পর্ব-২৫

(আইপিএস সুখেন্দু হীরা বর্তমানে কলকাতা পুলিশের ডেপুটি কমিশনার (DCP)। নারী পাচার নিয়ে ধারাবাহিক ভাবে লিখছেন বালিহাঁস-এর পাতায়।)

অষ্টম শতাব্দীতে উত্তর বাংলার পুণ্ড্রবর্ধন নগরে একটি কার্তিক ঠাকুরের মন্দির ছিল। সেখানে ‘কমলা’ নামে এক অলৌকিক রূপগুণ সম্পন্না দেবদাসী থাকত। কাশ্মীররাজ জয়াপীড় বিনয়াদিত্য তাঁর প্রতি আসক্ত হয়ে তাকে বিবাহ করেছিলেন। ওড়িশার সামবংশের রাজা কর্ণরাজ বিবাহ করেছিলেন সলোনপুর বৌদ্ধবিহারের মন্দিরের দেবদাসী ‘কর্পূরশ্রী’ কে। কর্পূরশ্রীর মা-ও দেবদাসী ছিলেন। প্রথম কাহিনীর উল্লেখ আছে কলহনের ‘রাজতরঙ্গিনী’তে আর দ্বিতীয় তথ্যটির উল্লেখ আছে ওড়িশার রত্নগিরি তাম্রশাসনে।

        দেখা যাচ্ছে, অনেক সময় দেবদাসীরা রাজানুগ্রহ লাভ করে রাজার গৃহিনী হতেন। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে উল্লেখ আছে, প্রভু তার দাসীর গর্ভে সন্তান উৎপাদন করলে দাসী ও দাসীপুত্র উভয়েই মুক্ত হবে। সেই দাসী যদি সন্তান-সহ প্রভুর ঘরে ভার্যার ব্যবহার পায়, তবে তার ভ্রাতা ও বোনেরাও দাসী বৃত্তি থেকে মুক্তি পাবে। অর্থাৎ এক্ষেত্রেও বিবাহের মাধ্যমে নারীদের দাসত্ব থেকে মুক্তি ঘটছে এবং সেই সঙ্গে সে অন্যদের মুক্ত করছে।

          কিন্তু মৌর্য যুগে গণিকাদের সেভাবে মুক্তি ঘটতো না। বয়স কালে কোন গণিকা রাজসেবা থেকে অব্যহতি চাইলে মুক্তিপণ হিসাবে  ২৪ হাজার পণ দিলে এবং তার পুত্র ১২ হাজার পণ দিলে দাসত্ব থেকে মুক্ত পাবে। মুক্তিপণ দিতে না পারলে গণিকাপুত্র আট বছর ধরে রাজকুলে কুশীলবের কাজ করে মুক্তি পাবে। যৌবন অতিক্রান্ত হলে গণিকারা রাজার রন্ধনশালায় কাজ করবে। এই কাজ না করে যদি সে অন্য পুরুষের রক্ষিতা হতে চায়, তবে মাসে সওয়াপণ রাজাকে দেবে।

         অর্থাৎ দাসী বা দেবদাসীর উপযুক্ত জায়গায় বিবাহ হলে তাদের দাসত্ব থেকে মুক্তি মিলত কিন্তু গণিকাদের সেরকম কোন ব্যবস্থা ছিল না। গণিকা পেশাটা ছিল একমুখী। অর্থাৎ পেশা হিসাবে গণিকাবৃত্তি একবার গ্রহণ করলে, সাধারণ জীবনে ফিরে আসা মুশকিল ছিল। বর্তমান যুগেও প্রায় একই ব্যবস্থাই বহাল।

         ঢাকায় লক্ষ্মীমণি নামে এক পতিতার কন্যা লেখাপড়া শিখেছিল, সে এই পেশায় আসতে আপত্তি করে। মা তাকে একবাবুর সঙ্গে এক ঘরে বন্ধ করে রাখল। লক্ষী আঁচড়িয়ে, কামড়িয়ে, হাত-পা ছুঁড়ে বাবুর হাত থেকে বাঁচল এবং পালিয়ে আশ্রয় নিল তাঁর এক ব্রাহ্মণ মাস্টারের বাড়ি। মা আদালতে গেলেন; কিন্তু জিততে পারলেন না। মাস্টার তাকে কলকাতায় পাঠিয়ে দিলেন, আশ্রয় মিলল শিবনাথ শাস্ত্রীর (১৮৪৭ – ১৯১৯) বাড়িতে। সেখানে লেখাপড়া শিখে এক সৎ ব্রাহ্ম যুবকের সঙ্গে বিবাহ হয়। সে যুগে বাংলায় অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তিরা এভাবে অনেক মেয়েকে পতিতালয় থেকে উদ্ধার করেছিলেন।

            ১৮৫১ সালের ১ মে সংবাদ ভাস্কর –এ সম্পাদকীয়তে সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। তাতে এক বারো বছরের এক বালবিধবা পতিতাকে উদ্ধারের কাহিনী প্রকাশ করে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছিল। মেয়েটি অল্প বয়সে বিধবা হয়। বাবা-মা কেউ ছিল না। শ্বশুরবাড়িতে অত্যাচারিত হত। এক বয়স্ক প্রতিবেশিনী তখন মেয়েটিকে মামাবাড়ি পৌঁছে দেবে বলে। কিন্তু সেই প্রতিবেশিনী মামাবাড়ি না নিয়ে গিয়ে পাঁচ টাকার বিনিময়ে পতিতালয়ে বিক্রি করে দেয়। বিষয়টি জানতে পেরে কিছু উদার ব্যক্তি পতিতালয় থেকে পাঁচ টাকা দিয়ে মেয়েটিকে উদ্ধার করে, শ্বশুরবাড়িতে নিয়ে আসে। সেখানে মেয়েটিকে শ্বশুরবাড়ির সম্পত্তির অধিকার নিশ্চিত করে। পতিতালয় থেকে মেয়ে উদ্ধার, তাকে সামাজিক মর্যাদায় পুনঃপ্রতিষ্ঠা এরকম কাজ সেযুগে বিরল ছিল, এ যুগে আরও বিরল।

           আর একটি ঘটনা সে সময় কলকাতায় আলোড়ন ফেলেছিল। ১৮৫৩ সালে হিন্দু কলেজে হীরাবুলবুল নামে এক বারাঙ্গনার পুত্র ভর্তি হয়েছিল। ফলে দেশীয় হিন্দু মহলে তুমুল আন্দোলন হয়েছিল। যাদের ছেলেরা হিন্দু কলেজে পড়ত তাঁরা ছেলেকে ট্রান্সফার সার্টিফিকেট করে অন্য স্কুলে ভর্তির চেষ্টা করেছিলেন। সংবাদপত্রগুলিও বেশ্যাপুত্রের ভর্তির বিরুদ্ধে ছিল। সংবাদ প্রভাকর-এ ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত লিখলেন, “যবন ও খ্রীস্টান এই দুই দোষ তো ছিল, এই ক্ষণে বেশ্যাপুত্র আসিয়া ত্রিদোষ প্রাপ্ত করাইল।” শেষে এডুকেশন কাউন্সিল সেই পতিতাপুত্রকে কলেজ থেকে বিদায় করে।

           এই ছিল সে যুগে পতিতাদের বা পতিতার সন্তানদের সমাজের মূলস্রোতে ফিরে আসার পথে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বা কার্যকলাপ। তবুও ব্রিটিশ শাসনকালে পতিতাবৃত্তি নিয়ন্ত্রণ আনতে ১৯২৩ সালে পাস হয় Calcutta Suppression of Immoral Traffic Act। এই আইন বলে ১৬ বছরের কম বয়সী মেয়েদের উদ্ধার করার ক্ষমতা দেওয়া হয় কলকাতা পুলিশকে। এইসব মেয়েদের উদ্ধার করে রাখার জন্য শহরে এবং শহরের উপকক্ষে কয়েকটি হোম গড়ে ওঠে। এরকম একটি হোম ছিল গোবিন্দ কুমার হোম, পানিহাটি।

           এই আইনে আরও বলা ছিল কোন পতিতা এক পতিতালয় ছেড়ে অন্য পতিতালয়ে যেতে চাইলে তিনমাস আগে পতিতালয়ের মালিককে জানাতে হবে এবং পুলিশ প্রধানের কাছে লিখিত ভাবে জানাতে হবে, কেন সে অন্য পতিতালয়ে যেতে চায়। সাধারণত অমানুষিক মারধর করা ছিল অন্যতম কারণ। পুলিশ প্রধান বিচার করে দেখতেন যাওয়া যুক্তিসঙ্গত কিনা— তবে অনুমতি মিলত। যাবার আগে সেখানকার সব ধারদেনা চুকিয়ে যেতে হতো। যদি প্রমাণ হতো পতিতা মিথ্যা বলছে, তাহলে জেলে দেবার বন্দোবস্ত ছিল।

            যদি কোন পতিতা তার বৃত্তি ছেড়ে ভদ্র জীবন যাপন করতে আগ্রহী হত, তাহলে তাকে পুলিশ প্রধানের কাছে আবেদন করতে হতো। যদি তার কোন যৌনরোগ না থাকে তাহলে অনুমতি মিলত। পতিতার মা, বাবা বা নিকট আত্মীয় ফেরত পেতে চাইলে পতিতার আপত্তি সত্ত্বেও তাকে তাদের হাতে তুলে দিত। স্বাধীন ভারতে পতিতাবৃত্তি নিষিদ্ধ হওয়ার দরুন এইসব আইন উঠে যায়।

         দেখা যাচ্ছে, ব্রিটিশরা আইন করে পতিতাদের কিছুটা সুরক্ষা কবচ দিয়েছিল। স্বাধীন ভারতে পতিতাবৃত্তি বেআইনি হওয়ার জন্য আজ তাদের কোন সুরক্ষা কবচ নেই। তবে স্বাধীন নাগরিক হিসাবে যে সব সংবিধানিক সুযোগ-সুবিধা সেটা তারা পাবে। তবে একটা কথা পরিষ্কার— সে যুগে যৌনকর্মীদের মূলস্রোতে ফিরে আসা এত সহজ ছিল না, এযুগেও সরল নয়; যা নারী পাচার প্রক্রিয়াকে দীর্ঘজীবী করার অন্যতম কারণ।

তথ্যসূত্রঃ-

১. কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র – সুকুমার সিকদার – (অনুষ্টুপ)

২. ভারতের বিবাহের ইতিহাস – অতুল সুর (আনন্দ পাবলিশার্স)

৩. অন্য কলকাতা – বিশ্বনাথ জোয়ারদার (আনন্দ পাবলিশার্স)।