পর্ব ৪৩

মোহসীন-উল-হাকিম ২০০০ সাল থেকে সাংবাদিকতা করছেন । ২০০৯ সালে আইলা ঝড়ের পরে বাংলাদেশের দেশ টিভির প্রতিবেদক হিসেবে সুন্দরবনে পৌঁছন । প্রান্তিক মানুষের জীবন জীবিকা নিয়ে তিনি কাজ করে চলেছেন । সুন্দরবনকে জলদস্যুমুক্ত করতে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি।  তাঁর মধ্যস্থতাতেই ৩২৮ জন জলদস্যু আত্মসমর্পণ করেছেন ।

মজনু আর ইলিয়াস বাহিনী আত্মসমর্পণ করলো ২০১৬ সালের জুলাই মাসে। তাদের আত্মসমর্পণ আমার সুন্দরবনকে দস্যু মুক্ত করার প্রচেষ্টাকে আরও উৎসাহিত করলো। এদিকে আরও কয়েকটি দস্যুদল আমার সঙ্গে নিয়মিত ভাবে যোগাযোগ রাখছিল। তাদের মধ্যে ছিলো জাহাঙ্গীর বাহিনী , নোয়া বাহিনী। এছাড়াও ছোট রাজু , আলিফ— এই রকম বেশ কয়েকটি বাহিনীর সাথে আমার যোগাযোগ চলছিল। তাদের সাথে কথাবার্তা এগিয়ে নিয়ে গেলেও আত্মসমর্পণের ব্যাপারে তাদের থেকে চূড়ান্ত  কোনও সদিচ্ছা দেখতে পাচ্ছিলাম না। সেই সময় আমার সঙ্গে যোগাযোগ করলেন পশ্চিম সুন্দরবনের আলম বাহিনীর প্রধান আলম।

আলম বাহিনীর সম্পর্কে একটু জানা যাক। এরা সুন্দরবনের বড় বড় বাহিনীগুলির সঙ্গে মিলিত ভাবে দস্যুতা করতো। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল মোতালেব বাহিনী ও মজনু বাহিনী। পরবর্তীতে আলম একাই দল গঠন করেন। খুব বেশি বড় দল নয়, মাঝারি দল। তার মূল লক্ষ্য ছিল সাগরে দস্যুতা করা।

সেই মতো খোকন মাঝির সাথে একটা চুক্তি হয় আলমের। আগের একটি পর্বে খোকন মাঝির কথা বলেছিলাম যে , সাগরে যারা দস্যুতা করতে যায় তাদের ট্রলার দিয়ে এমন কি অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সাহায্য করে। আলম বাহিনী এই খোকন মাঝির থেকে ১১টি বন্দুক ও ১৮শো গুলি কিনবে। সেই অস্ত্র নিয়েই সাগরে দস্যুতা শুরু করবেন আলম। আমাকে এই খবর দিয়েছিলেন আলিফ বাহিনীর প্রধান আলিফ। সবটা শুনে আমার মনে হলো এই কাজটা হতে দেওয়া যায় না। আলম বাহিনী যদি সাগরে দস্যুতা করতে যায়, তবে আমার এই সুন্দরবন দস্যু মুক্ত করার অভিযানে আঘাত আসতে  পারে। আমি খবর দিলাম মেজর আদনানকে। আদনান বরিশাল RAB এর উপ-অধিনায়ক। খবর একেবারে সঠিক ছিল। পটুয়াখালীর চর মন্তাজে খোকন মাঝির এক গোপন ডেরা থেকে উদ্ধার হল সেই সব অস্ত্র। ভেস্তে গেল আলমের সাগরে দস্যুতা করার ইচ্ছে। 

এই ঘটনায় বিশাল ধাক্কা খেলেন আলম। অস্ত্র ও গুলি কেনার জন্য ছৃয লাখ টাকা আগাম দিয়েছিলেন। সেই টাকাও মার গেলো তার।

আলমের সঙ্গে আমার কখনও দেখা হয়নি, কথাও হয়নি। তবু আলম আমাকে ফোন করে বললেন , ” ভাই আমি আত্মসমর্পণ করবো। আমাকে আজকেই এসে নিয়ে যান।’’ এদিকে পূর্ব সুন্দরবনের আরেকটা গ্রুপ ছিল শান্ত বাহিনী। শান্ত বাহিনীর প্রধান বারেক তালুকদারও যোগাযোগ করলেন।

আমি তাদের সাথে পরিকল্পনা করি যে ২০১৬ সালের ১২ আগস্ট আলমের ডেরা থেকে আলমকে তুলে আনবো। আর বারেককে আনবো পরের দিন, মানে ১৩ আগস্ট।

আলমকে সাতক্ষীরার গভীর বন থেকে তুলতে গেলাম। সেই সময় আমার কাছে খবর আসলো যে শ্যালা নদীতে থাকা শান্ত বাহিনী আত্মসমর্পণ করার জন্য এতটাই অস্থির হয়ে পড়েছে যে তারা নৌকা বহর নিয়ে অনেকটা এগিয়ে এসে পড়েছে। পূর্ব সুন্দরবনের শ্যালা নদীর আন্ধারমানিকের কাছে একটি খালে অবস্থান নিয়েছিলো তারা। এরই মধ্যেই ফরেস্ট ও কোস্টগার্ড তাদের অবস্থান জেনে গেছে। তারাও প্রস্তুত শান্ত বাহিনীর সাথে এনকাউন্টারের জন্য। আমার মনে হলো এটাও হতে দেওয়া যায় না। এই মুহূর্তে যে বাহিনী আত্মসমর্পণ করতে চাইছে, তাদের উপর গোলাগুলি চললে আমাদের প্রক্রিয়া গতি হারাতে পারে। তখন আমি বারেককে ফোন করে বললাম ” ভাই তোমাদের অবস্থান মানুষ জেনে যাচ্ছে। তুমি এগিয়ে আসছো কেন ?

খবর পেলাম শান্তদের ওপর আক্রমণ হতে পারে। আর বিষয়টা তাহলে খুবই খারাপ হবে এবং আত্মসমর্পণের উদ্যোগ মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

সাতক্ষীরার পশুরতলায় আলমের ওখানে বিদায়ী খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন চলছিল। সেজন্য আস্ত একটা ছাগল নিয়ে গিয়েছিলাম। রান্নাবান্নার বিরাট আয়োজন চলছিল। এমন সময় খবর পেলাম যে ওদিকের খুবই খারাপ অবস্থা। বারেককে ফোন করে বললাম ,” আমরা এখনই রওনা হচ্ছি। “

তখন তারা বললেন ,” আপনাদের তো আগামিকাল আসার কথা। “

আমি বললাম ,” আপনি বিপদে আছেন, আমি রওনা হচ্ছি। “

(ক্রমশ )

2 COMMENTS

  1. পড়লাম খুব ভালো লাগলো
    আপনাকে ধন্যবাদ জানাই

Comments are closed.