পর্ব -৪১

মোহসীন-উল-হাকিম ২০০০ সাল থেকে সাংবাদিকতা করছেন । ২০০৯ সালে আইলা ঝড়ের পরে বাংলাদেশের দেশ টিভির প্রতিবেদক হিসেবে সুন্দরবনে পৌঁছন । প্রান্তিক মানুষের জীবন জীবিকা নিয়ে তিনি কাজ করে চলেছেন । সুন্দরবনকে জলদস্যুমুক্ত করতে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি। তাঁর মধ্যস্থতাতেই ৩২৮ জন জলদস্যু আত্মসমর্পণ করেছেন ।

মাস্টার আর তার দলের বেশ কয়েকজন আত্মসমর্পণ করল। যা ছিল সুন্দরবনের জন্য একটা অভূতপূর্ব ঘটনা। কিন্তু তার পরেও আমার মনে ছিল আশঙ্কা। আমি ভাবতে শুরু করেছিলাম, অনেক বড় একটা কাজ হল। কিন্তু সমস্যার সমাধান হল কি? এখনও তো সুন্দরবনের ভেতরে জলদস্যুদের অনেকে বাহিনী আছে। এদের কি হবে? এদের কি ফেরাতে পারবো মূলস্রোতে?

আশঙ্কার বড় কারণও ছিল। কেননা, যারা একটু খোঁজ রাখে, তারা সবাই জানে, জলদস্যু বা বনদস্যুরা অনেক সময়েই নিয়ন্ত্রিত হয় ডাঙা থেকে। সেই বাধা কাটিয়ে কি স্বাভাবিক জীবনে ফেরানো যাবে অসংখ্য জলদস্যুর দলগুলিকে? তারাই বা কি ফিরে আসার আগ্রহ দেখাবে? তবে মাস্টারের আত্মসমর্পণের আগে পর্যন্ত আমি কিন্তু ঘুণাক্ষরেও চিন্তা করিনি যে আমাকে আরও অনেক দুর্ধর্ষ দস্যুবাহিনীকে নিয়ে কাজ করতে হবে।  মাস্টারের সারেন্ডারের পর আমি বুঝতে পারছিলাম, থেমে  যাওয়া ঠিক হবে না বরং কাজের গতি আরও বাড়াতে হবে।  মনে আসছিল পুরোপুরি দস্যুমুক্ত সুন্দরবনের স্বপ্ন।

মাস্টারের আত্মসমর্পণের ঘটনার পরে পরে আমি ফোন পেলাম জাহাঙ্গীর বাহিনীর জাহাঙ্গীরের। এছাড়াও নোয়া মিঞা-সহ আরও কয়েকজন দস্যুনেতা আমাকে ফোন করলো। তাদের সবার একটাই প্রশ্ন— যারা আত্মসমর্পণ করল তাদের কি ক্রসফায়ার দেওয়া হয়েছে নাকি মাস্টারের দল এখনও বেঁচে আছে? তাদের মধ্যে এই একটা সন্দেহ ছিল।

কিন্তু সেই সব কিছুই ঘটেনি। মাস্টাররা আইন মতো সমস্ত পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে জেলে আছে শুনে আমাকে ফোন দিল পশ্চিমের (সাতক্ষীরা অঞ্চল ) বড় দস্যু বাহিনীর প্রধান মজনু।

মজনু আমাকে ফোন করে বলল, ভাই আমি আত্মসমর্পণ করবো।

শুরু হলো আমার  আবার নতুন করে পথচলা।  

আগেই বলেছি, সুন্দরবনের জলদস্যু বা বনদস্যুদের ব্যবসা জল,বন, ডাঙা সব জায়গা থেকে নিয়ন্ত্রিত হয়। বনের বা জলের যারা দস্যু এবং এই ব্যবসার অংশীদার— তাদের নিবৃত করার চেষ্টা হলেও ডাঙায় যারা বসে আছে, সেই গডফাদারদের বিরুদ্ধে কোনও অভিযান হয়নি। তারা সবাই আছে নিজেদের মতো বহাল তবিয়তে। কেউ তাদের ছুঁতে পর্যন্ত পারেনি। সুন্দরবনের জলদস্যুদের কাঁচা টাকার ব্যবসা। কোটি কোটি টাকার খেলা হয় সেখানে। আমার আশঙ্কা হল, এই ডাঙার গডফাদাররা এখন চুপ করে থাকলেও পরিস্থিতি বুঝে আবার যে মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে না তার কোনও গ্যারান্টি নেই। তাই সাময়িক সুন্দরবনের শান্তি ভবিষতে আবার অশান্তির কালো মেঘে ঢাকা পড়বে না—  এমনটা বলা যায় না।  

বাংলাদেশ  প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ একটি দেশ। এই দেশের অর্থনীতির উন্নতির একটি বড় অংশ নির্ভর করে প্রাকৃতিক সম্পদের উপর। বাংলাদেশের সামগ্রিক অভ‌্যন্তরীন সম্পদের (GDP ) প্রায় চার শতাংশ আসে মৎস উৎপাদনের থেকে।  কিন্তু সেটাই যখন অনৈতিক ভাবে ব্যবহার হয়, তখন দেশের উন্নতি ব্যাহত হয়। সেই সঙ্গে দুর্বিষহ হয়ে ওঠে সুন্দরবনের জেলে, মাওয়ালী  ও বাওয়ালীদের জীবন। কিছু মানুষের লোভ সুন্দরবন অঞ্চলের প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষকে অসহায় করে রাখে। তাই যখন একবার সাফল্য পেয়েছি— আমার ইচ্ছে, আমি আবারও ঝাঁপিয়ে পড়ব এই কর্মযজ্ঞে। সুন্দরবনকে সম্পূর্ণ দস্যু মুক্ত করতে হবে। তবে আমার প্রথম কাজের পরে মানে মাস্টার বাহিনীর আত্মসমর্পণের পরে কিছু মানুষের মধ্যে অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া পেয়েছিলাম। প্রথম দিকে তারাই আমাকে খুব উৎসাহিত করতো। বলতো, সুন্দরবনের জলদস্যুদের সমস্যা একটা জলন্ত সমস্যা। কিন্তু পরে তাদের মধ্যেই কাউকে দেখেছি আমার কাজের সমালোচনা করতে। তারা পুরো ব্যাপারটাই এমন ভাবে জনসমক্ষে দাঁড় করাতো যে মনে হতো, এই যে মাস্টারবাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে— সেটা পুরোটাই একটা ফেক। একটা নাটক ছাড়া কিছু নয়। কারণটা পরে বুঝেছিলাম। সে কথা পরে বলবো।

যে জায়গা থেকে শুরু করেছিলাম, সেখানে ফিরে আসি।

মজনু বললো, আত্মসমর্পণ করবে। কিন্তু কাদের কাছে আত্মসমর্পণ করবে? ৱ্যাব-৮-এর সাথে একটা কাজ করেছি। আর ৱ্যাব- ৬ এর বাহিনী আমাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। তাই ৱ্যাব-৬-এর অধিনায়ক-সহ অন্য অফিসাররা আর আমাকে কিছু বলতে পারছেন না। বলত পারছেন না যে ‘‘ভাই আসুন, পরের কাজগুলি আমরা একসাথে করি।’’ তারা বিশ্বাস করতে পারেনি আমাকে। তারা  বিশ্বাস করতে পারেনি যে কোনও রকম ব্যক্তিগত স্বার্থ ছাড়া মোহসীন উল হাকিম এই কাজগুলি করেছে। তারা হয়তো ভেবেছিলেন, আমি কাড়ি কাড়ি টাকা নিয়ে মাস্টারের মতো জলদস্যুদের সেফ গার্ড করার ব্যবস্থা করছি।  তাই এবারও তারা আমার কাছে আসেননি। আমার সাথে ছিল ৱ্যাব-৮ এর উপ-অধিনায়ক মেজর আদনান কবির। আমাদের যাত্রা নতুন করে শুরু। আবার শুরু সেই শ্বাপদ সঙ্কুল পথচলার।

মাস্টার বাহিনীর জলদস্যুতা শেষ হলেও তখন  সুন্দরবন জুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে মজনু, ইলিয়াস-সহ আরও কয়েকটি বড় বাহিনী। যেতে হবে তাদের কাছে।

মাস্টার বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর কেটে গেছে প্রায় দেড় মাস। আমি গেলাম মজনুর কাছে। পশ্চিম সুন্দরবনের মালঞ্চ নদীর কালির খালে। মজনু ছিল সুন্দরবনের সাতক্ষীরা অঞ্চলের বড় দস্যুনেতা। কিছুদিন মাঝখানে দস্যুতায় বিরতি দিয়ে মজনু পাড়ি দিয়েছিল অন্য জায়গায়। তারপর আবার পরিস্থিতি অনুকূল হওয়ায় ফিরে এসেছে নিজের ডেরায়।

আত্মসমর্পণ করল মজনু। তার ৯ সদস্যের বাহিনী নিয়ে ধরা দিল ৱ্যাবের কাছে। তারিখটা ছিল ২০১৬ সালের ১৫ই জুলাই। মজনুর সাথে ধরা দিয়েছিল ইলিয়াস সহ আরও দু’জন।  সেই ইলিয়াস কিছুদিন আগে মারা গেছে।

বড় চতুর দস্যু ছিল এই ইলিয়াস। বলছি পরের পর্বে।

(ক্রমশ)

##বেশ কিছুদিন ব্যস্ত থাকার জন্য দুটি পর্ব সময় মতো লিখতে পারিনি। এজন্য পাঠকদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।