পর্ব ৪২

মোহসীন-উল-হাকিম ২০০০ সাল থেকে সাংবাদিকতা করছেন । ২০০৯ সালে আইলা ঝড়ের পরে বাংলাদেশের দেশ টিভির প্রতিবেদক হিসেবে সুন্দরবনে পৌঁছন । প্রান্তিক মানুষের জীবন জীবিকা নিয়ে তিনি কাজ করে চলেছেন । সুন্দরবনকে জলদস্যুমুক্ত করতে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি। তাঁর মধ্যস্থতাতেই ৩২৮ জন জলদস্যু আত্মসমর্পণ করেছেন ।

ইলিয়াস! রাজু বাহিনীর একজন সাধারণ সদস্য ছিল এই ইলিয়াস। আমি যখন প্ৰথম দেখি ও ছিল একেবারে একটি বাচ্চা ছেলে। শারীরিক গড়নও ছোটখাটো। রাজুর বাহিনী ছেড়ে চলে যাওয়ার পর এই বাহিনীর নেতৃত্বে ছিল শহীদুল। কিন্তু শহীদুলের মৃত্যু হয় এনকাউন্টারে। তারপর নোয়া মিঞার দুর্বল নেতৃত্ব ইলিয়াসের সামনে এনে দিয়েছিল সুন্দরবনের এক দুর্ধর্ষ বাহিনীকে নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ। ইলিয়াস খুব অল্পদিনের মধ্যেই হয়ে উঠেছিল এক দুর্ধর্ষ নেতা। রাজুর যোগ্য উত্তরসূরি এই ইলিয়াস। একদিন তাকেও বাহিনী ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল। মাস্টারের আত্মসমর্পণের খবর পৌঁছলো ইলিয়াসের কাছে।

অজ্ঞাতবাসে থাকার সময় ইলিয়াস অস্থির হয়ে একাধিকবার ফোন করেছিল আমাকে।

— ভাই আমি কবে আসবো ? আমি আত্মসমর্পণ করবো।

— কেন আপনি তো ওখানে ভালই আছেন!

—ভাই আমি ভাল আছি ঠিকই। কিন্তু আমি বাড়ি ফিরতে চাই। জেলখানায় থাকতে হলে থাকবো। যদি আমার ক্রসফায়ার হয়, তা-ও ঠিক আছে। কিন্তু আমি বাড়ি যাবো।

আত্মসমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে উতলা হয়ে উঠেছিল ইলিয়াস। তার সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র লুকোনো ছিল সুন্দরবনের ভেতরে।

ইলিয়াসকে আমি সাতক্ষীরা সীমান্ত থেকে আমার ট্রলারে উঠালাম। সেখান থেকে ৱ্যাব-সহ সোজা ঢুকে গেলাম সুন্দরবনে। অবৈধ পথে সুন্দরবন থেকে সে বাংলাদেশে ঢুকেছিল। যাতে সে অন্য কোনও বাহিনীর হাতে ধরা না পড়ে, সেজন্য ইলিয়াসকে নিয়ে তার স্ত্রী-সন্তান-সহ আমরা সুন্দরবনের গহীনে চলে গেলাম।

বাটলো নদীতে গিয়ে অস্ত্র যেখানে লুকোনো ছিল, সেসব বের করল ইলিয়াস।  খুব ভাল মানের ৭টা অস্ত্র ছিল। গুলি ছিল কয়েকশো। সেই সব সমেত ইলিয়াস আত্মসমর্পণ করল। মজনু ও ইলিয়াস একসঙ্গেই আত্মসমর্পণ করল।

এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে, ইলিয়াসকে এভাবে আনুষ্ঠানিক ভাবে আত্মসমর্পণ করানোর কারণ কি ছিল? এর কারণ হচ্ছে ইলিয়াস ছিল একজন চৌখস বনদস্যু। সে ইচ্ছে করলেই সুন্দরবনে ফিরে গিয়ে ওই সাতটা অস্ত্র দিয়ে সত্তরটা অস্ত্র ও বিশাল বাহিনী গড়ে তুলতে পারতো। এই জন্যই কোনওরকম কালবিলম্ব না করে দ্রুত তার গোড়া উচ্ছেদ করা ছিল আমার লক্ষ্য।

মজনু আর ইলিয়াস আত্মসমর্পণ করেছিল ২০১৬ সালের জুলাই মাসে।

একটা কথা এখানে না বললেই নয়— এই যে মাস্টারবাহিনী বা মজনু বাহিনী বা ইলিয়াস— যারাই আত্মসমর্পণ করেছে, তাদের অনেকেই এখন মারাত্মক অভাবে দিন পার করেছে। কিন্তু কেউই আর দস্যুতায় ফেরেনি। সম্প্রতি শারীরিক অসুস্থতায় মৃত্যু হয়েছে ইলিয়াসের।

প্রথমে মাস্টার তারপর মজনু , ইলিয়াসের আত্মসমর্পণের পরে বিভিন্ন জায়গা থেকে আমার কাছে ফোন আসতে লাগল। সুন্দরবনের অন্যান্য বাহিনীর প্রধানরা যোগাযোগ করতে শুরু করল।

আমার মনে তখন একটাই ভাবনা— কি করবো ? যোগাযোগ করবো ওই বাকি দস্যুদের সাথে?

এইসময় আমি নিজের অফিস যমুনা টেলিভিশনে আমার প্রধান বার্তা সম্পাদক ফাহিম আহমেদের সঙ্গে আলাপ করলাম। তিনি এগিয়ে যাওয়ার সবুজ সঙ্কেত দিলেন।

নতুন করে আবার শুরু হলো। মেজর আদনানকে বললাম, আমি আরও কাজ করতে চাই। RAB সদর দফতরের বড় কর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু হলো আবার। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে গেলাম। সারেন্ডারের মাধ্যমে যে সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত করা সম্ভব— সেটা জানালাম। মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান খুবই সজ্জন মানুষ। বললেন, প্রধানমন্ত্রীও বিষয়টি খেয়াল রাখছেন। তিনিও চাইছেন এগিয়ে চলুক কাজ। ব্যাস। আমি পুরোদমে কাজ শুরু করলাম।

এদিকে পশ্চিম সুন্দরবনের দস্যুদল আলম বাহিনী ও পূর্ব সুন্দরবনের ত্রাস শান্ত বাহিনীর সঙ্গে কথা শুরু হয়েছে। শিগগিরই আত্মসমর্পণ করবে তারা…।

(ক্রমশ)