকারের ব্যাপারে প্রশ্নই নেই। মনু তো কড়া করে বলে দিয়েছিলেন, “পিতার কর্তব্য কন্যাকে সৎপাত্রে দান করা, যতদিন না হচ্ছে তাকে সর্বতো ভাবে রক্ষা করা। বিবাহিতা নারী স্বামীর দ্বারা এবং বৃদ্ধা অবস্থায় পুত্রের দ্বারা রক্ষনীয়া হয়।” নারীকে রক্ষা করার জন্য কোনও না কোনও স্তরে একজন পুরুষ রয়েছে, তাই তাঁর কোনও সম্পত্তির প্রয়োজন নেই। কিন্তু মনু ‘স্ত্রীধন’-এর ব্যাপারে বলেছেন। এবং তাতে একমাত্র মেয়েদেরই অধিকার থাকবে। তিনি বলেছেন, বিবাহে প্রাপ্ত উপহার, বিবাহের পরে পিতৃগৃহ থেকে শ্বশুরালয়ে যাবার সময় প্রাপ্ত উপহার এবং স্বামী বা অন্যান্য কোনও ব্যক্তির প্রদত্ত দ্রব্য হল ‘স্ত্রীধন’। এই সব স্ত্রীধনের ওপর একমাত্র বিবাহিতা নারীর অধিকার রয়েছে। বিবাহিতা নারীর মৃত্যু হলে যাবতীয় স্ত্রীধন তার কন্যা এবং সেই কন্যার অবর্তমানে কন্যার সন্তানেরা পাবে। বিধবাদের ক্ষেত্রে বলেছেন, পতির মৃত্যুর পর বিধবা স্ত্রী ফলমূল আহার করে ব্রহ্মচর্য পালন করবেন। এই ফলমূল কোথা থেকে আসবে বলা নেই। ধরে নেওয়া হয় পরিবারের কেউ না কেউ ফলমূল দিয়ে এটুকু দয়া করবেন। এর জন্য আলাদা করে কোনও সম্পদের বন্দোবস্ত করার প্রয়োজন নেই।

প্রাচীন কালের ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, পুত্রের অভাবে ভ্রাতা উত্তরাধিকারী হবেন এবং বিধবা স্ত্রী কেবল গ্রাসাচ্ছনের অধিকারিনী হবেন। পুরাণে সেভাবে নারীদের সম্পদ অধিকারের কথা বলা নেই। বরং বৃহদ্বর্ম পুরাণে সহমরণের ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে। সহমরণ মানে স্ত্রীকে স্বামীর সম্পত্তির দাবি থেকে চিরতরে সরিয়ে দেওয়া। কারণ, পরবর্তীকালে সহমরণ থেকে সতীদাহ প্রথার উত্তরণ। অর্থাৎ বিধবা নারীদের ন্যূনতম সম্পত্তির অধিকার অর্থাৎ খাওয়া-পরার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত করা হল।

মধ্যযুগের বাংলার ইতিহাসে দেখা গেল— উত্তরাধিকার সূত্রে পতির সম্পত্তিতে স্ত্রীর অধিকার জন্মাল বটে, তা কেবলমাত্র ভোগের অধিকার। দান ও বিক্রয়ের অধিকার পেল না। এই অধিকার দিলেন জীমূত বাহন। জীমূত বাহন ছিলেন প্রাচীন বঙ্গদেশের একজন সুবিখ্যাত ধর্মশাস্ত্র রচয়িতা। তাঁর রচিত কালবিবেক, ব্যবহার মাতৃকা ও দায়ভাগ বাঙালির ধর্মীয় জীবনে ও ব্যবহারিক জীবনে আইন-কানুন। ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায়ের মতে, জীমূত বাহন দ্বাদশ বা ত্রয়োদশ শতকে জীবিত ছিলেন। বিশেষজ্ঞরা বলেন, এই ‘দায়ভাগ’ বঙ্গদেশে সতীদাহ প্রথার রমরমার অন্যতম কারণ। দায়ভাগ আইনে বাংলার নিঃসন্তান বিধবারাও সম্পত্তির অধিকারী হতেন। তাই স্বজনেরা সম্পত্তির লোভে বিধবাদের ঠেলে দিত স্বামীর চিতায়।

তবে  ইসলামধর্ম নারীকে কিছু সম্পত্তির অধিকার দিল। যা আগের কোনও পিতৃতান্ত্রিক ধর্ম দেয়নি। যদিও অনেক সমাজবিদদের মন্তব্য, মুসলিম দেশগুলিতেই নারী সবচেয়ে শৃঙ্খলিত। যাই হোক, আইনগত ভাবে কোন ধর্ম নারীকে সম্পত্তির অধিকার দিল। ইসলাম ধর্মের সূচনা খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতকে বলা যেতে পারে। বর্তমানে অবশ্য হিন্দু উত্তরাধিকার আইন (১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দ) অনুযায়ী, উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পত্তিতে উত্তরাধিকারীদের সবার সমান অধিকার। এই উত্তরাধিকারী ঠিক হয় বর্তমানে পরিবার (Family) সংজ্ঞা অনুযায়ী। সহজ ভাবে একটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে— কোনও ব্যক্তি মারা গেলে তার সম্পত্তির ভাগ হবে তার স্ত্রী, পুত্র, কন্যাদের মধ্যে সমভাগে।

মৌর্যযুগে ও গুপ্তযুগে নগরবধুদের সম্পত্তি ছিল। সেই সম্পদের জন্য তাঁরা রাষ্ট্রকে কর দিতেন। সেই সম্পদ তাঁরা দান করতেন। যেমন আম্রপালী গৌতম বুদ্ধকে তাঁর আমবাগান দান করেছিলেন। আধুনিক যুগেও সেই ঐতিহ্য দেখতে পাই। পুরুলিয়া জেলায় মনি বাঈজী পুরুলিয়া শহরের চকবাজারে শ্রী শ্রী রাধা গোবিন্দ জীউড় মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন এবং তার রথ প্রচলন করেছিলেন। কলকাতার স্টার থিয়েটার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নটী বিনোদিনী দাসীর অবদান কে ভুলতে পারবে?

যুগে যুগে নারীকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। তাই নারীরা যখন অভিভাবক হারা হয়েছেন, তখন তাঁদের পতিতাপল্লীতে আশ্রয় খুঁজতে হয়েছে। বর্তমানকালেও এই চিত্র খুব উজ্জ্বল হয়নি। আজও বিবাহ হয়ে গেলে পিতার সম্পত্তি থেকে মেয়েদের বঞ্চিত করা হয়। সেভাবে উইল হয়। বলা হয়, দাদা বা ভাইয়ের চলবে কী করে? স্বামী মারা গেলে অনেকক্ষেত্রে স্বামীর ভাই-দাদারা ছলে বলে কৌশলে চেষ্টা করেন পতির সম্পত্তি থেকে স্ত্রীকে বঞ্চিত করার। স্ত্রী যদি কোনও সম্পত্তি উপার্জন করেন, সেই সম্পদে স্বামী প্রভুত্ব ফলায়। সম্প্রতি (০২.০৬.২০২২) আনন্দবাজার পত্রিকাতে একটি নিবন্ধ বেরিয়েছিল, তাতে লেখিকা (খাদিজা বানু) বলেছেন, “বহু বিবাহ, অবৈধ তালাক, ঘর থেকে বহিষ্কৃত ও বিধবা মেয়েদের সম্পত্তি বঞ্চনার জন্য মেয়েদের বিপন্নতা বাড়ছে, সহজে পাচারের শিকার হচ্ছে।”

তথ্যসূত্র:

১. মনুসংহিতা- সম্পাদনা ও ভাষান্তর- চৈতালী দত্ত- নবপত্র প্রকাশন।

২. বাংলাদেশের ইতিহাস (১ ম খণ্ড, ২ য় খণ্ড) – শ্রী রমেশচন্দ্র মজুমদার।

৩. বাঙ্গালীর ইতিহাস (আদি পর্ব) – নীহাররঞ্জন রায়।

৪. নারী – হুমায়ুন আজাদ (আগামী প্রকাশনী, বাংলাদেশ)।