পর্ব ৪৮

(মোহসীন-উল-হাকিম ২০০০ সাল থেকে সাংবাদিকতা করছেন । ২০০৯ সালে আইলা ঝড়ের পরে বাংলাদেশের দেশ টিভির প্রতিবেদক হিসেবে সুন্দরবনে পৌঁছন । প্রান্তিক মানুষের জীবন জীবিকা নিয়ে তিনি কাজ করে চলেছেন । সুন্দরবনকে জলদস্যুমুক্ত করতে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি।  তাঁর মধ্যস্থতাতেই ৩২৮ জন জলদস্যু আত্মসমর্পণ করেছেন ।)

সাগর বাহিনীর পর আত্মসমর্পণ করলো খোকাবাবু। সেটা ছিল সুন্দরবনের ছোট একটা দস্যু বাহিনী। অবশ্য আজকে সেই দস্যুনেতার গল্প করবো না এখন। আজ লিখবো গুটগুটে বাবু’র কথা।

পশ্চিম সুন্দরবনের দস্যু মজনুর সাথে যেবার দেখা করতে গিয়েছিলাম, তখন অদ্ভুত এক ঘটনার মুখোমুখি হতে হয়েছিলাম।

মজনু ছিল পশ্চিম সুন্দরবন মানে সাতক্ষীরা এলাকার বড় দস্যু বাহিনীর প্রধান। তার সঙ্গে দেখা করতে রাতের বেলা তার ডেরায় গেলাম। পরের দিন সারাদিন একসাথে ছিলাম। দুপুরের দিকে আমরা যেখানে ছিলাম, সেই খালের নাম কালির খাল। সেই খালের একটা জায়গায় একদম কোনায় গিয়ে নৌকা রেখে আড়াল করে বসে গল্প গুজব করছি।  ওই সফরে ট্রলার ছেড়ে ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে ওখানে গিয়েছিলাম।

কালির খাল। জায়গাটা খুব সুন্দর, ছিমছাম।  একটা মাচা করে সেখানে বসে গল্প করছিলাম। হঠাৎ করে মানুষের হাঁটাচলা ও গলার শব্দ পেলো তারা। অবশ্য আমি তার কিছুই বুঝতে পারিনি। দূর থেকে ভেসে আসা শব্দগুলো শোনার মতো প্রখর শ্রবণ শক্তি আমার নাই। যাই হোক, সতর্ক হলো সবাই। সাথে সাথে আমাদেরও জানানো হলো যে কেউ আছে আশেপাশে।

বনের ভিতর দিয়ে আমরা হাঁটতে শুরু করলাম। হাঁটা বলা ঠিক হবে না। প্রায় দৌড়ে অনেকদূর চলে গেলাম। সশস্ত্র যারা ছিল তারা এদিক ওদিক চলে গেল। তাদের মধ্যে গুটগুটে বাবু ছিলো ওই দলের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড । আমাদের নিরাপদে সরিয়ে একজন দস্যুকে সাথে নিয়ে খাল পার হলো সে। তারপর বনের ভিতর দিয়ে হেঁটে চলে গেল সেই শব্দের উৎসের দিকে।

এক দেড় ঘণ্টা এভাবেই কাটলো চরম শঙ্কার মধ্যে। পরে আমরা বুঝতে পারলাম আসলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা কোনো দস্যুদল ছিল না আশেপাশে। আবার কালির খালের ওই নির্জন জায়গায় ফিরে এলাম। তার আধঘন্টা পর দেখলাম গান গাইতে গাইতে নৌকা বেয়ে পাশের খাল থেকে বাবু ফিরছে। নৌকাটা একজন জেলের। তাকেও ওরা ধরে নিয়ে এসেছে। যাকে ধরে নিয়ে এসেছে তার তো কাঁদো কাঁদো অবস্থা। মধ্যবয়স্ক এক ব্যক্তি। মজার কথা হচ্ছে , বাবু তার আপন মামাকে ধরে নিয়ে এসেছে। তিনি সুন্দরবনের একজন কাঁকড়া শিকারী।

ওই লোকটি আমাকে দেখে অসহায় ভঙ্গিতে বললেন— ভাই দেখেন কি অবস্থা। আমার আপন ভাগিনা আমাকে ধরে নিয়ে এসেছে।

তখন তার ভাগিনা বাবু বলল, আমারে বাড়ি উঠতি দিবা? আমি বাড়ি গেলে তো পিটাইয়া মাইরা ফেলবা তোমরা। জঙ্গলে যখন আসছো টাকা দিতে হবে। মামা-টামা চিনি না।

বিষয়টা হচ্ছে বাবু যদি বাড়িতে ফিরে যায় তবে খবর হয়ে যাবে যে ডাকাত বাড়িতে এসেছে এবং তাকে ধরে ওখানেই পিটিয়ে মেরে ফেলবে অথবা ৱ্যাবের হাতে ধরিয়ে দেবে। এইসব কারণে দস্যুরা বাড়িতে ফিরতে পারতো না।

সুন্দরবনে দস্যুদের আত্মসমর্পণ তখন মাঝামাঝি পর্যায়ে। আমি মংলার জয়মনি এলাকায় গেছি। ওখানে বশির  নামে একজন আত্মসমর্পণ করেছিল। তাকে দেখতে গিয়েছিলাম। সারেন্ডারের পর বশির ওখানে মাছ ও কাঁকড়ার ব্যবসা করতেন।

জয়মনি অঞ্চলটা হচ্ছে মংলার একদম শেষ মাথায়। সেলা নদীর যে মোহনা, পশুর- সেলার একদম ওই কোণটাতে। বশিরের দুই ভাগিনা— একজন জুলফিকার, আরেকজন মোর্তাজা। তারা বেশ প্রভাবশালী বনদস্যু ছিল। পুরো পূর্ব সুন্দরবন দাপিয়ে বেড়াতো ওই দু’জন।  দুইজনই ক্রসফায়ারে মারা গেছিল। তাদের দুইজনের কবর পাশাপাশি দেয়া।

আমি দুই ভাইয়ের কবর দেখতে গেলাম। কারণ, ওদেরকে আত্মসমর্পণ করানোর চেষ্টা আমি করেছিলাম। কিন্তু তারা তখন সেভাবে সায় দেয়নি।

জুলফিকার বলেছিল— দেখবো নে।

যাই হোক, ওখানে গিয়ে কবরের পাশে দাঁড়িয়েছি তখন পিছন থেকে তাদের মা এলেন। আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করলেন।

কাঁদতে কাঁদতে বললেন – বাবারে দুইটা বছর আগে আসলা না তুমি। আমার ছেলে দুইটারে তাহলে মরতে হতো না। তারা আজকে বাড়িতে থাকতো।

আমি বললাম, খালাম্মা , আমি তো ওদের বলেছিলাম। তারা তো কথা শোনেনি।  আত্মসমর্পণের আহ্বানে সাড়া দেয়নি ওরা।

(ক্রমশ )