পর্ব ৪৬

(মোহসীন-উল-হাকিম ২০০০ সাল থেকে সাংবাদিকতা করছেন । ২০০৯ সালে আইলা ঝড়ের পরে বাংলাদেশের দেশ টিভির প্রতিবেদক হিসেবে সুন্দরবনে পৌঁছন । প্রান্তিক মানুষের জীবন জীবিকা নিয়ে তিনি কাজ করে চলেছেন । সুন্দরবনকে জলদস্যুমুক্ত করতে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি।  তাঁর মধ্যস্থতাতেই ৩২৮ জন জলদস্যু আত্মসমর্পণ করেছেন ।)

সাগর বাহিনীকে আত্মসমর্পণ করানোর সময় সুন্দরবনের ভয়ঙ্কর বাঘের মুখে পড়ার মতো পরিস্থিতি হয়েছিল আমাদের। বলছি সেই রোমহর্ষক ঘটনার কথা।

ওইদিন সন্ধ্যার আগে আগে খবর পেলাম যে আমরা যেখানে আছি, তার খুব কাছাকাছি ৱ্যাবের একটা অভিযান চলছে। চিন্তা করলাম আর ঝুঁকি নেওয়া যাবে না। তাই দ্রুত ওদের বিদায় দিলাম। একটা ডিঙ্গি নৌকায় চড়ে বসলাম আমরা। নৌকায় উঠে কিছু দূর এগুতেই দেখি নিয়ে নৌকায় পানি ঢুকছে বেশ জোরেসোরে। নৌকার তলায় ফুটো হয়ে গেছে। সেই নৌকায় মাঝি-সহ আমরা ৫ জন ছিলাম। সন্ধ্যা হলো। ওদিকে বৃষ্টিও নামলো। সঙ্গে কোনও টর্চও নাই , আসার সময় তাড়াহুড়া করতে গিয়ে সেটা আনা হয়নি। সেই অবস্থাতেই আমাদের নৌকা চলছে। আর ছোট ছেলেটা পানি সেচছে। ঘণ্টা দু’য়েকের পথ। এর মধ্যে প্রায় চল্লিশ/পঁয়তাল্লিশ মিনিটের পথ একেবারে সরু।  জায়গাটা এতো সরু যে নৌকায় বসা অবস্থায় দুই পাশে হাত দিলে দুই তীরের গাছপালা ধরা যাবে। আর ওই জায়গাটাতে প্রচুর বাঘের আনাগোনা ছিল।  বেশ একটা গা ছমছমে পরিবেশ। খালটির নাম চিপার খাল। সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জ এর ঝাপসি ও জোংড়া খালের সংযোগ করেছে এই ভাড়ানীটি।

আমি ভাবছিলাম, যে ভাবেই হোক আমাদের খুব তাড়াতাড়ি ওখান থেকে বের হতে হবে। কারণ, জোয়ার শেষ হয়ে ভাঁটা শুরু হলেই আমরা ওই সরু জায়গায় আটকে যাবো। আর একবার আটকে গেলে অন্য কোনও উপায় নেই। কাদার উপর নৌকায় বসে থাকা চরম ঝুঁকির। তাই বাকি পথটা আমাদের হেঁটে রওনা হতে হবে। আর সেটাও এই রাতের বেলায় মৃত্যুকে নিমন্ত্রণ দেবার মতো ব্যাপার। আমার জীবনে ওই দিনের ঘটনা ছিল সবচেয়ে ভয়ের অভিযান। প্রায় বাঘের মুখে পড়তে চলেছিলাম আমরা।

ওই সময়টায় আমার সাথে কোনও বনদস্যু নাই , কোনও সশস্ত্র লোকজনও নাই, এমনকি ওই রাতে আমাদের সঙ্গে একটা টর্চ পর্যন্ত ছিল না। তার উপরে আবার যে নৌকায় চলেছি, সেই নৌকার তলায় ফুটো। ডান  বামে এক ইঞ্চি এক এক ইঞ্চি জায়গা আছে।  নড়াচড়া করার  উপায় নাই।  মাথার ভিতরে শুধু দুশ্চিন্তা ঘোরাফেরা করছে। চলছি আমরা সেভাবেই।

হঠাৎ খেয়াল করলাম, আমাদের নৌকার মাঝি ছটফট করতে শুরু করলেন। তিনি আমার পিছনে বসা। চারিদিকে কেমন যেন একটা পচা গন্ধ। খুটখাট শব্দও পাচ্ছি।  সুন্দরবনে গভীর ভাবে জলে জঙ্গলে ঘোরেন যাঁরা, তাঁরা জানেন, বাঘ যদি আশপাশে থাকে, আর যদি বাতাস থাকে— তবে মাঝে মাঝে বাঘের গন্ধ পাওয়া যায়। একটা বিকট গন্ধ, চিড়িয়াখানায় সেই গন্ধটা পাওয়া যায়। কিছু সময় চলার পরে আমি সেই রকম গন্ধ পাচ্ছিলাম। প্রথমে ভেবেছিলাম, হয়তো কিছু একটা মরে পচে আছে।

নৌকার মাঝিকে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলাম। জানালেন, আশপাশেই বাঘ আছে। সেজন্যই গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। তিনি বললেন, সমস্যা আছে! মানে  বাঘ আমাদের নৌকার পাশে পাশে হাঁটছে, আমাদের অনুসরণ করছে। সেই অন্ধকারে এত কাছে বাঘের উপস্থিতির কথা জানতে পেরে ভিতরে ভিতরে ছটফট করছিলাম।

মাঝির পাশে বসে কানে কানে তাকে ফিসফিস করে বলেছিলাম, সমস্যা হবে?

—বিরাট সমস্যা, মামা!

আমি বললাম, ভয় পাইয়েন না।  কোনোও সমস্যা হবে না। চলেন।

আমি তখন মনটাকে শক্ত রাখার চেষ্টা করছি। এই সময় নার্ভাস হলে চলবে না। কিন্তু মাঝিকে দেখলাম, তিনি তার নিজের জন্য যতটা না বিচলিত, আমাদের কথা ভেবে আরও ভয় পাচ্ছিলেন। আর আমিও উদ্বিগ্ন ছিলাম আমার সঙ্গে থাকা লোকজনদের নিয়ে। মনে মনে ভাবছিলাম, যা হবার আমার হোক, বাঘ যেন আর কাউকে আক্রমণ না করে। এই সময় যদি বাঘে কাউকে ধরে নিয়ে যায় তবে তার কৈফিয়ৎ আমি দেব কী করে? দুশ্চিন্তায় গা হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছিল।

—এই নড়াচড়া করো না। পানি সেচো। ক্যামেরার ব্যাগ ভিজে যাচ্ছে। এমন অনেক কথা বলতে বলতে যাচ্ছিলাম।

এই পুরো ৪০/৪৫ মিনিটের পথ আমি শোরগোল করতে করতে গেলাম। আমি আসলে আমার লোকেদের কিছু বুঝতে দিতে চাইনি। পুরো সময়টাই তাদের সঙ্গে নানা কথা বলে গেছি। তারপর একসময় ওই সরু খাল থেকে বের হয়ে ১০/২০ ফুটের প্রশস্ত একটা জায়গাতে পড়লাম আমরা। এবার যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।

সবাইকে বললাম, তোমরা তো বুঝলে না আমরা কি পার হয়ে এলাম! এই পুরো সময়টা আমি বাঘের গন্ধ ও চলার শব্দ পাচ্ছিলাম। অন্য কোনও প্রাণী বনের মধ্যে হাঁটার সময় এমন খুটখাট আওয়াজ হয় না।  পায়ের তলায় পড়ে শুকনো কাঠি ভাঙার যে খুটখাট আওয়াজ, সেটা যে বেঙ্গল টাইগারের তা নিয়ে কোনও সন্দেহ ছিল না। হরিণ বা শূকর— সব প্রাণীর হাঁটার ধরন ভিন্ন। শব্দও ভিন্ন।  শুধু মাত্র বাঘের ক্ষেত্রেই এমন শব্দ হয়। পুরো সময়টা জুড়েই খুটখাট শব্দে ডান পাশে হেঁটে যাচ্ছিল কিছু একটা। সঙ্গে সেই বিকট গন্ধটাও চলছিলো সাথে সাথে। আমার মনে হয়, ওই পুরো পথটা বাঘটা আমাদের অনুসরণ করতে করতে হেঁটেছে। আর ওই পুরো ৪০/৪৫ মিনিটের পথ প্রতি মুহূর্তে একটা আতঙ্ক হয়ে রয়ে গেছে। সেই অভিজ্ঞতার কথা জীবনে ভুলতে পারবো না। অনেকেই আমার কাছে জানতে চেয়েছেন, সুন্দরবনে আমি বাঘের মুখোমুখি হয়েছি কি না। সেই রুদ্ধশ্বাস অভিজ্ঞতার  আজ জানালাম। বাঘ দেখেছি বনে। সামনেও পড়েছি। কিন্তু বাঘ না দেখে বাঘের ভয় পাওয়াটা অনেক বেশি ভয়ঙ্কর। জলদস্যুদের আত্মসমর্পণের কথা বলবো পরের পর্বে।

(ক্রমশ)