সকাল এগারোটার মধ্যেই কাগজপত্তর তৈরি। চারটে গাড়ি নিয়ে দল বেঁধে সবাই কোর্ট চত্বরে। প্রতিটি গাড়িতে একজন করে, অনাহুত অতিথিদের পিছনের সিটে, মাঝখানে বসিয়ে, দুপাশে দু’জন করে সেপাই। আজকাল হাতকড়ি লাগানো নিষেধ। দড়ি দিয়ে বেঁধে, নিয়ে যাওয়ার যে সব দৃশ্য সিনেমায় দেখায়, সেই সিস্টেমে নিলে, অফিসারের কপালে দুঃখ আছে।

তাছাড়া , সেশন জজের একটু কড়া বলে সুনাম অথবা দুর্নাম আছে এই জেলা শহরে, অফিসার মহলে। গিয়ে জানা গেল, সাহেব শরীর ভাল নয় বলে এজলাসে বসেননি। কিন্তু জরুরি ব্যাপার হলে বাড়িতেই শুনানি নেবেন।

ব্যাপারটা কিন্তু জরুরি। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে কোর্টে হাজির করাতেই হয়, অ্যারেস্ট করলে। কোর্টে সরকারি উকিল থাকেন। তাদের দফতরের জন্যেও নির্দিষ্ট উকিল আছেন। তাকে সকালেই গিয়ে কাগজপত্তর বোঝানো হয়েছিল। বিশ্বরূপদাই বুঝিয়েছেন। কিন্তু এখন উপায়?

ড্রাগস কেস। মহা ঝামেলার ব্যাপার। প্রচন্ড কড়া আইন। তার নিয়মবিধি। একটু এদিক সেদিক হলেই গলায় ফাঁস হয়ে ঝুলতে পারে অফিসারের।

বাড়িতেই যেতে হয়। সব জজদেরই বাড়িতে একটা অফিস থাকে। জরুরি বিষয় যে কোনও সময় আসতে পারে, সে জন্যই এই ব্যবস্থা। সেই হিসেবে, বিচারকরা চব্বিশ ঘণ্টা ধরেই বিচারক হিসেবে থাকেন।

বাড়ির সামনে বেশ জায়গা। সরকার বিচারকদের জন্যে নির্দিষ্ট বাসস্থানে বেশ প্রচুর খালি জায়গা রাখেন।

ভয়ে ভয়ে এত্তেলা পাঠালো ভেতরে। বাকি সবাই গাড়ির ভিতরে, অফিসাররা কাছেপিঠে হাঁটাহাটি। দরজায় দাঁড়িয়ে শুধু অমিত আর উকিলবাবু। একটা লোক বেরিয়ে, কি কাজ আর ডিপার্টমেন্ট জিজ্ঞেস করে ভিতরে চলে গেল। তার দশ মিনিট পর ডাক এলো। দু’জনকে যেতে বলেছেন।

ভিতরে একটি বসার ঘর। বেতের আসবাব। সেখানেই বসতে বলে, লোকটি ভিতরে গেল। একটু পরে জজসাহেব বেরিয়ে এলেন। দেখেই অসুস্থ লাগছে। হয়তো ইনফ্লুয়েঞ্জা। অমিতরা দু’জনেই দাঁড়িয়ে ছিল। বসার পর সেটাকে নজর করে দু’জনকেই বসতে বললেন।

তারপর মুখ উঠিয়ে তাকালেন। সেটাই জানতে চাওয়ার প্রশ্ন।

উকিলবাবু  প্রাথমিক একটু বলার পরই, অমিতকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘আপনি এই কেসটার প্রেসেনটিং অফিসার?’’

বড় অফিসার, উচ্চপদস্থ ব্যক্তি বিশেষের সামনে কথা বলার জন্য সাবঅর্ডিনেট কর্মীরা একটা বিশেষ ধরনের সুরে কথা বলতে শিখে যায়। সেই সুরেই অমিত জবাব দিল, “হ্যাঁ স্যার।”

– প্রায়র ইনফরমেশন ছিল?

সঙ্গে সঙ্গেই সতর্ক হয়ে গেল অমিত। কয়েকমাস আগেই একটা কেস ঘেঁটে গিয়েছিল এই কারণে। অন্য শহরে একটা লোক ধরা পড়েছিল হেরোইন নিয়ে। এমনিই রুটিন বাস চেকিং করতে গিয়ে। এসব ক্ষেত্রে অফিসারদের বিশেষ ক্রেডিট মেলে না। সুতরাং অনেক সময়ই কেস হিস্ট্রি লেখার সময়, লেখা হয়— বিশেষ সূত্রে গোপন খবর পাইয়া, সারা রাত জাগিয়া…

অন্য আইটেমের কেসে চলে যায়। কিন্তু ড্রাগস কেসে মিনিমাম সাজা দশ বছর জেল। তাছাড়া, বেল হয় না। তাই বিচারকরা ভাল করে খুঁটিয়ে দেখেন সব। বিপক্ষের উকিলরা প্রতিটি শব্দ,  চার্জশিট থেকে খুঁটিয়ে দেখে। একটু ফাঁক পেলেই…

সেই কেসে বিপক্ষের উকিল বলেছিল, এত আগে থেকেই যদি ইনফরমেশন ছিল, তাহলে সাক্ষী হিসেবে ক্রেডিটেবল মানুষ জোগাড় করা গেল না কেন? এই চায়ের দোকানের মালিক, যে অফিসে চা দেয়, সে-ই প্রধান সাক্ষী হলে সন্দেহ থেকেই যায়। বহুত ঝামেলা হয়েছিল সেই কেসে। নেহাত লোকটা ছুরি চালিয়ে দিয়েছিল বলে ঠেকানো গিয়েছিল কেসটা।

অমিত সোজাসুজি মাথা নাড়লো।

—”না স্যার। এমনি রাস্তায় চেকিং করতে গিয়ে ধরা পড়লো। “

জজসাহেব সোজা হয়ে বসলেন। বললেন, “সংক্ষেপে কেসটা বলুন।”

ওই বাজি রেখে তাস খেলার ব্যাপারটা বলা উচিত হবে না, ভেবে চেপে গেল অমিত। সঙ্গে কাল রাত্তিরের জলপানের ব্যাপারটা।

বাদবাকি পুরোটাই। মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন ভদ্রলোক। শেষ করার পর বললেন, ‘‘ওই হোটেল মালিককে কেন অ্যারেস্ট করলেন?’’

– ‘‘স্যার, আমাদের সন্দেহ ওর দোকান ছিল মিডল পয়েন্ট। গাড়ির চাবি এখানে জমা রেখে যেত প্রথম ড্রাইভিং টিম। ও তাদের টাকাটা দিয়ে দিত। দ্বিতীয় টিম এখান থেকে চাবি নিত সঙ্গে পথের খরচা।  সার্চ করে নগদ তিন লাখ তিরিশ হাজার টাকা পেয়েছি। ওর দোকানে যা জিনিস, সব মিলিয়ে তিরিশ হাজার টাকারও হবে না। এত টাকা কেন নগদে আছে, তার জবাব দিতে পারেনি।’’

–  ‘‘মালটা কোথা থেকে অরিজিনেট করেছে?’’

-‘‘ স্যার। পাশের পাহাড়ি রাজ্য থেকে। ওরা স্টেটমেন্ট দেওয়ার সময় জায়গা আর কয়েকটা নাম দিয়েছে। সেগুলো স্যার আমরা আমাদের ওখানকার অফিসকে জানিয়ে দিয়েছি সকালেই। ওখানে খোঁজ খবর নিচ্ছে।’’

– ‘‘ওই গাড়িটা?’’

– স্যার। ওটা সিজ করা হয়েছে। ওটারও পারমিশন চেয়েছি স্যার, পিটিশনে।

একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, “কি করেন গাড়ি সিজ হওয়ার পর?”

আজ অমিত প্রতিজ্ঞা করেই এসেছিল, একান্ত দরকার না হলে, মিথ্যে বলবেই না। কোনও কথা লুকোবে না।

সোজাসুজিই বলে দিল, ‘‘স্যার ওগুলো পড়ে থাকে। গ্যারেজ নেই। তাই বাইরেই খোলা থাকে। রোদে, জলে পড়ে পড়ে নষ্ট হয়। কেস ফায়সালা হতে হতে স্যার, পাঁচ সাত বছর লেগেই যায়। ততদিনে ওজন দরে বিক্রি করার স্টেজ এসে যায়।’’

ভদ্রলোক একটুক্ষণ চুপ করে কি যেন ভাবছেন। তারপর বললেন, ‘‘গাড়িটা থেকে রিকভারি করার সময় ভিডিও করেছেন?’’

– ‘‘না স্যার। ছবি তোলা হয়েছে অবশ্য।’’

– ‘‘ঠিক আছে। ওই খালি গাড়িটাকে নিয়ে প্রতিটি অ্যাঙ্গেল কাভার করে ভিডিও তুলবেন। তারপর ছবি আর ভিডিও একসঙ্গে করে, একটা সাবমিশন দেবেন কোর্টে তিনদিনের মধ্যে। ঠিক আছে? এই গাড়িটা এমন ভাবে নষ্ট হতে দেওয়া যায় না। ওটা বরং পৌরসভাকে দিয়ে দিলে হবে। ওরা ময়লা ফেলার কাজে ব্যবহার করুক। একটা নির্দিষ্ট টাকা প্রতিমাসে ভাড়া হিসেবে জমা থাকবে। গাড়ির মালিককে দেওয়া হবে, কেস মিটলে। আপত্তি আছে?’’

তড়িঘড়ি অমিত মাথা নাড়লো। কার ঘাড়ে কটা মাথা আছে, হাকিমের হুকুমের বিরুদ্ধে বলে। তাছাড়া, অফিসের বেশ জায়গা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে গাড়ি। স্কুটার পার্ক করতে সবার অসুবিধা হচ্ছে। ভালই হলো। তিনদিন পর যন্ত্রনা দূর হবে।

জজসাহেব আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘তা কি চাইছেন এখন?’’

– ‘‘স্যার, পাঁচদিনের কাস্টডি।’’

– ‘‘কেন?’’

– ‘‘স্যার, গাড়ির রেজিস্ট্রেশনের ডিটেইলস চেক করতে যেতে হবে। তাছাড়া কে মালটা কিনতে ওদেরকে এনগেজ করেছিল… কিছু রয়ে গেছে স্যার।’’

– ‘‘পাঁচদিন বেশি। তিনদিন দিচ্ছি। আর হ্যাঁ… ওদের মেডিক্যাল করানো হয়েছে?  ফিটনেস সার্টিফিকেট আছে?’’

– ‘‘হ্যাঁ স্যার। পিটিশনে মেডিক্যাল কলেজের ডাক্তার সাহেবের সার্টিফিকেট দিয়ে দিয়েছি। তাছাড়া ওদেরকে নিয়েও এসেছি।’’

ভদ্রলোক স্বস্তি নিয়ে মাথা নাড়লেন। বললেন, ‘‘ঠিক আছে। তা-ও একবার দেখে নেব। আর অর্ডার দিচ্ছি। কপি একটু পরে নিয়ে নেবেন অফিস থেকে। তিনদিন পর ফের কোর্টে হাজিরা দেবেন।’’

ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লো যেন অমিতের। ভাগ্গিস কাল বিভাসদাকে হাত তুলতে দেয়নি। একদম হাতেপায়ে ধরে আটকেছিল। বড্ড ক্ষেপে গিয়েছিলেন। ফিরে এসে বলেছিলেন, ” প্যাসেঞ্জার হারামজাদার সাহস চিন্তা কর। একই টেবিলে বসে মদ খাচ্ছে। আবার আমাকে জিজ্ঞেস করে, একটু দেব নাকি স্যার? ওকে আজ মেরেই ফেলবো। “

অফিসে ঢুকেই হঠাৎ রং পরিবর্তন দেখে দুটো লোকই ঘাবড়ে গিয়েছিল।

তারপর এই হুঙ্কার। ভয়ে কাঁপছিল ওরা।

আর ওদিকে বিভাসদার কথা শুনে হাসিতে গড়াগড়ি খাচ্ছিল ইউনিটের বাকি লোকেরা। মদ নিয়ে ওঁর এলার্জির কথা পাড়াশুদ্ধ সবাই জানে। বিশ্বরূপদা একবার মিহিসুরে টিপ্পনি কেটে বললেন, “অমিতের কিন্তু এটা ভারী অন্যায় হয়েছে। আমাদের নিয়ে গেলেই পারতো।”

গজ গজ করতে করতে বিভাসদা বললেন, “আরে ও কি এমনি নিয়ে গেছে আমাকে? জানে খাই না। তাই নিয়েছে। যাতে নিশ্চিন্তে নাটক করতে পারে। স্যাটিসফায়েড না হয়ে, ভরবে না। নে, এখন সঙ্গে আরও একটা লেজ জুটল।”

রাতে হাত তুলতে দেয়নি। সকালে  ভূষণের দোকান সার্চ করতে গিয়ে, মোটামুটি কালকের ঝাল অল্প মিটিয়েছেন। আজকে একটু দিতেই হবে।  তাছাড়া, অল্প সফট না করলে বাকি খবর পাওয়া যাবে না।

বাইরে বেরিয়ে অপেক্ষারত বাকিদের প্রগ্রেস রিপোর্ট দিয়ে দিল অমিত। তারপর বিভাসদা কে বলল, ‘‘তিনদিন কাস্টডি পেয়েছি। সাহেব কিন্তু কড়া। মেডিক্যাল করিয়ে জেল হাজতে পাঠাতে পারবো। আর খবর একটা খুব দরকার, কোথায় ফাইন্যাল যেত মালটা আর কে কিনেছে? দুদিন ভাল করে ঘুম হয়নি। আমি আজ আর ফিরছি না অফিসে। অব আপকে হাওয়ালে সব লোগ।”

(ক্রমশ)