টেপে প্রশ্নোত্তর ধরা ছিল। স্টেটমেন্ট লেখা ছিল। সেগুলো কোর্টে দেখিয়েও ট্রানজিট রিমান্ড পেতে বেশ সময় লাগলো আদালত থেকে। আসলে, ভারতীয় আইন অনুযায়ী “বেল” দেওয়াটাই নিয়ম। তাছাড়া, অমিত চাইছে, এক শহর থেকে শুধু অন্য শহর নয়, অন্য রাজ্যেও নিয়ে যেতে। খুব পয়েন্ট অফ অর্ডার উত্থাপন করছিলেন ওর উকিল। তবু কাস্টডি পাওয়া গেল। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে ওখানে নিয়ে গিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের কাছে পেশ করতেই হবে, এই শর্ত রইলো।
সব মিটিয়ে সোজা এয়ারপোর্ট। আজকে কপাল ভাল। বিকেল তিনটেয় একটা ডিরেক্ট ফ্লাইট আছে। সেটা পৌঁছতে পৌঁছতে, তারপর শহরে ঢুকতে ছ’টা হয়ে যাবে । যাক গে। রাতটা অফিসে রেখে, সকালে কোর্টে নিয়ে গেলেই হবে।
কিন্তু, একটু গেরো লাগলো।


বিশ্বরূপদা ফোনে বললেন, জজ সাহেবের কাছে আজকে, তিনদিনের রিমান্ড শেষে ওদের পেশ করা হয়েছিল। প্রচুর অনুরোধ করার পর, তদন্তকারী অফিসার বাইরে আছেন বলায় কাল সকালে দশটা অবধি রিমান্ড বাড়িয়েছেন। গাড়ির অর্ডার করে, পৌরসভাকে দিয়ে দিয়েছেন। প্রেসেনটিং অফিসার আসেনি বলে জজসাহেব বিরক্ত হয়েছেন। তারপর কোথায় আছে জেনে, ফেরামাত্র কেস ডায়েরি প্রেসেন্ট করতে যেতে বলেছেন। দরকার হলে বাড়িতে গিয়ে জানাতে হবে প্রেসেন্ট স্ট্যাটাস।
খেয়েছে! তার মানে, প্লেন থেকে নেমেই সাহেবের বাংলোয় দৌড়তে হবে। এমনিতেই যতখানি জেনেছে, এই বিচারক খুব কড়া। আসলে, অ্যারেস্ট করে, কাউকে খুব বেশিদিন জেলে রাখতে কোনও বিচারকই চান না। কারণ, পরে যদি দেখা যায় লোকটি নির্দোষ, তাহলে সে মিছেমিছি শাস্তি ভোগ করে। সলিড প্রমাণ ছাড়া তাই কাউকে জেলে ভরে রাখা যায় না। উচিতও নয়।
শহরে পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় রাত সাতটা। এয়ারপোর্ট থেকেই লোকটির জিম্মা অন্যদের হাতে তুলে দিয়েছে। এবার অফিসে পৌঁছে, তড়িঘড়ি সব রেখে, কেস ফাইলটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লো অমিত। জিপসিটা নিজেই চালিয়ে। কত রাত হবে কে জানে? আলিদাকে কষ্ট দেয়ার মানে হয় না। বেরুবার সময়, ক্যান্টিনের শ্যামল বলল, স্যার, আপনার খোঁজে একজন ভদ্রমহিলা এসেছিলেন সকালে।
ভদ্রমহিলা? হবে হয়তো কোন কেস রিলেটেড ইস্যু নিয়ে। পরে, দেখা যাবে। আপাতত তো জজসাহেব কে সামলে নেওয়া যাক।
জজসাহেব নাকি ব্যাস্ত। বাড়িতে পার্টির মতো কিছু আছে। বাইরে ডিউটিতে থাকা পুলিশটি বলল। চেনে অমিতকে। তবু বললো, স্যার একটু বসে যান। সাহেবকে খবর দিয়ে দিই।
প্রায় প্রত্যেক বিচারকের থাকার জায়গায় একটা রুম আলাদা থাকেই। জরুরি শুনানি ইত্যাদি হয় সেখানে । সেই রুমের বাইরে একচিলতে বারান্দা। সেখানে সাধারণ বেতের চেয়ার দুটো। একটা টেবিল। সেখানেই একটা চেয়ারে বসে গল্পটা সাজিয়ে নিচ্ছিল অমিত।
একটা গলা খাঁকারির শব্দ।
তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “গুড ইভিনিং স্যার। সরি টু ডিসটার্ব ইউ। বাড়িতে আপনার এক অকেশন আছে। আসলে, অফিস থেকে বললো, আপনি ফিরতেই দেখা করতে বলেছেন। কেসটা নিয়ে। আপনি বললে, স্যার কাল সকালেও আসতে পারি। যখন বলবেন। “
চোখে চশমা। চারকোনা ফ্রেম। চুলগুলো পুরোপুরি পেকে যায়নি এখনও। দোহারা লম্বা গড়ন। এজলাসে যত ভারিক্কি দেখায়, বাড়িতে ততটা দেখাচ্ছে না। পরিষ্কার কাজ করা পায়জামা পাঞ্জাবিতে বেশ অন্যরকম লাগছে।
—এয়ারপোর্ট থেকে সোজা চলে এসেছেন?
—হ্যাঁ স্যার। আসলে বলল, আপনি এলেই দেখা করতে বলেছেন।
—হ্যাঁ, বলেছিলাম। আসলে, রিমান্ড চাইছেন। কেন চাইছেন… তাছাড়া… বলল কলকাতায় গিয়েছেন । কোন ডেভেলপমেন্ট?
—হ্যাঁ স্যার। মেইন পারচেস করা লোকটাকে ধরতে পেরেছি। ওকে ট্রানজিট রিমান্ডে নিয়ে এসেছি। কালকে কোর্টে পেশ করব।
—ঠিক আছে। আসলে বাড়িতে অন্য কোনও বড় উৎসব নয় । আমার মিসেসের একজন আত্মীয়া এসেছেন। সঙ্গে তার একজন বান্ধবী। ভাল গান গাইতে পারেন। তাই কয়েকজনকে বলেছি আসতে। একটু দেরি আছে সবাই আসতে। ততক্ষণে, একটু সংক্ষেপে ব্যাপারটা বলুন।

—স্যার, ওই কলকাতা থেকে ধরে আনা লোকটা বিহার আর বাংলার স্থানীয় মার্কেটে প্রচুর চাহিদা দেখে, সেই পাহাড়ি রাজ্য থেকে মাল আনার প্ল্যান ভাজে। লোকাল ভাষা জানা একটা লোক দরকার ছিল। রাজেন্দ্র প্রসাদ সেই কাজটা ভালভাবেই করছিল। দু-তিনটে জায়গায় স্টপেজ নিয়ে ট্রাক আসতো বিহার বর্ডার অবধি। সেখানে মাল খালাস করে ফেরত। সেখান থেকে মাল চারদিকে ছড়িয়ে দেওয়ার ভার এ নিজে সামলাত। প্রচুর কাঁচা টাকা। সেটা সাদা করার সবচেয়ে সোজা উপায় রেস্টুরেন্ট খুলে বিক্রি দেখানো। হোটেল ফুল বোর্ডারে দেখানো। সারা পৃথিবীতেই ড্রাগসের টাকা এভাবেই অনেকে সাদা করে, করার চেষ্টা করে। সে ভাবে এ-ও ট্রাই করেছে। ভাল করে তদন্ত করলে, সাব্জিওয়ালা থেকে শুরু করে মাছওয়ালার পাত্তা পাওয়া যাবে না। সেটা স্যার, আমরা দেখছি। ওই লোকটা বলেছিল স্যার, রাজেন্দ্র প্রসাদকে চেনে না। সম্পর্ক নেই। অথচ রাজেন্দ্র ওর হোটেলে বিনা পয়সায় থাকা খাওয়া করে এসেছে। বলেছে, ওর কাছ থেকেই ক্যাশ নিয়ে আসতো পাহাড়ি রাজ্যে পেমেন্ট করতে। দু একবার বিয়ারার চেক পেয়েছিল। সেটা পিছনে সই করে, পয়সা তুলেছে। তার প্রমাণ জোগাড় করেছি।
—আর পাহাড়ি রাজ্যে থেকে …মানে যেখান থেকে কিনতো?
—স্যার, আপনি তো জানেনই ওখানে খুব স্ট্রিক্ট ভাবে কিছু করা কঠিন। তবে যেখানে গাজার চাষ হয়, সেরকম কিছু জায়গায় আমরা আসাম রাইফেলসের সাহায্য নিয়ে, সব গাছ উপড়ে ফেলে দিয়েছি। ওখানেও কিছু কেস রুজু করা হয়েছে। তবে স্যার, ঠিক কারা বিক্রি করেছিল এদের কাছে, সেটা জানার চেষ্টা করছি। কিন্তু খুব একটা সফল হবে বলে মনে হয় না। তবে, মাল সমেত ধরা পড়ায়, এদের বিরুদ্ধে চার্জশিট তাড়াতাড়ি দিয়ে দেব।
জজসাহেব কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন। এমন সময় একটি দশ-এগারো বছরের মেয়ে দৌড়ে চলে এলো। “বাপি, কখন কেক কাটবো? সবাই অপেক্ষা করছে যে!’’
“বাপি”— জজসাহেবকেও কেউ বাপি বলে ডাকে। ডাকতে পারে? অমিতের মুখ বিস্ময়ে হা হয়ে গেল।
(ক্রমশ)