রাজেশ প্রসাদ আর শান্তা প্রসাদের দেখা সাক্ষাতের অংশটুকু অবশ্য খুব মেলোড্রামাটিক ভাবে শুরু।

বড়ভাইকে ওইরকম দড়ি বাঁধা অবস্থায়, মাটিতে বসে থাকা, দু তিনদিন দাড়ি না কামানো চেহারায় দেখলে পরিবারের লোকেদের খারাপ লাগারই কথা। তার মধ্যে বোধহয় বড়ভাইকে সবসময়ই একটা পজিশনে দেখতে অভ্যস্ত চোখ, এরকম অবস্থায় দেখলে, আপনা থেকেই বর্ষণ শুরু করে দেয়। কান্নাটা ছোঁয়াচে। বড় ভাই রাজেশ প্রসাদের চোখও শুকনো রইলো না।

একটুক্ষণ দুজনকে একান্তে থাকার অবসর দিতে, ভূষণকে পাশের রুমে সরিয়ে নেওয়া। ড্রাইভার আর তার সহকারীকে গতকাল রাতেই থানায় পাঠানো হয়ে গেছে।

আধঘণ্টা সময় দিয়ে, চা আর বিস্কুট পাঠাতে বলে অমিত ঢুকলো। দুটো প্লাস্টিকের চেয়ার দিতে বললো। ছোটভাই অপরাধী নয়। আর তাকে চেয়ারে বসতে দিয়ে, বড়ভাইকে মাটিতে রাখা ঠিক হবে না।

অমিতকে দেখে আরও একবার ফুঁপিয়ে উঠলো শান্তা প্রসাদ। তারপর জানালো তাদের সংসারের গল্প। আটপৌরে বিহারের একটি পরিবারের গল্প। জাতপাত, দারিদ্র্যের গল্প। পিতৃপুরুষের নেওয়া ঋণের বোঝা। সে সব  বইতে বইতে একসময় গ্রাম ছেড়ে, শহর ছেড়ে , রাজ্য ছেড়ে রাজেশ ওই পাহাড়ি রাজ্যে চলে আসে। খুব কষ্টে কেটেছে প্রথম কয়েকটা বছর। এখান থেকে রোজগারের পাঠানো টাকায় ওখানে সংসার চলেছে। তারপর ভগবান মুখ তুলে চেয়েছেন। দাদার রোজগার ভালই বেড়েছে। ঋণ শেষ হয়েছে। বাড়িটা ঠিকঠাক করে, দোতলা হয়েছে। কিছু জমিজমা কেনা হয়েছে। তার পড়া লেখা কিছুটা হয়েছে। এখন রোজগারের ধান্দায় সে-ও চলে এসেছে। দাদা একটা কোম্পানিতে লাগিয়ে দিয়েছে। রামজি কি কৃপা সে, সব কিছু যখন ঠিক চলছিল, তখন এ কি হয়ে গেল।

মধ্যে মধ্যে দু-চারটে ছোট ছোট প্রশ্ন ছাড়া, পুরো গল্প খুব মনোযোগ দিয়েই শুনছিলো অমিত।

শেষ হবার পর তিনজনই চুপচাপ। তারপর শান্তা প্রসাদ জিজ্ঞেস করলো , অব আর কি হওয়ার আছে?

প্রশ্ন শান্তার কিন্তু রাজেশও চেয়ে আছে।

অমিত নির্বিকার মুখে দেখলো দু’জনকেই। তারপর বলল, “তোর বড় ভাই বলছে না, ও কার জন্যে কাজ করতো? ওকেই আসামি বানিয়ে কোর্টে পেশ করবো। জেল হবে। কিন্তু তার থেকেও খারাপ জিনিস তারপর হবে।”

দু’জনেই মুখ তুলে তাকানো। তারপর রাজেশ বললো, “ইস সে ভি খারাপ কি হবে?”

সেই গম্ভীর মুখেই অমিত বললো, “ড্রাগস কেসে তুই যদি শাস্তি পেয়ে যাস, তাহলে তোর সব সম্পত্তি, তোর করা সম্পত্তি অন্যের নামে থাকলেও, জব্দ হয়ে যাবে। তোরা আবার ভিখারি হয়ে যাবি। তোর এতদিনের পরিশ্রম সব বেকার যাবে।”

দুই ভাই বজ্রাহতের মতো তাকিয়ে রইলো। তারপর আবার শান্তা প্রসাদ ফুঁপিয়ে উঠলো। রাজেশ কাঁদেনি, কিন্তু সে-ও ফ্যাকাসে মেরে গেছে।

শান্তা ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতেই বললো, “ভাইয়া এই সব কিছুর জন্য মিশ্রজি দায়ী। তুমি তো উনার আদমি।  উনাকে বলো হেল্প করতে। উহ জরুর কিছু হেল্প করবেন।”

অমিত মাথা নাড়লো। “এই সব ক্ষেত্রে কেউ হেল্প করতে আসবে না। আসবে, যদি সে বিপদে পড়ে। সে কেস খেলবে। বড়া বড়া উকিল লাগাবে। একটা কোর্ট থেকে আরও একটা কোর্টে যাবে। বিশ সাল তক কেস চলবে। যতদিন ফায়সালা হবে না, ততদিন প্রপার্টি ভি ক্রোক হবে না। কিন্তু তোর জন্য সে কেন আসবে? “

শান্তা আতঙ্কিত গলায় বললো ” ভাইয়া কুছ করো।”

অমিত সেদিকে নজর না রেখেই বললো, “আমি জানি, তুই কমিশন পাস। তোর পেছনে কোন বড়া আদমি আছে। যদি নাম ঠিকানা আর প্রমাণ কিছু দিস, তাহলে তাকে পাকড়ে নিয়ে আসবো। কেস খেলবো। ওই লোকটা নিজে বাঁচার জন্য তোদের হয়েও কেস লড়বে। কি হবে জানি না। কিন্তু তুই সময় পাবি। তোর জমিন জায়দাদ আরও বহু বছর তোর পরিবারের থাকবে। না হলে ভাব, তোর একবছরের ছেলে, কি ভাবে থাকবে, কি খাবে আগলা দশ বছর। তোর তো কেস লড়ার পৈসা জোগাড় করতে জমিন জায়দাদ বেচতে হবে। ওটাও আমরা হতে দেব না। ফালতু জেলে পচে মরবি। ভাব, ওই লোকটাকে বাঁচিয়ে পরিবার মারবি নাকি নাম ঠিকানা দিবি?”

রাজেশ খুব নিচু সুরে বললো, “আমাকে জানে মেরে দেবে।”

অমিত একটু হাসার চেষ্টা করলো। তারপর কনফিডেন্ট সুরে বললো, ” এত সোজা না। তাছাড়া তোর পুরনো লাইফ তো খতম। তুই ওই পাহাড়ি রাজ্যে ফিরে গেলে তোকে এমনিই ওখানের লোক মেরে দেবে। তোকে নতুন লাইন বেছে নিতেই হবে। ওসব ভাবনা ছাড়। পরিবারের কথা ভাব। তুই যদি নাম ঠিকানা বলিস, তাহলে তোর জমিন জায়দাদ আমরা সহজে ক্রোক করার চেষ্টা করবো না। পহেলা ওই লোকটাকে ধরবো। ওর সঙ্গে লড়ব। বহুত টাইম লাগবে।  ততদিনে ভাই, লেরকা ভি লায়েক হয়ে যাবে।”

এখন অমিত বাসে। খুব বেশি সময় হাতে ছিল না। কাপড় জামা কোনওমতে ব্যাগে গুছিয়ে বাস স্টান্ডে। সাতটায় ছেড়েছে, সকাল সাতটার ভিতরে রাজধানী শহরে পৌঁছে দিলে হয়। এই শহর থেকেও  ফ্লাইট আছে। কিন্তু রোজ নয়। অথচ টাইম ইস এভরিথিং, এই কেসে।

শ্রীপতি মিশ্র আদতে বিহারের লোক। ব্যবসাপত্তর আছে সেখানে। কিন্তু তার আরও বড় ব্যবসা চলে কলকাতায়। বড়বাজারে কী সব ট্রেডিং করে। সেখানে তার একটা হোটেলও আছে। বেশ বড়লোক হবে নিশ্চয়ই। বেশিরভাগ সময় সে কলকাতাতেই থাকে। রাজেশ প্রসাদ তার সঙ্গে দেখা করতে গেছে, এবারও যাওয়ার কথা ছিল কলকাতায়। ভেবেছিল ট্রাকে এই শহর অবধি এসে, এখান থেকে ফ্লাইটে চলে যাবে। নসিব। ধরা পড়ে গেল।

অমিতেরও নসিব। এমন দিন স্বীকারোক্তি দিল, এমন সময় দিল যে ফ্লাইট ধরার উপায় নেই। এখন বাস ধরে সকালে এয়ারপোর্ট, সেখান থেকে সকালের ফ্লাইট ধরে কলকাতায়। সব ফর্মালিটিস করেও তিনটের আগে সার্চ শুরু হবে না। অবশ্য বিশ্বরূপদা সব ব্যবস্থা করে রাখবেন বলেছেন। ভাগ্যিস কেন্দ্রীয় সরকারের অফিস। রাজ্যে রাজ্যে ঠাঁই আছে। আর এক সূত্রেই বাধা এই সমস্ত প্রাণ। সুতরাং যে কোন রাজ্যেই গিয়ে অপারেশন করা যায়।

অন্ধকার … তার উপর পাহাড়ি পথ দিয়ে গাড়ি ছুটে যাচ্ছে। ঘুম ঠিক নয়, একটা ঝিমুনি আসে মধ্যে মধ্যে আবার চলে যায়। দুত্তেরি করেছে, বলে চোখ দুটো জানালা দিয়ে বাইরে মেলে দিয়ে ভাবতে বসলো অমিত।

কপাল ভাল। ভাইটা সময়মতো এসে গিয়েছিল। নাহলে, আজকের এই জার্নি কবে হতো, হতেই পারতো কিনা কে জানে?

অনেক সময়ই রাস্তা যখন খুলতে চায় না, অমিত দেখেছে, ওর জন্য পরিবারের কোনও লোক নতুন রাস্তা খুলে দিয়েছে।

পাঁচ পাঁচটা ছেলের মার সামলানো সহজ নয়। মাটিতে পড়ে গেছে যখন, তখন এক ভদ্রমহিলা দেবদূতের মতো এসে উদয় হয়েছিলেন সেই সন্ধ্যায়। কে জানতো, তিনিই রূপাঞ্জনার মা। বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন। রক্ত, ধুলো সব মুছিয়ে দিলেন। একটা পেন কিলার দিলেন। ভাগ্যিস ওই সময় মেয়ে বাড়ি ছিল না।

তিনি ফিরতে ফিরতে, অমিত একটু গুছিয়ে নিয়েছে। কেন ওই পাড়ায়, তাতে অম্লান বদনে বলেছে অঙ্কের মাস্টারমশাইয়ের খোঁজে এসেছিল। রূপাঞ্জনা বলার পর অবশ্য তার মা-ও চিনতে পেরেছিলেন। সাস্কৃতিক গ্রুপের সঙ্গে জড়িয়ে থাকলে, বাঙালি মধ্যবিত্ত বাড়িতে যে কোনও ছেলের এন্ট্রি সহজ হয়ে যায়। পাড়ার যে ছেলেটির কল্যাণে এসেছিল— তাকে, মানে রজতকে পেটপুরে চিকেন চাউমিন খাওয়াতেই হবে সেটা তখনই ভেবে নিয়েছিল। 

অঙ্কের মাস্টারমশাই হিসেবে সত্যেনবাবুর কথা রূপাঞ্জনাই বলেছিল। শুধু বাড়ির অ্যাড্রেস বলে দেওয়া নয়, সাথে করে নিয়ে গিয়েছিল। মাঝপথে স্যার নিতে চাননি, কিন্তু রূপাঞ্জনা বলায়…কি চমৎকার ভাবেই না দিনগুলো কাটছিল।

মা মধ্যে মধ্যে অসুস্থ হয়ে চিকিৎসার জন্য বাইরে যেতেন। খবর পেলে, রূপাঞ্জনার মা বাড়িতে আসতে বলতেন।

দু চারবার যেতেই হয়েছে।

থেকে থেকেই বৃষ্টি নামে সেই শহরে। বেশ বড় একটা কালো রঙের ছাতা ছিল। সময়ে সময়ে কুকুর তাড়ানোর কাজেও লাগতো।  কিন্তু সেটা নিয়ে কলেজে আসায় এত হেসেছিল রূপাঞ্জনা, অদিতি, জয়শ্রীরা, অমিত সেটা আর আনেনি। বৃষ্টির দিনে এমনিই চলে আসতো। ওরা বললেও ওদের ছাতার তলায় যাবে না। সেইজন্যে, সেই হাসির প্রায়শ্চিত্ত করার জন্যে,  অনেক দিন তাদেরকেও অপেক্ষা করতে হয়েছে কলেজে। ছাতা থাকলেও খুলে যেতে পারেনি। অথচ, ওই পড়া, ভাল খাবার অথবা সিনেমা এর বাইরে গল্প কখনো যায়নি। এত ভাল গান জানে রূপাঞ্জনা, জয়শ্রী— কোনওদিন একটা পছন্দের গান মুখ ফুটে বলতে পারেনি অমিত। শুনেছে, কলেজ ফেস্টে, জলসায় অথবা কম্পিটিশনে। বাড়ি থেকে কলেজ বেশি দূর না থাকায়, হেঁটেই  আসতো রূপাঞ্জনা। একলা। কতদিন আসতে দেরি হচ্ছে দেখে অমিত সেই রাস্তা ধরে হেটে গেছে কলেজ থেকে। রাস্তায় চার্চের পাশে, বাস স্টপেজে দেখা হয়েছে।

ভুরু নাচিয়ে রূপাঞ্জনা জিজ্ঞেস করেছে, এখানে … এই সময় কি করছিস?  ক্লাসে যাবি না?

অমিত বলতেই পারেনি, তোর জন্য এসেছিলাম। বরং বলেছে, না, এদিকে একটু কাজ আছে। আসছি। তারপর মিছিমিছি অল্প এগিয়ে, অল্প ঘুরে ফেরত গেছে কলেজে। ফার্স্ট পিরিয়ড মিস হয়েছে। ওই দুই মিনিটের কথা বলার জন্যে।

ওই দুই বছর। দেখতে দেখতে, হাসতে হাসতে উড়ে চলে গেল।

ফাইনাল পরীক্ষা এলো এবং শেষও হয়ে গেল। মাকে চিকিৎসা করাতে নিয়ে গেছে বাবা তার আগেই। পরীক্ষা শেষ হতেই পরের দিন যাওয়া। যেতেই হবে। গিয়ে জানতে পারা, মারণ রোগে ধরেছে। সেখানে অনেকদিন থাকা। কলেজে ভর্তি হয়ে যাওয়া।  বাবা কিভাবে যেন পাশের সার্টিফিকেট সব জোগাড় করে আনলো। যেতেই হলো না আর। যাওয়াই হলো না ।

শেষের সেদিন, সকালবেলা বাস স্টেশনে ছাড়তে এসেছিল অনেকেই। রূপাঞ্জনা বলেছিল , “ফিরে আসিস শিগগিরই। কথা আছে। কি করবো আগামীতে সেগুলো নিয়ে ভাবতে হবে। তাড়াতাড়ি ফিরে আয়।”

না, আসা আর হয়নি। দেখাও আর হয়নি।

আজকেও অফিস থেকে বেরুবার সময় ভাইটা বলছিল, “আপনি কখন ফিরে আসবেন সাহেব। তাড়াতাড়ি ফিরে আসবেন।” তার দু’চোখে অদ্ভুত আকুতি ছিল একটা। যেন অমিত ফিরে আসলেই তার ভাইয়ের কেসের একটা সুরাহা হবে।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো অমিত। সব কিছু যদি মানুষের হাতে থাকতো। ফেরা, না ফেরা, যদি ভাগ্য নয়, নিজের উপর থাকতো— তাহলে সেও তো নিশ্চয়ই ফিরে আসতো। আসতে পারতো।

(ক্রমশ)