কোনও লুকোচুরি নয়, বেশ ঘটা করেই সতীদাহ হয়েছিল প্রায় দুই শতাব্দী আগে গোবরডাঙার গৈপুরে। সতীদাহের ওই অনুষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন গোবরডাঙার তৎকালীন জমিদার কালীপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়।

রীতিমতো হাতির পিঠে চেপে, লোকলস্কর নিয়ে গোবরডাঙার গৈপুরের এক বর্ধিষ্ণু পরিবারের গৃহবধূর সতীদাহ অনুষ্ঠানে তিনি যোগ দিয়েছিলেন। গ্রামের মানুষ তো বটেই, যমুনাপারের আশপাশের মানুষও সেই সতীদাহের কথা জানলেও প্রতিবাদে মুখে সেদিন রা কাটেননি। শতাব্দী-প্রাচীন গ্রন্থে এই সতীদাহ প্রসঙ্গ থাকলেও তৎকালীন গোবরডাঙাবাসীর প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে কোনও উল্লেখ নেই।

রূপ কানোয়ার

ঘটনাটি ঘটেছিল উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের মাঝামাঝি সময়ে। রামমোহন রায়ের সতীদাহ-বিরোধী আন্দোলনের বার্তায় সেদিন গোবরডাঙাবাসী সাড়া না দিলেও এই সতীদাহের পঞ্চাশ বছর পর খোদ কেশবচন্দ্র সেন গোবরডাঙায় এসে ব্রাহ্মসমাজের উদ্বোধন করে যান। ব্রাহ্মসমাজের মাধ্যমে গোবরডাঙার জমিদারি এলাকায় রেনেসাঁর আলোকচ্ছটা পড়তে শুরু করে। এলাকায় প্রগতিশীল ভাবনা, জ্ঞানবিজ্ঞান ও সংস্কৃতিচর্চা শুরু হতে থাকে। গোবরডাঙা গবেষণা পরিষদের কর্ণধার দীপককুমার দাঁ এলাকায় অনুষ্ঠিত দু’দিন ব্যাপী রামমোহন মেলা প্রাঙ্গনে দাঁড়িয়ে দু’শো বছর আগের সেই ইতিহাসের কথা শোনালেন। গোবরডাঙাবাসী তরুণ ইতিহাস গবেষক বিপ্লব ঘোষ জানালেন, গৈপুরের তেঁতুলতলার কাছে গেলে সেই নৃশংস সতীদাহের ঘটনার কথা ভেবে লজ্জায় কুঁকড়ে যেতে হয়।

বনগাঁর গোপালনগরের কাছে একটি সতীদাহের জনশ্রুতি থাকলেও তেমন কিছু তথ্যসমৃদ্ধ নথি পাওয়া যায়নি। গোবরডাঙাবাসী প্রবীণ সাংবাদিক সত্যব্রত দাস মনে করেন, সেই সময়টা ছিল সতীদাহের পক্ষে সওয়াল করার যুগ। রামমোহন রায় স্রোতের বিপরীতে কঠিন লড়াই চালাচ্ছিলেন— সতীদাহ প্রথা রদ করার জন্য। কিন্তু তার প্রভাব গোটা বাংলায় সর্বত্র সেভাবে পড়েছিল, তেমনটা নয়। আর সম্ভ্রান্ত পরিবারের ক্যারিশ্মা বানাতে জমিদারবাবু সতীদাহ অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন— এমনটাই ছিল পরিবেশ। তবে সময় পাল্টেছে। কেশবচন্দ্র সেন যেমন ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তেমনি রামতনু লাহিড়ী যে গোবরডাঙায় এসে থাকতেন এবং ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল— সেকথা ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়।

কেশব চন্দ্র সেন

গোবরডাঙাবাসী সত্যব্রত দাস বলেন, ‘‘আমাদের গর্বের যেমন নানা দিক রয়েছে, তেমনি কলঙ্কের একটা গভীর কালো দাগ রয়েছে এলাকায় সতীদাহের ঘটনাকে কেন্দ্র করে।’’

তথ্যসূত্র— বিপিনবিহারী চক্রবর্তী ও দুর্গাচরণ রক্ষিত প্রণীত খাঁটুরার ইতিহাস ও কুশদীপ কাহিনী