(আইপিএস সুখেন্দু হীরা বর্তমানে কলকাতা পুলিশের ডেপুটি কমিশনার (DCP)। নারী পাচার নিয়ে ধারাবাহিক ভাবে লিখছেন বালিহাঁস-এর পাতায়।)

            কলকাতায় উনিশ শতকের প্রথম দিক থেকে বেশ্যাবৃত্তি প্রতিরোধের আন্দোলন শুরু হয়। সে যুগে পুরুষেরা ঘরে স্ত্রী থাকতে রাতে ‘বারমুখো’ হবে; এটা কোনও দোষের ব্যাপার ছিল না। পাশ্চাত্য শিক্ষার আলোতে আলোকিত হয়ে সকলের মধ্যে গার্হস্থ্য দায়বদ্ধতা, পরিবারের প্রতি কর্তব্য, নৈতিক চরিত্র ইত্যাদি বিষয়ে কিছুটা সচেতনতা গড়ে ওঠে। তাই এই আন্দোলন বলা যেতে পারে।

           কলকাতা পত্তনের পর থেকেই বাবুদের মধ্যে রাঁড় রাখার একপ্রকার প্রতিযোগিতা চলত। পদস্থ বা ধনী ব্যক্তিরা তাদের রক্ষিতাদের পাকা বাড়ি করে দিয়ে তাদের মান-মর্যাদার পরিচয় দিতেন। শুধু তাই নয়, সমাজের প্রায় সর্বস্তরের পুরুষদের গণিকালয়ে যাওয়াটা সম্ভ্রমের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ফলে শহরে সম্ভ্রান্ত নাগরিকদের বসতির আশপাশে পতিতালয় গড়ে ওঠে। এর ফলে এইসব পল্লীর নৈতিক পরিবেশ কলুষিত হচ্ছিল। তার বিবরণ সেকালের সংবাদপত্রে প্রকাশিত হতো। পতিতালয়ের সামনের রাস্তা দিয়ে কোন ভদ্রলোক গমন করলে তাদের বেশ্যাদের কুভাষা, কদর্যালাপ সহ্য করতে হতো। স্কুলের কাছে বেশ্যালয় থাকাতে ছাত্রদের চরিত্র খারাপ হবার আশঙ্কা প্রকাশ করে সংবাদপত্রে চিঠিপত্র লিখতেন অনেকে। ১৮৫৬ সালের বিদ্যোৎসাহী সভার পক্ষ থেকে কালীপ্রসন্ন সিংহ (হুতোম পেঁচা) আন্দোলন করেন শহরের নির্দিষ্ট অঞ্চলে বারাঙ্গনাদের বসতি সীমাবদ্ধ রাখার জন্য। এর আগে কেশব সেন, শিবনাথ শাস্ত্রী, গৌরশঙ্কর তর্কবাগীশ প্রমুখ ব্যক্তিরা এবিষয়ে চিন্তাভাবনা করেন। শুধু তাই নয় এঁরা পতিতা উদ্ধার করে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে এগিয়ে এসেছিলেন।

       ১৮৬৭ সালে কলকাতা শহরের হেলথ অফিসার তৎকালীন কলকাতার মেয়র স্টুয়ার্ট হগ্‌ সাহেবকে Contagious Diseases নিয়ে একটি খসড়া আইন জমা দেন। এই আইনে বেশ্যাদের নাম পঞ্জিকরণ করা আবশ্যিক ছিল। এই আইন প্রণয়ন করার উদ্দেশ্য ছিল ইউরোপীয়দের মধ্যে যৌন রোগের নিয়ন্ত্রণ। কারণ তাদের পরিবার বিচ্যুত হয়ে এসে এখানে দেশীয় দেহপসারিনীদের সহচর্য্য নিতেই হতো। সহজেই তারা যৌনরোগে আক্রান্ত হতো। এই আইনে পতিতা উদ্ধার, মেয়েদের পতিতাপল্লীতে আসার পথ প্রতিরোধের ব্যাপারে কোন ব্যবস্থা ছিল না। দেশীয় জনগণের উপকারের কথা ভেবে আইন রচিত হয়নি।

          যাই হোক, এই খসড়া আইন ১৮৬৮ সালে ইন্ডিয়ান কনটাজিয়াস ডিজিস অ্যাক্টে পরিণত হল। এই আইনে বেশ্যাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা আবশ্যিক করা হল। এর ফলে সিফিলিস, গনোরিয়া, প্রভৃতি যৌন রোগ কিছুটা প্রতিরোধ করা যাবে। এই আইনে শহরের কিছু নির্দিষ্ট এলাকায় বেশ্যাদের বসবাস বন্ধ করা হল। এই আইনটি ১৮৬৮ সালে ১৪ নং অ্যাক্ট। তাই এই আইন ‘চৌদ্দ আইন’ বলে খ্যাতি লাভ করে। তখন সমস্ত পত্রপত্রিকায় এই আইনের দারুন সমালোচনা হয়েছিল। বটতলাতে প্রকাশ হয়েছিল ‘বাহবা চৌদ্দ আইন’ (১৮৬৯) বই।

        এই আইন বলবতের জন্য মাসে পাঁচ হাজার টাকা খরচ হতো। সে যুগে পাঁচ হাজার অনেক টাকা। যেখানে আমাশয় ও অন্যান্য ট্রপিক্যাল ডিজিজের তুলনায় যৌন রোগের প্রকোপ অনেক কম, সেখানে এই আইনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুললেন। এই পাঁচ হাজার টাকা বেশ্যাদের কাছ থেকে বিশেষ কর ধার্য করা হল। এই আইনের ফলে শুধুমাত্র দেশে বসবাসকারী ইউরোপীয়দের লাভ হয়েছিল। ফোর্ট উইলিয়ামের সৈনিকদের যৌন রোগ এক দশকে অনেকটা কমে গিয়েছিল। এইসব কারণে আইন জনপ্রিয় হয়নি, কিছু দিন বাদে এই আইন উঠে যায় (১৮৮১ সালের পর)।

        সেসময় কলকাতার মিশনারি কনফারেন্স সোশ্যাল পিউরিটির জন্য সভা ডেকেছিলেন। সেই সভায় প্রোটেস্টান্ট মিশনারি, রোমান ক্যাথলিক, পার্শী, হিন্দু, মুসলমান সকলে যোগ দিয়েছিলেন। তারা বেশ জোরের সঙ্গে দাবি জানিয়েছিল, অল্পবয়সি মেয়েদের কেনাবেচা যে কোনও মূল্যে বন্ধ হোক। তারা ঠিকই ধরেছিলেন সাপ্লাই লাইন বন্ধ না হলে এই সমস্যার কোনদিন প্রতিকার হবে না। তারা এও দাবি করেছিলেন, আইন রদবদল করে ‘লালকুঠি’ অর্থাৎ বেশ্যালয় চালানো দণ্ডনীয় অপরাধ বলে ঘোষণা করা হোক।

       তৎকালীন পুলিশ কমিশনার স্যর জন ল্যাম্বার্ট বলেছিলেন, চলতি আইনেই লালকুঠি বন্ধ করা যাবে, তবে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ চাই। ১৮৯২ – ১৮৯৪ অনেক পতিতালয় বন্ধ হয়ে যায়। অনেকে কলকাতা ছেড়ে বোম্বাই (বর্তমান মুম্বাই) -এ আশ্রয় নেয়।

         এর অনেক পরে ১৯২৩ সালে এল Calcutta Suppression of Immoral Traffic Act। এই আইনে প্রকৃতপক্ষে পতিতাবৃত্তি হ্রাসের চেষ্টা করা হল। এই আইনে এল-

ক) কোনও মেয়েকে ফুসলে নিয়ে যাবার জরিমানা বৃদ্ধি।

খ) ১৬ বছরের কম বয়সী মেয়েকে পতিতালয় থেকে উদ্ধার করার ক্ষমতা দেওয়া কলকাতা পুলিশকে।

গ) পুলিশের ক্ষমতাবৃদ্ধি করে পতিতালয় উচ্ছেদ।

ঘ) পুলিশ কমিশনারকে ক্ষমতা দেওয়া হল – মেয়ে পাচারকারী, দালাল, পতিতালয় মালিকদের কলকাতা পুলিশের এলাকা থেকে বার করে দিতে পারে।

ঙ) প্রত্যেক পঞ্জীভূক্ত (registered) পতিতাকে সরকারের তরফ থেকে ডাক্তারি পরীক্ষা করা।

চ) যৌন রোগের কোনও প্রমাণ পাওয়া গেলে ‘খদ্দের বসাতে’ বারণ করা। এছাড়া পতিতালয়ের মাসিকেও সতর্ক করে দেওয়া, যাতে ঐ সব পতিতা ‘খদ্দের বসাতে’ না পারে।

ছ) যৌন রোগ হলে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া আবশ্যিক ছিল। পরে হাসপাতাল থেকে ছুটি পেলে রিপোর্টের এক কপি কলকাতা পুলিশ প্রধানের কাছে তার জ্ঞাতার্থে পাঠানো।

জ) সরকারি ডাক্তার সপ্তাহে এক দিন পতিতালয় পরিদর্শন করতেন। পরিদর্শনের দিন আগে থাকতে ঠিক করে দেওয়া।

         ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৫৬ সালে এলো The Prevention of Immoral Traffic Act। এই আইন ১৯৫০ সালের ৯ মে নিউইয়র্কে স্বাক্ষরিত আন্তর্জাতিক কনভেনশন অনুসরণে বিধিবদ্ধ একটি আইন। এই আইনে পতিতালয় চালানোর জন্য, পতিতাবৃত্তির উপার্জনের উপর জীবন নির্বাহ করার জন্য, পতিতাবৃত্তির জন্য ব্যক্তি সংগ্রহ করা, পতিতাবৃত্তির জন্য উস্কানি দেওয়া বা প্রলুব্ধ করা ইত্যাদির জন্য সাজার ব্যবস্থা আছে। এই আইনে যে পতিতাবৃত্তি করে তাকে অপরাধী হিসাবে না দেখে Victim বা ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তি হিসাবে দেখা হয়। তবে কোন পতিতা যদি অন্য কোনও মেয়েকে এই ব্যবসায় নামায় তবে সে পতিতা হিসাবে ছাড় পাবে না। সত্যি কথা বলতে কি পতিতাদের প্রতি যে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি দেওয়া দরকার, বা তাদের যোগ্য পুনর্বাসনের প্রয়োজন তার প্রথম সফল প্রয়াস এই নির্দেশিকা বলা যেতে পারে। এখনও এই আইন বলে নারীপাচারের বিরুদ্ধে লড়তে হয় পুলিশকে।

         কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, আইন আছে, আইন প্রয়োগকারী আছে, সদিচ্ছা সম্পন্ন ব্যক্তিদের অভাব নেই। তবুও আইন পুরোপুরি নারীপাচার রোধ করাতে পারেনি, পতিতাবৃত্তি রোধ করতে পারেনি। বলা হয়, পতিতাবৃত্তি সবচেয়ে আদিম পেশা, এর বাজার আছে। বাজারে নারীদের চাহিদা আছে, দরিদ্রের কারণে নারী যোগানের অভাব নেই। ‘বাজার অর্থনীতি’র কারণে আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নারীপাচার চলছে। সে যাই হোক আমাদের প্রার্থনা হবে কেউ যেন তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে এই পেশা বেছে নিতে বাধ্য না হয়। আর প্রশাসনের কাছে কেউ যদি এই সংক্রান্ত অভিযোগ নিয়ে গেলে সে যেন আইনের সুরক্ষা পায়। সে বিষয়ে যেন আইন রক্ষাকারীরা সজাগ থাকেন।