(১৯৫৫ সালে ‘পথের পাঁচালী’ মুক্তি পাবার পর ছবিটি দেখার জন্য কমলকুমার মজুমদারকে বারবার অনুরোধ করেছিলেন সত্যজিৎ রায়। কিন্তু উৎসাহের সঞ্চার করতে পারেননি। শেষে যখন সিনেমাটি দেখলেন, সত্যজিতের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দিলেন কমলকুমার। সত্যজিতের পরিচিত একজনকে জানিয়ে ছিলেন, ছবিতে মাত্র একটি দৃশ্য তাঁর ভাল লেগেছে। প্রথমে অভিমান হলেও পরে সত্যজিৎ বলেছেন… “ততদিনে হৃদয়ঙ্গম করেছি, পল্লীগ্রামের জীবন নিয়ে ছবি করে কমলবাবুকে খুশি করার ক্ষমতা আমার নেই।” ১৯৭৯ সালে অর্ঘ্যকুসুম দত্তগুপ্ত সম্পাদিত ‘সমতট’ পত্রিকায় প্ৰকাশিত এই লেখাটিতে সেকথা নিজেই জানিয়েছিলেন সত্যজিৎ।)

বছর পাঁচেক আগে কোনো এক শ্রাদ্ধবাসরে কমলবাবুর সঙ্গে দেখা হয়। আগে প্রায় সাক্ষাত হত; কোনো একটা বিশেষ কারণে দীর্ঘকাল ছেদ পড়ে। ভদ্রলোককে দেখে অসুস্থ মনে হওয়াতে জিগ্যেস করলাম কী হয়েছে। বললেন হাপানি। তার জন্য কী করেন জিগ্যেস করতে বললেন, ‘রাত্তিরে জানালার শিক ধরে দাঁড়িয়ে থাকি।’ প্রশ্ন করলাম, ‘চিকিৎসে করান না ?? কমলবাবু বললেন, ‘নাঃ। সাফারিং-এর মধ্যে একটা গ্র্যাঞ্জর আছে।’

কথাটা অন্য কেউ বললে আদিখ্যেতা বলে মনে হত ; কিন্তু কমলবাবুকে যারা চিনতেন তারা বুঝবেন এ ধরনের কথা তাঁর মুখে মানিয়ে যেত। তিনি মানুষটা ছিলেন একটা বিশেষ ছাঁচে গড়া ; আর পাঁচ জনের সঙ্গে সে গড়নে বিশেষ মিল নেই। তাঁকে যে না চিনত, তার কাছে অল্প কথায় মানুষটাকে ফুটিয়ে তোলা আমার সাধ্যের বাইরে। আপাতবিরোধী এতগুলো দিক তাঁর চরিত্রের মধ্যে ছিল তেমন আর কোনো একজন মানুষের মধ্যে দেখিনি। নানান অসামান্য গুণের অধিকারী হয়েও, সেই সব গুণের বর্ণনা দিয়ে মানুষটাকে ফুটিয়ে তোলা যায় না। তাঁর শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্মে তিনি যে শুদ্ধতা, যে অসামান্য দরদ ও দীপ্তির পরিচয় দিয়েছেন; তাঁর নাট্যপ্রয়াসে যে সাবলীল ছন্দোময়তা ও নিটোল পারফেক্শনিজমের নজির রেখে গেছেন, দেশী-বিদেশী শিল্পকলা বিষয়ক প্রবন্ধে যে অগাধ পাণ্ডিত্য ও তীক্ষ্ণ অনুভূতির দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়, ব্যক্তিগত জীবনে তাঁর বেশভূষায় চলনে-বলনে এসবের সঙ্গে কোনো সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া মুশকিল হত। তিনি যেন অত্যন্ত সাধারণ ভাবেই একটি রুক্ষ, অমার্জিত, আটপৌরে চেহারায় নিজেকে সবার সামনে হাজির করতেন। তাঁর কথার মধ্যে তাঁর ব্যক্তিত্বের পরিচয় পাওয়া

যেত ঠিকই – সত্যি বলতে কি, বাকপটুতায় তাঁর সমকক্ষ কাউকে দেখিনি – কিন্তু প্রথম সাক্ষাতে সেই বাক্যের ধাক্কায় মানুষ টকে গেছে, এমন উদাহরণের অভাব নেই।

কমল মজুমদারের অনেক বাতিকের মধ্যে একটা বাতিক ছিল কাউকে না জানিয়ে অকস্মাৎ বাসা পরিবর্তন করা। সেই সব বাসস্থান সচরাচর এমন জায়গায় হত যে একান্ত উদ্যমশীল ব্যক্তি ছাড়া আর কারুর পক্ষে হঠাৎ সেখানে গিয়ে পড়াটা হত প্রায় অসম্ভব। একবার তার কিছুদিন আগেই কমলবাবু বিয়ে করেছেন কোনো একটা কারণে তাঁর বাড়িতে গিয়ে হাজির হতে হয়। গিয়ে দেখি দুটি ঘরের একটি ফ্ল্যাটবাড়ি। তার মধ্যে একটি ঘর সুপ্রশস্ত, অন্যটি অপরিসর। বড় ঘরে আসবাব বলতে একটি কাঠের টুল ও একটি কাঠের ডেস্ক। টুলের উপর একটি টেলিফোন। আর ডেস্কের উপর একটি অর্ধসমাপ্ত বিজ্ঞাপনের ছবি। বিজ্ঞাপনের বিষয় হল – ‘ছেলে ছাপ পেপারমিন্ট’। কমলবাবু যে এই ফাঁকে কবে ফ্রী-লান্স বিজ্ঞাপন শিল্পী হয়ে গেছেন সেটা জানা ছিল না। টেলিফোনটা অবশ্য বাড়িওয়ালার ; কিন্তু সেটা কেন কমলবাবুর ঘরে থাকবে সে-প্রশ্ন করে কোনো সন্তোষজনক উত্তর পাইনি। আশ্চর্য এই যে, এই পরিবেশে কমলবাবুর পক্ষে কেন জানি বেমানান মনে হয়নি।

কমলবাবুর সঙ্গে কবে এবং কোথায় প্রথম আলাপ হয় সেটা স্পষ্ট মনে পড়ে না। সম্ভবত ক্যালকাটা গ্রুপের একটি প্রদর্শনীতে। আমি তখন থাকি রাসবিহারী এভিনিউতে ত্রিকোণ পার্কের দক্ষিণে। আর কমলবাবু থাকেন পার্কের উল্টোদিকে সিডলি হাউসের এক তলায়। হেঁটে যাতায়াতে লাগে দু মিনিট। আমার বিশ্বাস আমার পিতৃপরিচয়ই কমলবাবুকে আমার প্রতি আকৃষ্ট করেছিল। উপেন্দ্রকিশোর সুকুমারের পরম ভক্ত ছিলেন তিনি। প্রায়ই সন্ধ্যায় আসতেন আড্ডা দিতে। একপেশে আড্ডা, কমলবাবু বক্তা, আমি শ্রোতা। লক্ষ্য করতাম কথার মধ্যে ফরাসী শব্দ এনে সেটা ফরাসী কায়দায় উচ্চারণ করতে পছন্দ করেন। একবার জিগ্যেস করলেন ‘তুর স্নেইফেলে’র কাছে একটা শিল্প সংগ্রহশালা আছে সেটা সম্বন্ধে জানি কিনা। তখন তাঁকে চেপে ধরতে বললেন বাড়ির গুরুজনদের দৃষ্টি এড়িয়ে তিনি নাকি বাড়িতেই খাটের তলায় ঢুকে ফরাসী শিক্ষা করেছেন। তাঁর চটের থলিতে যে একটা-না-একটা ফরাসী বই সব সময় থাকে সেটা লক্ষ্য করেছিলাম।

আলোচনা-বা মনোলগ – চলত প্রধানত আর্ট নিয়ে। আমি নন্দলাল, বিনোদের ছাত্র ছিলাম, এটা তাঁর চোখে আমাকে কিছুটা জাতে তুলেছিল। কমলবাবুকে তখন সমঝদার হিসেবেই জানি, স্রষ্টা হিসেবে নয় – যদিও এককালে তিনি নাকি ‘উষ্ণীশ’ নামে একটি পত্রিকা বার করতেন। এবং ‘শনৈঃ’ নামে নিজের কবিতার একটি সংকলন বার করেছিলেন। সে বই বা পত্রিকা চোখে দেখিনি।

আর্টের কথা বলতে গিয়ে তাঁর জ্ঞানের বাইরেও যে জিনিসটা মুগ্ধ করত সেটা হল তাঁর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা। আপাততুচ্ছ দৃশ্যের মধ্যে থেকেও তিনি যে সব ডিটেল আহরণ করতেন – যেটা পরে তাঁর লেখায় প্রকাশ পেয়েছিল—তা ছিল বিস্ময়কর। ক্যানিং-এর ঘাটের বর্ণনা দিতে গিয়ে অজস্র ডিটেলের মধ্যে নৌকার গায়ে আঁকা চোখ, নদীর অস্থির জলে তার প্রতিফলন, এবং সেই জল উছলে উঠে সেই চোখকে জলসিক্ত করার বর্ণনা ‘অন্তর্জলি-যাত্রা’র অন্তিম ইমেজ হিসেবে ব্যবহার করার বহু আগে আমি কমলবাবুর মুখে শুনি। তাঁর পরিবেশকে তিনি যেমন তীক্ষ্ণ অনুভূতির সঙ্গে দেখতেন, তেমনি দেখতেন কোনো শিল্পবস্তুকেও । একটি পেন্টিং-এর সমগ্র কাঠামো, এবং সেই সঙ্গে তুলির প্রতিটি টান যেন একই সঙ্গে যাচাই করতে পারতেন।

তখন আমি বিজ্ঞাপনের আপিসে কাজ করি, আর কাজের ফাঁকে ফিল্ম করার স্বপ্ন দেখি। কমলবাবু দেখলাম ফিল্মের ব্যাপারে শুধু উৎসাহী নন, যথেষ্ট ওয়াকিবহাল বটে। আদিযুগের বহু দিশি, বিলিতি ছবি তাঁর দেখা আছে এবং স্মরণে আছে। ‘ঘরে বাইরে’ ছবি করার পরিকল্পনা হচ্ছে জেনে কমলবাবু মেতে উঠলেন । চিত্রনাট্য লেখা হচ্ছে, আর কমলবাবু ডিটেল জুগিয়ে চলেছেন। তাঁর মতে নিখিলেশ একটি ‘ক্রাইস্ট-ফিগার’। ‘গ্রামের পথ দিয়ে যেতে যেতে একবার মাথাটাকে কাঁটা ডালে রুখে যেতে দিল। ক্রাউন অফ থর্নস।’ সন্দীপের কিশোর চেলা অমূল্য পুলিশের গুলি খেয়ে ঘাটের সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে পড়ল, পুকুরের জলে তার মাথা, দেহ সিড়ির ধাপে ; অকস্মাৎ শান্তিভঙ্গের ফলে অমূল্যর মাথার ভাসমান চুলের পাশে গেঁড়িগুগলি ভেসে উঠল।

কমলবাবুর নিজেরও ফিল্ম করার ইচ্ছে ছিল। সম্ভবত কোনো কোনো বিশেষ কাহিনীর চিত্ররূপ তিনি কল্পনা করতে ভালোবাসতেন। দুটি কাহিনীকে আশ্রয় করে কিছু সময় ও চিন্তাও তিনি ব্যয় করেছিলেন। সে-দুটি হল শরৎচন্দ্রের অভাগীর স্বর্গ ও রবীন্দ্রনাথের দেবতার গ্রাস। দুটিরই জন্য নাকি দু হাজারের উপর ‘ফ্রেম-স্কেচ’ করেছিলেন তিনি। তার মধ্যে অভাগীর স্বর্গ-র জন্য করা খান পঞ্চাশেক স্কেচ আমাকে দেখিয়েছিলেন। কমলবাবুর পরিকল্পিত চিত্ররূপে কাহিনীর শুরু জমিদার গৃহিণীর শবযাত্রা দিয়ে। দুপাশে কলাবন, মাঝখানের পথ দিয়ে শবযাত্রা চলেছে কীর্তনের সঙ্গে। ঝোড়ো বাতাসে কলাপাতা আন্দোলিত হচ্ছে, রাস্তা থেকে খই উড়ে গিয়ে পাশের মাঠে পড়ছে।

ঘরে বাইরের জন্যও নাকি হাজার খানেক (হাজারের কমে কথা বলতেন না তিনি ) স্কেচ করেছিলেন, কিন্তু অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও তার একটিও দেখাননি।

সেই সময় প্রায় প্রতি শনিবারই একসঙ্গে ফিল্ম দেখতে যাওয়া হত। ছবি সম্বন্ধে কমলবাবুর মতামতও ছিল গতানুগতিকের বাইরে। ‘ব্রীফ এনকাউন্টার’ দেখে প্রশংসা করেই বললেন, ‘ঠিক যেন অরপেনের ছবি।’ ‘রাশো-মন’ দেখে আমরা সবাই মুগ্ধ; কমলবাবুকে জিগ্যেস করাতে বললেন, ‘যেখানে পুলিশটা ছড়ি ঘোরাতে ঘোরাতে নদীর পাশ দিয়ে যাচ্ছে, সেই জায়গাটা ভালো। একদিন কমলবাবুর সঙ্গে মেট্রোতে ঢুকছি, এয়ার কন্ডিশন-এর হিমেল দমকার সঙ্গে সঙ্গে একটা গন্ধ এলো নাকে। জিগ্যেস করলাম, ‘আপনার থলিতে কী?’ কমলবাবু চটের থলে ফাক করে দেখালেন – মাংস। গরুর মাংস। সেই প্রথম জানলাম যে তিনি নাকি সম্প্রতি একটি অ্যালসেশিয়ানের মালিক হয়েছেন।

ইতিমধ্যে কমলবাবুর আরো কয়েকটি গুণের পরিচয় পেয়েছি। ‘তদন্ত’ নামে তিনি একটি গোয়েন্দা পত্রিকা বার করছেন। কথা বলে দেখলাম বিশ্বের গোয়েন্দা সাহিত্য তাঁর নখদর্পণে। এর মধ্যে রিখিয়া থেকে একটা পোস্টকার্ড এলো ; একদিকে অপটু হাতে কলমে আঁকা একটি ল্যাণ্ডস্কেপ, অন্যদিকে একটিমাত্র লাইনে লেখা – ‘উল্টোদিকের ছবিটা আপনার হাসির জন্যই— ক. মজুমদার’। অতি অল্পকালের মধ্যেই কিন্তু আঁকায় আশ্চর্য উন্নতি দেখা গেল। সাদা পোস্টকার্ডে পেন্সিল ও জল-রঙে আঁকা নানান চেনা ভঙ্গিমায় মেয়ে পুরুষের ছবি। তলায় একটি করে ক্যাপশন । আরাম কেদারায় এলোচুলে অলসভঙ্গিতে শায়িতা মহিলা, ডান হাত মাথার পিছনে তোলা, ওষ্ঠপ্রান্তে স্মিতহাস্য, দৃষ্টি বাঁয়ে কোনো অদৃশ্য ব্যক্তির প্রতি। ক্যাপশনে মহিলার প্রশ্ন- ‘আপনি ফুল ভালবাসেন কেন ??

কফি হাউসের স্মৃতির মধ্যে কমলবাবুর কথার ধারের কথাটাই সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে। জনৈক বামপন্থী কবি সম্বন্ধে তাঁর মন্তব্য হল- ‘ভদ্রলোক সোশাল কনটেন্ট না থাকলে নস্যি নেন না।’ চাষী-মজুরদের হাল সম্পর্কে শহরের মার্কসিস্ট বাবুরা উৎকণ্ঠিত সে কথা চাষী-মজুর জানে কি? কমলবাবুর ভাষায়, ‘ব্যাঙের একটা লাতিন নাম আছে ব্যাঙ তা জানে কি ?’ কমলবাবুকেই প্রথম দেখলাম, একজন সাহেবকে ‘ওই ফরসা ভদ্রলোকটি’ বলে উল্লেখ করতে। তির্যক রসিকতায় কমলবাবুর জুড়ি ছিল না, এবং সেই রসিকতা ব্যক্ত করার ভাষার উপর দখল ছিল সাংঘাতিক। কফি হাউসে আমাদের এক বন্ধু প্রত্যহ নিয়মিত ডবল ডিমের অমলেট খেতেন। কমলবাবু একদিন আর থাকতে না পেরে বললেন, ‘ডিমের অতখানি করে খেলে পাঁচটা মেয়েমানুষ রাখতে হয় গো !’

১৯৫৫ সালে পথের পাঁচালী ছবি মুক্তি পাবার পর অনেকবার অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও কমলবাবুর মনে ছবিটা দেখা সম্বন্ধে কোনো উৎসাহ সঞ্চার করতে পারিনি । আমি অবিশ্যি নিরুদ্যম হইনি। শেষে একদিন যখন সত্যিই দেখলেন, তখন হঠাৎ যোগাযোগ বন্ধ করে দিলেন। আমারই এক পরিচিতের সঙ্গে তাঁর দেখা হয় রাস্তায়, তাকে বললেন ছবিতে মাত্র একটি দৃশ্য ভালো লেগেছে—যেখানে অপু দুর্গা চিনিবাস ময়রার পিছনে ধাওয়া করে। খবরটা শুনে কিঞ্চিৎ অভিমান হয়েছিল; রাশো-মন-কেন যে এককথায় বাতিল করেছিলেন সেটা ভেবে কোনো সান্ত্বনা পাইনি।

এর বেশ কিছুদিন পরে যখন ভদ্রলোকের সঙ্গে আবার দেখা হয়, তখন ছবিটির প্রসঙ্গ আর তুলিনি, আর মনেও সেই সম্পর্কে আর কোন উষ্মার ভাব ছিল না, কারণ ততদিনে হৃদয়ঙ্গম করেছি পল্লীগ্রামের জীবন নিয়ে ছবি করে কমলবাবুকে খুশী করার মত ক্ষমতা আমার নেই।

(বানান অপরিবর্তিত)