পর্ব-২২

আইপিএস সুখেন্দু হীরা বর্তমানে কলকাতা পুলিশের ডেপুটি কমিশনার (DCP)। নারীপাচার নিয়ে ধারাবাহিকভাবে লিখছেন বালিহাঁস-এর পাতায়।

          মানব সভ্যতার শুরুতে ‘বিবাহপ্রথা’র কোনও প্রচলন ছিল না। শুধু তাই নয় ‘পরিবার’ নামে কোনও প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব ছিল না। বিশেষজ্ঞরা বলেন, কৃষিকাজ আবিষ্কার হওয়ার পর মানুষের মধ্যে সম্পত্তির ধারণা সৃষ্টি হয়; তখন পরিবারের উৎপত্তি হয়।

পরিবার সৃষ্টির পিছনে আরও দু’টি কারণ বলা হয়। এক হচ্ছে মানুষের যৌনক্ষুধা নিবৃত্তি। অন্যান্য পশুদের মতো মানুষের যৌন মিলনের কোনও নির্দিষ্ট ঋতু বা সময়কাল নেই। তাই পুরুষ ও নারী সবসময় পরস্পরের সান্নিধ্যে থাকতে চায়। এই বাসনা তাদের মধ্যে সর্বদা জাগ্রত থাকে। পরিবার গঠন নারী-পুরুষের এই একত্র থাকাটা নিশ্চিত করল।

          দ্বিতীয় কারণ হিসাবে বলা হয়, মানব শিশুর সাবলম্বী হতে দীর্ঘ সময় লাগা। জীবজগতে পশু-পক্ষীর শাবক খুব তাড়াতাড়ি সাবলম্বী হয়ে যায়। যতদিন না শিশু স্বাবলম্বী হচ্ছে ততদিন সন্তান-সহ মাকে পিতার মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয়। তাই আদিম যুগ থেকেই নারী প্রেম, ভালবাসা ও সোহাগ দিয়ে পরিবারকে আগলে রেখেছে। নারী পুরুষের কাছে নির্যাতিত হয়েও সন্তানের মুখ চেয়ে আজও পরিবার আগলে পড়ে থাকে।

           মানব সমাজে আগে পরিবারের উদ্ভব হয়েছে, তারপরে বিবাহের দ্বারা পরিবারে স্ত্রী-পুরুষের সম্পর্ককে সামাজিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। সিন্ধু লিপির এখনো পাঠোদ্ধার সম্ভব হয়নি, তাই সিন্ধু সভ্যতার সময় বিবাহ ব্যবস্থাপনা কী ছিল, তা বলা মুশকিল। সিন্ধুসভ্যতার আগে ভারতের ইতিহাসে আছে কিছু পাথুরে প্রমাণ, শুধু পাথুরে প্রমাণ দিয়ে সামাজিক ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে সঠিক ভাবে কিছু বলা যায় না।

           বৈদিক যুগে বিবাহের প্রচলন ছিল। পাত্রপাত্রী পরিণত যৌবনেই বিয়ে করত। তবে বর্তমানে হিন্দু মতে যে বিবাহ প্রথা প্রতিষ্ঠিত, তার উল্লেখ বৈদিক যুগের প্রাচীনতম গ্রন্থ ঋকবেদে নেই। প্রথমত ঋকবেদের যুগে জাতি বিচার বা দেশ বিচার করে বিবাহ হতো না। ঋকবেদের বিবাহ সংক্রান্ত স্তোত্র থেকে বোঝা যায়, পাত্রপাত্রী বিভিন্ন গ্রামের হতো। আরও একটি বিশেষ ব্যাপার ছিল, তা হল – পাত্রীর বিবাহ কোন বিশেষ পাত্রের সঙ্গে হতো না, তার সমস্ত সহোদর ভাইদের সঙ্গে হতো। অর্থাৎ নারীর বহুপতি গ্রহণ প্রচলন ছিল। অথর্ব বেদের একটি স্তোত্রে আছে— যদিও বধূকে জেষ্ঠ ভ্রাতাই বিবাহ করতো তাহলেও তার কনিষ্ঠ সহোদরদের রমণের অধিকার থাকত। ঋকবেদে আরও আছে – জেষ্ঠ ভ্রাতার মৃত্যু হলে বিধবা স্ত্রী দেবরের সঙ্গেই স্ত্রী রূপে বসবাস করত।

           বেদের যুগের পর এল স্মৃতির যুগ। মনু বিধান দিলেন, কলিযুগে কন্যার বিবাহ যেন সমগ্র পরিবারের সঙ্গে যৌথ ভাবে না দেওয়া হয়। প্রথমা স্ত্রী বেঁচে থাকতে পুরুষকে শর্তসাপেক্ষে দ্বিতীয় বিবাহ করার কথা বললেন তিনি। মদ্যপানে আসক্ত, দুশ্চরিত্র, পতিবিদ্বেষিনী, অনারোগ্য ব্যধিগ্রস্থ, অপকার সাধনে সক্ষম, ধনক্ষয়কারী স্ত্রী থাকলে স্বামী দ্বিতীয় বিবাহ করবে। স্ত্রী বন্ধ্যা হলে, মৃতবৎসা (কেবল মৃত সন্তান প্রসব করে) হলে, কেবল কন্যা সন্তান প্রসব করলে, অপ্রিয়ভাষিণী হলে স্বামী দ্বিতীয় বিবাহ করবে।

           মনু অবশ্য স্ত্রী জাতির জন্যও দ্বিতীয় বিবাহের বিধান রেখেছিলেন। স্বামী দীর্ঘ সময় বিদেশে থাকলে, স্বামী ইন্দ্রিয় ভোগের জন্য অন্যত্র গমন করলে, স্ত্রী নির্দিষ্ট সময় অপেক্ষা করে দ্বিতীয় পতি গ্রহণ করবেন।

           ভারতের ইতিহাসে পরবর্তীকালে বহুপত্নী গ্রহণের চল ব্যাপক ভাবে প্রচলিত হল। হয়তো মনু ও অন্যান্য স্মৃতিরশাস্ত্রের থেকে সে যুগের পুরুষেরা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। রামায়ণে, মহাভারতে বেশিরভাগ পুরুষের বহুপত্নী। যদিও দৌপদ্রীর পঞ্চ স্বামী ছিল। মহাভারতের যুগ অবশ্য মনুসংহিতা রচনার সময়কালের সমসাময়িক; ঐতিহাসিকবিদরা বলে থাকেন।

           মহাভারতীয় ঐতিহ্যের পর এল কৌলীন্য প্রথা। কৌলীন্য প্রথা বিশেষ ভাবে প্রচলিত ছিল বঙ্গদেশে ও মিথিলায়। কৌলীন্য প্রথার সুযোগ নিয়ে এক এক পুরুষ এক-দেড়শো বিবাহ পর্যন্ত করত। এমনকী গঙ্গাযাত্রী কুলীন বৃদ্ধের সঙ্গে কুলীন কন্যার বিবাহ দিয়ে বংশের কৌলীন্য রক্ষা করত কুলীন গোষ্ঠী।

           সাধারণত হিন্দু সমাজে পাত্রীর থেকে পাত্রের বয়স বেশি থাকে। আগেকার দিনে আরও বেশি বয়সের পার্থক্য থাকতো। ফলে স্বামী মারা গেলে বিধবা স্ত্রী যৌবনবতী থাকত। সে যুগে বাল্যবিবাহ হতো বলে, বিধবা হলে গৃহবধূ তখনও বালিকা থাকত। আর একজন কুলীন মারা গেলে একসঙ্গে শতাধিক বিভিন্ন বয়সের নারী বিধবা হতো। এই বিধবা নারীদের সমাজের বোঝা স্বরূপ দেখা হতো। সহমরণ নিষিদ্ধ হলে সেটা আরও বাড়ল। এই সব বিধবা পরিবারে অত্যাচারিত, সমাজে উপেক্ষিত হয়ে অনেকেই নগরবধূতে রূপান্তরিত হতো। তাছাড়া অল্পবয়সী বিধবাদের জৈবিক চাহিদা তো থাকেই। সেই প্রলোভনে পদস্ফলন হলে সমাজ তার স্থান নির্ধারন করে দিত রূপোপজীবীনিদের হাটে।

           মুসলিম সমাজে বহুবিবাহ, অবৈধ তালাক, ঘর থেকে বহিষ্কার মেয়েদের বিপন্নতা বাড়িয়েছে এবং সহজেই তারা পাচারের শিকার হয়েছে। কিছুদিন আগে জনপ্রিয় পত্রিকায় একটি প্রতিবেদন বেরিয়েছিল— বাংলাদেশের এক যুবককে গুজরাটের সুরাটে গ্রেফতার করা হয়। সে বিয়েকে হাতিয়ার করে ২০০ মেয়ে পাচার করেছিল।

           সমাজে যদি বৈদিক যুগ, স্মৃতির যুগের মতো নারীদের দ্বিতীয় বিবাহের সুযোগ থাকতো, তাহলে হয়ত পতিতাপল্লীগুলি এত ভরে উঠতো না। নারীর বৈবাহিক পরাধীনতা, পুরুষের বহুবিবাহ নারী পাচারের পথকে যুগে যুগে প্রশস্ত করেছে।

তথ্য ঋনঃ-

১. মনুসংহিতা – ভাষান্তর চৈতালী দত্ত (নবপত্র প্রকাশন)।

২. ভারতের বিবাহের ইতিহাস – অতুল সুর (আনন্দ পাবলিশার্স)।

৩. পাচার চলবে, আর সবাই চুপ? – খাদিজা বানু (আনন্দবাজার পত্রিকা, ২রা জুন ২০২২)।