পর্ব ২৪

(আইপিএস সুখেন্দু হীরা বর্তমানে কলকাতা পুলিশের ডেপুটি কমিশনার (DCP)। নারী পাচার নিয়ে ধারাবাহিক ভাবে লিখছেন বালিহাঁস-এর পাতায়।)

জীবের বংশবৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন যৌনমিলন। এই যৌনমিলনের পথ সুগম করে দিতে মনুষ্য সমাজে বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানের আমদানি। যা অন্যান্য প্রাণীদের ক্ষেত্রে প্রয়োজন হয়নি। এর কারণ আগের পর্বে আলোচিত হয়েছে। প্রাণীকূল বংশবিস্তার ছাড়া অন্যান্য সময় যৌনমিলনে রত হয় না। মানুষ কিন্তু শুধু সন্তানের জন্ম দেওয়া ছাড়াও বিনোদন হিসাবে যৌনমিলনকে ব্যবহার করে। প্রাণীদের মধ্যে ডলফিন নাকি মানুষের মতো সন্তান উৎপাদন ছাড়া অন্যান্য সময়েও সঙ্গম করে। এই যৌন বিনোদন নারীপাচারের মূল কারণ হিসাবে বলা যায়। এই যৌন বিনোদন নানা কারণে মানুষের (নারী ও পুরুষ উভয়ের) প্রয়োজন হতে পারে। তাকে পূরণ করার নানা পন্থা মানুষ গ্রহণ করে। পুরুষদের বিনোদন বা যৌন বিনোদনের জন্য নারীর প্রয়োজন আছে, তার সরবরাহ করার জন্য নারীপাচারের পথও খোলা।

         বিনোদনের জন্য নারীর প্রয়োজন— এর একটা কারণ হিসাবে অনেকে বলে থাকেন, ঘরে বিয়ে করা স্ত্রীর প্রতি স্বামীরা কিছুদিন পর আকর্ষণ হারিয়ে ফেলেন। সন্তানাদি জন্মানোর পর বয়সজনিত কারণে মেয়েদের চেহারার জৌলুস সাধারণ ভাবে অনেকটা কমে যায়। তখন পুরুষ অন্য নারীর প্রতি মনোযোগী হয়। জৈবিক ভাবে পুরুষদের যৌবন দীর্ঘস্থায়ী। নারীদের যৌবন ততটা দীর্ঘস্থায়ী নয়। এই সব তথ্য উল্লেখ করা মানে এই নয় যে পুরুষের যৌবন দীর্ঘস্থায়ী বলে ঘরের বৌ ফেলে সবাই পরকীয়ায় মাতেন।

         বাস্তবে আর এই সমস্যা বেশি দেখা যায় বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে বা যে সব ছেলেরা অল্প বয়সে বিয়ে করে, তাদের ক্ষেত্রে । তার স্ত্রী সাধারণত তার সমবয়সী হয়। একই বয়সে স্ত্রী বেশি বুড়িয়ে যায়, ছেলেটি অন্যান্য নারীসঙ্গে আকৃষ্ট হয় এবং সাংসারিক জীবনে নানা জটিলতা সৃষ্টি হয়।

        সাধারণ ভাবে বলা যেতে পারে, যেখানে গেলে কোন জটিলতা ছাড়া নারীসঙ্গ মেলে তা হল যৌনপল্লী। সেখানে শুধু অর্থ খরচ করলেই হলো।

         বিনোদন মানে তো শুধু যৌনতা নয়। পান-ভোজন, নির্মল আমোদ-প্রমোদ, কাব্য-সংগীত-নৃত্য চর্চা, সবই বিনোদন। সুদৃর অতীতের দিকে যদি তাকাই, বৈদিক যুগে নারী পুরুষ সমান তালে চলতো, একই সঙ্গে তারা বিনোদনে অংশগ্রহণ করতো, তাই পুরুষদের জন্য আলাদা করে বিনোদনের আয়োজন করার দরকার পড়ত না। স্মৃতির যুগে মেয়েদের গৃহবন্দি করে ফেলা হল। নারীকে ঘরের লক্ষী ও সন্তানের জননী রূপে ঠাঁই দিয়ে পুরুষ আমোদ প্রমোদের সঙ্গী হিসাবে নারীকে হারিয়ে ফেলল। তাই ঘরের বাইরে আমোদ প্রমোদের পুরুষদের সঙ্গী হিসাবে তৈরি হল নগরনটী।

         মৌর্য যুগে ও গুপ্ত যুগে নগর বধুরা ছিলেন শিক্ষিতা, নানা শিল্পকলায় পারদর্শী ও স্বাধীন। সে যুগের রাষ্ট্রীয় ব্যয়ে গণিকাদের সর্ব বিদ্যায় পারদর্শিনী করত। তাদের আয় থেকে রাষ্ট্র রাজস্ব আদায় করত।

            মৌর্য যুগে রাজকুলের সেবার জন্য গণিকাকন্যা বা অন্য কোন রূপবতী কলাবতী যুবতীকে বছরের ১০০০ পণ বেতন দিয়ে রাজগণিকা রূপে নিযুক্ত করা হতো। তার কাজ ভাগ করে নেওয়ার জন্য প্রতিগণিকাও নিযুক্ত করা হত। গণিকার আকর্ষণীয় ক্ষমতার অনুসারে রাজার ছত্র ও ভৃঙ্গার; ব্যজন ও শিবিকা; পীঠিকা ও রথের সঙ্গী হত। তাদের বয়স হয়ে গেল নবনিযুক্ত গণিকাদের প্রশিক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া হতো। এগুলি দেখভালের জন্য একজন গণিকাধ্যক্ষ থাকত।

           সে সময় সারা ভারতের মন্দিরগুলোতে দেখা গিয়েছিল দেবদাসী প্রথা। দেবতাদের দাসী হিসাবে সুন্দরী নারীদের নিয়োগ করে ঐ মন্দিরের পুরোহিত, ঐ অঞ্চলের প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তিদের মনোরঞ্জনের কাজে লাগানো হত। দেবতার নাম করে নিজেদের বিনোদনের ব্যবস্থা।

           হিন্দুদের পুরাণ ও ধর্মগ্রন্থগুলি এর থেকে ব্যতিক্রম নয়। পুরাণে স্বর্গের অপ্সরারা হলেন সুরবেশ্যা। তারা স্বর্গের দেবতাদের চিত্ত বিনোদন করতেন। দেবরাজ ইন্দ্রের সভায় তারা শোভাবর্ধন করতেন। আবার পান থেকে চুন খসলে তাদের মর্তে পতিত হয়ে মানুষের মতো দুঃখ কষ্ট ভোগ করতে হতো। ইতিহাসেও গণিকাদের বাণিজ্য বিধি না মানার জন্য শাস্তি পেতে হতো। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে আছে- রাজাজ্ঞা পেয়েও কোন গণিকা সেই পুরুষবিশেষের কাছে না গেলে তার হাজার বেত্রাঘাত বা ৫,০০০ পণ দণ্ড হবে। সম্ভোগের মূল্য পেয়েও পুরুষবিদ্বেষী হয়ে তার কাছে না গেলে গণিকাকে প্রাপ্ত মূল্যের দ্বিগুণ, বা কৌশলে সেই পুরুষকে ভোগ করতে না দেয় তবে তাকে আটগুণ দণ্ড দিতে হবে। তবে পুরুষটির গুপ্ত বা সংক্রামক ব্যাধি থাকলে কোন দণ্ড হবে না।

          ইতিহাসের পথ ধরে এগিয়ে এলে দেখতে পাবো মধ্যযুগে একই ব্যবস্থাপনা ছিল। আধুনিক যুগে একই ব্যবস্থা আছে শুধু অন্য মোড়কে। শহরে, বন্দরে, তীর্থস্থানে, পর্যটক স্থলে বিনোদনের অন্যতম ক্ষেত্রগুলি হল পতিতাপল্লী বা হোটেল-লজ। বর্তমান যুগে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সিঙ্গিং-বার, ডান্সিং-বার, ম্যাসাজ পার্লার ইত্যাদি। সবেতেই কিন্তু প্রয়োজন নারী কর্তৃক পরিষেবা। সবগুলি হয়তো অনৈতিক বা বেআইনী নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এগুলি নারী শোষণের জায়গা। মডেলিং, সিনেমা, নাটক, যাত্রা-সহ বিভিন্ন অভিনয় বা বিনোদনের জগতে নারী অংশগ্রহণ আজ অগ্রগণ্য। তবুও সেখানে নারীদের নানা হয়রানি বা শোষণের সম্মুখীন হতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে এই জগতের মেয়েরা আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়। পদস্খলনের পর রূপজীবীনির পেশা ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না। সব মিলিয়ে বিনোদন জগৎ নারীর কলা-কুশলতাকে মর্যাদা দিলেও মানসিক নিরাপত্তা দেয়নি। শুধু তাই নয় কিছুটা হলেও নারীপাচারের জগৎকে সমৃদ্ধ করেছে।

         রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় অবশ্য এই বিনোদনের ক্ষেত্রগুলি হয়তো চলে না। কিন্তু রাষ্ট্রের জনগণ যৌন-বিনোদন ব্যবস্থা এগুলিকে টিকিয়ে রেখেছেন। উদারপন্থীরা বলেন এগুলির প্রয়োজন আছে। পুরুষের যেমন আছে, নারীরও তেমনি আছে। শুধু দেখা উচিত, কেউ যেন বাধ্য না হয় এই যৌন বিনোদনের পণ্য হতে।

তথ্যঋণঃ-

১. কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র – সুকুমার সিকদার – (অনুষ্টুপ)

২. ক্ষেত্র সমীক্ষা।